প্রবাসে লক্ষ্মীপূজার নাড়ুর খোঁজে
চর এলাকায় শস্য উৎপাদন ছাড়া ফলমূল তেমন একটা হয় না। তবে যে ফলের গাছ কয়েক বছরের ব্যবধানেই ফল দেয়, যেমন কুল, পেয়ারা, আতা, কলা—এগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেলের গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য পুরোনো চর ভেঙে গেলে নতুন চরে এসে বসতি গড়ার পর সময়ও লাগে গাছগুলো বড় হয়ে উঠতে। তাই আম, জাম, কাঁঠাল বা নারকেলগাছ লাগানো হলেও তখন পর্যন্ত সেগুলো ফল দেওয়া শুরু করেনি। তাই হাট থেকে কিনে এনে সেগুলো খাওয়া হয় বা সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করে পরিবেশন করা হয়।
বছরের একটা সময় হাট থেকে নারকেল কিনে আনা হতো নাড়ু তৈরি করার জন্য। সেই নারকেলগুলোর মধ্যে কিছু কিছুর বয়স অনেক বেশি হয়ে যাওয়াতে তার মধ্যে ‘ফোঁপরা’ গজিয়ে যেত। হলুদাভ রঙের তুলতুলে ফোঁপরা খেতে দারুণ। আমরা ছোটরা সেটা বাটিতে নিয়ে খেয়ে বেড়াতাম। তবে নারকেল দিয়ে বানানো যে জিনিসটার জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম, সেটা হচ্ছে নারকেলের নাড়ু। বাবা–চাচারা নারকেলের ছোবড়া ছাড়িয়ে নারকেলের মালয়টাকে একেবারে টেকো মাথার মতো তেলতেলে পরিষ্কার করে ফেলতো।
আমরা ছোবড়াটাকে মাথায় মুকুটের মতো পরে খেলাধুলা করতাম অনেক সময়। সেই তেলতেলে নারকেলের মালয় ভেঙে পানিটা একটা গ্লাসে সংরক্ষণ করা হতো সেটা আমরা এমনি এমনিই খেতাম। এরপর শুরু হতো মায়েদের কাজ। নারকেলের মালয় নারকেল কোরার ওপরে ধরে নিপুণ দক্ষতায় ওপর–নিচ করে নারকেলের মালয় থেকে সবটুকু নারকেল ছাড়িয়ে নিতেন। সেই কোরা নারকেল দেখতে হতো অনেকটা সুজির মতো।
নারকেল কোরার পাশাপাশি মাটির চুলায় একটা পাতিলে পানি জ্বাল দেওয়া হতো। পানি গরম হয়ে গেলে তার মধ্যে গুড়ের পাটালি ছেড়ে দেয়া হতো। এরপর জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গুড়ের পেস্ট তৈরি করা হতো। এরপর তার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হতো কোরা নারকেল। তারপর জ্বাল দেয়া চলতো যতক্ষণ না নারকেলের এবং গুড়ের মিশ্রণটা হাতে নিয়ে দলা পাকানো যায়। একটু পর পর সামান্য পরিমাণ হাতে তুলে নিয়ে মায়েরা সেটা হাতের তালুইতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতেন যে সেটা দিয়ে গোলা তৈরি করা যাচ্ছে কি না। আমরা ছোটরা গোল হয়ে হাতের টুরিতে মুড়ি নিয়ে চুলার পাশে বসে অপেক্ষা করতাম, কখন নাড়ু তৈরি হবে।
এ ভাবে চলতে চলতে একসময় নাড়ু তৈরি হয়ে যেত। আমরা টুরির মধ্যে মুড়ি নিয়ে ঘুরেঘুরে সেটা খেয়ে বেড়াতাম। কারটা সবার পরে শেষ হবে, সেটা নিয়ে মনেমনে একধরনের প্রতিযোগিতা চলত। কারণ, তাহলে সে অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে খেতে পারবে। নাড়ু পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো শুকিয়ে মুড়ির টিনের মধ্যে সংরক্ষণ করা হতো। পুরোনো দুধের টিনগুলো ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে তারমধ্যে মুড়ি রেখে তার ভিতরে নাড়ু রাখা হতো। আমরা ছোটরা বিভিন্ন সময়ে চুরি করে সেগুলো খেয়ে ফেলতাম। মুড়ি আর নাড়ু ছিলো গ্রামদেশের বৈকালিক নাস্তা। বিশেষ করে খেতের কাজ সেরে পুরুষেরা বিকেলে বাড়ি ফিরলে তাঁদেরকে একবাটি নাড়ু মুড়ির সঙ্গে এক গ্লাস পানি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।
