শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ গ্রন্থে ‘কচ্ছপকাহিনি’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিষয়বস্তু ছিল কীভাবে তিনি কচ্ছপের মতো কামড় দিয়ে একটা ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি করতে চান। উদাহরণস্বরূপ সেখানে কীভাবে তিনি কচ্ছপের মতো কামড় দিয়ে নেত্রকোনার একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন, সেই গল্পও বলেছেন বিস্তারিত। হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ বাড়ি থেকে সত্তর মাইল দূরে জায়গির থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনিই ছিলেন অতি দুর্গম গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিকুলেট, প্রথম গ্র্যাজুয়েট। তাই উনার মা আয়েশা ফয়েজ উনার কাছে সেই গ্রামে একটা স্কুল করে দেবার আবদার করেন। স্কুলের নাম ঠিক করা হয় ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। এরপর তিনি লিখেছেন, ‘কী যে ভয়াবহ এক ঝামেলা সেদিন মাথায় নিলাম, তা আমি জানি আর জানেন বেলাল বেগ।’
বেলাল বেগ উনাকে কিছু শর্ত দিলেন—
১.
এই স্কুল আর দশটা স্কুলের মতো হলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন এক স্কুল, যা উন্নত দেশের স্কুলের পাশে দাঁড়াবে।
২.
স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিখবে মোরালিটি।
৩.
প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে।
তার আগে গ্রামের মানুষদের স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। জায়গা কিনতে হবে। রাস্তাঘাট করতে হবে। ইলেকট্রিসিটি আনতে হবে। স্কুলটির অপূর্ব ডিজাইন করে দিয়েছিলেন আর্কিটেকচারের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মেহের আফরোজ শাওন। স্কুল দাঁড়িয়ে গেলে কীভাবে চালানো হবে, সেটা নিয়ে তিনি ভাবনায় পড়ে গেলেন। নিজের সঞ্চিত অর্থের সবটাই ব্যয় করে ফেললেন। কিন্তু তখনও ফার্নিচার কেনার টাকা নেই। বেড়া দেওয়ার টাকা নেই। স্কুলটিকে নির্মাণের মাঝপথে রেখে বেলাল বেগ আমেরিকায় চলে যান।
এরপর তিনি চেষ্টা করলেন স্কুলটি সরকারের হাতে তুলে দিতে কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কেউ স্কুলের দায়িত্ব নিলেন না। এরপর স্কুল বাদ দিয়ে হাসপাতাল বানানোর পরিকল্পনা করে সেখানেও ধাক্কা খেলেন। এমনকি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকও স্কুলটির দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে স্কুলের ২৬০টি কাচের জানালা ভেঙে পড়ে। লাইব্রেরি ঘর হিসেবে যেটা বানানো হয়েছিল, সেখানে নেশাখোরেরা গাঁজা খাওয়ার আসর বসাল। স্কুলের মাঠে শর্ষে বুনে দেয়া হলো। স্কুলের চারপাশের লোহার খুঁটিগুলো তুলে গ্রামের মানুষেরাই সের দরে বাজারে বেচে দিল। স্কুল ভবন গরু-ছাগল রাখার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হলো। কিন্তু তবুও তিনি দমে না গিয়ে লেগেছিলেন। যেটাকে উনি বলেছেন কচ্ছপের কামড়। এর পর থেকে স্কুলটি চলছে। তিনি লিখেছেন, পাসের হার ১০০ ভাগ। সে বছর বৃত্তি পেয়েছিল পাঁচটি ছেলেমেয়ে।
স্কুলটির উপরোক্ত ইতিহাস পড়ার পর থেকেই এটাকে দেখার জন্য আগ্রহবোধ করছিলাম। অবশেষে সুযোগটাও এসে গেল ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার পর। দাদা শ্বশুরের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার পাইকুড়া ইউনিয়নের চিট্টুয়া গ্রামে। চিট্টুয়ার সামনের বিশাল বিলের অপর পারেই কুতুবপুর গ্রাম। কিন্তু যেতে হবে রোয়াইলবাড়ি বাজার হয়ে। ঢাকা থেকে আপনি যেকোনো বাসে নান্দাইল চৌরাস্তা পর্যন্ত গিয়ে এরপর টেম্পু বা অটোরিকশাতে করে আঠারো বাড়ি যেতে পারেন। সেখান থেকে আবার অটোরিকশাতে যেতে পারেন কুতুবপুর। কুতুবপুরের রাস্তা বেশিরভাগই পাকা। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসার সময় পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা গ্রামবাংলার দেখা পাবেন। আমরা রোয়াইলবাড়ি বাজার থেকে পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম। কাঁচা রাস্তায় জুতা–মোজা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। সোঁদা মাটির স্পর্শে শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেলো। আমাদের পাশ দিয়েই দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে ছেলে মেয়েরা ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’–এ যাচ্ছিল।