এরপর নদীভাঙনের কবলে পড়ে আমরা চরভবানীপুর থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদিতে চলে এলাম সপরিবারে। এখানে এসে নারকেল আর কেনা লাগত না। কারণ, আমরা দুই ভাই অন্যের গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমরা নির্দিষ্ট গাছতলায় গিয়ে হাজির হতাম। আমাদের সমবয়সী সব বাচ্চাউ এই কাজটা করত। তাই এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে একধরনের অলিখিত প্রতিযোগিতাও চলত। তবে আমরা দুই ভাই পিঠাপিঠি হওয়াতে অন্যরা আমাদের সঙ্গে পেরে উঠত না। আর আমরা দুই ভাই ভালো গাছে চড়তে পারতাম। অন্যের গাছ থেকে নারকেল পেড়ে দিলে তারা তার বিনিময়ে নারকেল দিতেন। এভাবেও নারকেল জোগাড় হতো। এর বাইরে নাড়ুর আরও একটা জোগান ছিল।
সেটা হলো আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। আমাদের এক বাড়ি পরেই ছিলো বলাই দাদু ও কেশরী দাদুদের বাড়ি। উনাদের দুই ভাইয়ের বাড়ি পাশাপাশি। তাঁদের ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি মিলে এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। বছরের সারা সময়টাই উনাদের বাড়ি দুটি গমগম করে মানুষের বিচরণে। পূজার সময় আরও বেশি মানুষের সমাগম হয়। দুর্গাপূজার পর আসে লক্ষ্মীপূজা। লক্ষ্মীপূজার নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি সংগ্রহ করার চল ছিল আমাদের মধ্যে। আমরা দুই ভাই এটা সংগ্রহ করতে যেতে লজ্জা পেতাম। তাই বলাই দাদু এবং কেশরী দাদুর স্ত্রী, যাঁদেরকে আমরা কর্তা বলতাম, তাঁরা পালাক্রমে এসে আমাদের বাড়িতে নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি—এগুলো দিয়ে যেতেন।
বছরজুড়েই তাই আমরা দুর্গাপূজার চেয়ে লক্ষ্মীপূজার জন্য বেশি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম নাড়ু খাওয়ার জন্য। আমাদের মা–ও নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি বানাতেন কিন্তু উনাদের বানানো নাড়ুর স্বাদই ছিলো আলাদা। কর্তারা শাড়ির আঁচলের তলে লুকিয়ে সেগুলো এনে আস্তে করে মায়ের হাতে দিয়ে বলে যেতেন, আমার নাতিগুলোকে দিয়ো। এখনও লক্ষ্মীপূজার সময় আসলে তাই দুই কর্তার কথায় সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। দুই কর্তা আর বলাই দাদু মারা গিয়েছেন। এখন শুধু বেঁচে আছেন শুধু কেশরী দাদু।
দেশ ছাড়ার আগে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেশ ছেড়ে আসার পরও নিয়মিত যোগাযোগ আছে তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা আসলে আমাদের পরিবারেরই অংশ। বড় কর্তার বড় ছেলে প্রদীপ কাকুর ছেলে বিদ্যুৎ আমার আশৈশব বন্ধু। মেয়ে শিল্পী আমাকে ভাই জ্ঞান করে। কুষ্টিয়া থেকে ফেরার আগের দিন শিল্পীর বাসায় দাওয়াত করে মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে আমার পছন্দের লুচি-লাবড়া খাইয়েছিল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সামান্য আয়োজন কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিলো আমার জীবনের সেরা খাবারটা খেলাম। কারণ, তাতে ছিল বোনের আন্তরিক ভালোবাসার ছোঁয়া।