আমি এটা দেখে খুবই অবাক হয়ে আমার শ্যালক মারুফকে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, এই স্কুলটা নেত্রকোনার সবচেয়ে ভালো স্কুল। এই বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছিলাম স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের কথা থেকে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। মূল রাস্তায় প্রথমেই চোখে পড়ল একটা নামফলক ‘শহীদ ফয়জুর রহমান সড়ক’। তারপরই আছে স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর, যেটা স্থাপন করেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তি সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর। এরপর অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে স্থানীয় বাচ্চারা খেলাধুলা করছিল। এখানটায় হুমায়ূন আহমেদ স্কুলের বাচ্চাদের খেলার জন্য একটা পার্ক স্থাপন করেছিলেন, যার কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই। এরপর একটা পুকুর। পুকুরের পাড় ধরে এগোলেই স্কুলের মাঠ। এই পথের শেষে মাঠের কোণায় রয়েছে সাদা রঙের শহীদ স্মৃতিফলক, যেটি উদ্বোধন করেন কবি শামসুর রাহমান।
মাঠের শেষ প্রান্তে মূল ভবনটি। আসলে এটা একটা ভবন না। অনেকগুলো ভবনের একটা গুচ্ছ। শক্ত ভিত্তির ওপর ইটের দেয়ালের আয়তাকার এক একটা ভবন। দৈর্ঘ্যের একদিকের দেয়াল উঁচু, আর অন্যদিকের দেয়াল নিচু। তার ওপর টিনের একচালা ছাউনি। ছাত্রছাত্রীরা যাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পারে, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। কেন্দ্রের গ্রন্থাগার ভবনটি শুধু দোচালা। ভবনগুলোর বেশিরভাগই শ্রেণিকক্ষ। বাকিগুলোর মধ্যে একটা গ্রন্থাগার, যাতে অনেক মূল্যবান বই রয়েছে। আরও আছে একটা কম্পিউটার ল্যাবরেটরি, যেখানে রয়েছে ল্যাপটপ কম্পিউটার। আমরা গিয়েছিলাম ১ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে। সেদিন ছিল বই দিবস। স্কুলের সামনের চলছিল ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত। প্রতি শ্রেণির প্রথম তিনজনের নাম ডেকে তাদের হাতে বই তুলে দেওয়া হচ্ছিল। এরপর শ্রেণিকক্ষে এসে বাকিদের মধ্যে বই বিতরণ করা হচ্ছিল।
আমরা শ্রেণিকক্ষগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখলাম। চমৎকার সাজানো–গোছানো। শিক্ষক আমাদের জানালেন, প্রতি শ্রেণিতে একটা নির্দিষ্টসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর বেশি ভর্তি নেওয়া হয় না। এতে করে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকে এবং শিক্ষকেরা ছাত্রদের কাছ থেকে নিয়মিত পড়া আদায় করতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের আর আলাদাভাবে প্রাইভেট পড়তে হয় না। এগুলো সবই হুমায়ূন আহমেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়। তাই প্রায় প্রতি বছরই এই স্কুলটা ফলাফলের দিক দিয়ে শতভাগ পাসসহ নেত্রকোনার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। শিক্ষক জানান, এতো ভালো ফলাফল করার পরও স্কুলটি অবহেলিত। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে অনেকেই এখানে আসতেন। এখন আর তেমন কেউ আসেন না। আর সরকারি লোকজনও কেন জানি স্কুলটাকে এড়িয়ে চলেন। এখন পাঞ্জেরি হয়ে শক্ত হাতে স্কুলটির হাল ধরে আছেন মেহের আফরোজ শাওন।
স্কুলের বাইরে অনেক সাইকেলের সংখ্যা প্রমাণ করে, দূরদূরান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা এই স্কুলে পড়তে আসে। মাঠের উত্তর পাশে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে চারতলাবিশিষ্ট আরেকটি ভবন। শীঘ্রই ছাত্রছাত্রীরা এই নতুন ভবনে ক্লাস করতে পারবেন। বাংলাদেশের বুকে এমন একটা স্কুল আছে, যেটা নিয়ে আমরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি। উপরন্তু এই স্কুলের প্রাঙ্গণে পদধূলি পড়েছে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের। স্কুলের বস্তুগত এবং পাঠগত কাঠামোটি আন্তর্জাতিক মানের। আর ফলাফলও ঈর্ষণীয়। সব দিক থেকেই স্কুলটি যেকোনো জ্ঞানপিপাসু এবং ভ্রমণপিয়াসী মানুষের জন্য একটা চমৎকার দেখার জায়গা। এমন একটা প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার একান্ত দায়িত্ব। এখন আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রেই নষ্টদের সগর্ব বিচরণ। সবকিছুই এখন তাদের অধিকারে। তবুও ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’–এর মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখায়, আশাবাদী হতে শেখায়।