প্রবাসের এই গতিময় জীবনে এসেও নাড়ু আর বড়ার স্মৃতি তাড়া করে ফিরত অবিরত। এখানে সব রকমের নারকেলই পাওয়া যায়, এমনকি কোরা নারকেলের প্যাকেট পাওয়া যায় আর এশিয়ান দোকানগুলোতে পাওয়া যায় পাটালি কিন্তু বানানোর সঠিক প্রক্রিয়াটা জানা ছিল না বলে আমরা একদিন নাড়ু বানালাম, কিন্তু সেটা ততটা স্বাদের হলো না। এরপর রিনা ভাবির মা দেশ থেকে আসার সময় সঙ্গে করে নাড়ু নিয়ে এসেছিলেন, সেই নাড়ু আমার মায়ের হাতের নাড়ুর কথা মনে করিয়ে দিল।
এরপর পঞ্জিকা ধরে একসময় লক্ষ্মীপূজা এসে হাজির হলো, তখন পরিচিত বৌদিদের কে জ্বালাতন শুরু করলাম নাড়ুর জন্য। পুনম বৌদি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এখানে আমাদের পাশের সাবার্বেই থাকেন। দুর্গাপূজায় যেয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি আমার এই নাড়ুপ্রীতির কথা জানতেন। তিনি আর আমি একই ট্রেন ধরে কাজে যাই। তাঁর সঙ্গে একদিন মিন্টো স্টেশনে দেখা হলে নাড়ুভর্তি একটা প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমার মনে হলো যেন আমি পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পেলাম। সেই নাড়ু সবাই মিলে অনেক মজা করে খেয়েছিলাম। এ ছাড়াও শ্যালিকা পলির মা দেশ থেকে বিভিন্ন রকমের নাড়ু নিয়ে এসেছিলেন। আমি নাড়ু পছন্দ করি বলে অনেকগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার বুয়েটের বান্ধবী নন্দিতা। গত বছর এই সময় ওর মা অস্ট্রেলিয়াতে ছিলেন। আমি সুযোগ পেলেই তাঁর সঙ্গে গিয়ে গল্প করতাম। কতশত গল্প হতো আমাদের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়গুলো আগেকার দিনে মনে হয় বেশি ভালো ছিল। গল্পের ফাঁকে তিনি আমার জন্য লুচি আর লাবড়া রান্না করতেন। কারণ, তিনি জানতেন আমি এগুলো খুবই পছন্দ করি। আর প্রবাসজীবনে অনেক অনুভবও করি। কাকিমার হাতের খাবারের স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে। লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে উনি কিছু নাড়ু বানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নন্দিতা ফোন দিয়ে বলল, চলে যায় কুবের, মা তোর জন্য নাড়ু বানিয়েছে। পদ্মা পাড়ের মানুষ হওয়াতে ও আমাকে কুবের বলেই ডাকে। এরপর ওখানে বসে কয়েকটা খেলাম আর বাকিটা কাকিমা একটা পোটলা করে দিয়ে দিলেন। সেই নাড়ু অনেকদিন ধরে খেয়েছিলাম আমরা।
প্রতিবছর লক্ষ্মীপূজা এলে তাই নারকেলের নাড়ুর সঙ্গে মুড়ি, মুড়কির কথা মনে পড়ে যায়। ধন্যবাদ রিনা ভাবি, পুনম বৌদি, শ্যালিকা পলি ও বান্ধবী নন্দিতাকে। আমাদের শৈশব–কৈশোরের আনন্দনময় মুহূর্তগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রবাসজীবন প্রচণ্ড রকমের গতিময়। এখানে আলাদাভাবে সুখ বা শান্তির অনুসন্ধান করারও সময় নেই। তাই আমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাগুলোর মধ্যে থেকেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করি। সামান্য নারকেলের নাড়ু আমাকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছিল। এই আনন্দের মুহূর্তগুলো অনেক ক্ষুদ্র হলেও তার প্রভাব মনের ওপর থাকে অনেক দিন।