আজও মনে পড়ছে ছোটবেলার পলো দিয়ে মাছ ধরার স্মৃতি

আপনি কি আমার মতো গ্রামের বাসিন্দা? ছোটবেলায় তাহলে তো দুষ্টুমি করেছেন? ডানপিটে ছিলেন বুঝি? মা–বাবার বকুনি খেতে কেমন লাগত? বাবার হাতে পিটুনি খেয়েছেন কখনো? বাড়ি থেকে পালিয়েছেন? পলো দিয়ে মাছ ধরেছেন? ধুর, কিছুই করেননি? তাহলে গ্রামে জন্মেছিলেন কেন? শহরে থাকতেন!

আমি কিন্তু গ্রামের ছেলে। গ্রামে যা ঘটেছে, আমি তার প্রায় সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিলাম। ভুল বুঝবেন না—দুষ্টুমি করেছি, কিন্তু আকাম–কুকাম করিনি। তবে প্রতিবেশীর গাছের আম, জাম, লিচু, বোরোই, খেজুরগাছে উঠে নল দিয়ে রস খাওয়া, কাঁঠাল চুরি করে খাওয়া—এসব মাঝেমধ্যে করেছি। আর সেই কারণে মায়ের কাছে বকা আর বাবা বাড়িতে এলে ধোলাই খেয়েছি।

ছোটবেলার সেই দিনগুলোর স্মৃতি আজও মনে পড়ে। মনে পড়ে প্রথম প্রেমের স্মৃতি, মনে পড়ে বন্ধুত্বের প্রীতি, মনে পড়ে নবগঙ্গা এবং নানাবাড়ির পাশে চিত্রা নদীর কথা। সারা পৃথিবী প্রায় ঘুরেছি, অথচ মনে পড়ে সেই গ্রামবাংলার কথা, সেই মানুষের কথা। কী আশ্চর্য! বাইরে পৃথিবী এত সুন্দর হয়েও আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে মুছে ফেলতে পারেনি।

হঠাৎ ফেসবুকে দেখলাম পলো দিয়ে মাছ ধরছে কেউ। মনে হলো মাছ ধরা পড়েছে, কিন্তু ভদ্রলোক এত ঢং করছে যে বুঝতে পারলাম না, সে সত্যি মাছ ধরতে এসেছে নাকি শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে রংবাহানা করছে। সেই দৃশ্য দেখে মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার দিনগুলোর কথা।

আমার গ্রামের নাম নহাটা। নবগঙ্গা নদীর তীরে নহাটা বাজারের পাশে আমাদের গ্রাম, তারপর বিশাল ইছামতীর বিল। সময়টা সম্ভবত ১৯৭৪ সাল। বাংলাদেশে তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, আবার কোথাও বন্যা। দেশে প্রচণ্ড আহাকার দেখা দিয়েছিল। ইছামতীর বিলের পানি আস্তে আস্তে কমে যায়, আর বিলে প্রচুর মাছ জমে।

আমি তখন স্কুলের ছাত্র। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরতে যাব—কীভাবে? চারপাশের সবাই তো প্রতিদিন বিলে মাছ ধরছে। সহপাঠীরা কাতলা, শোল, বোয়াল, পুঁটি, ট্যাংরা, কই, মাগুর শিং—কী যে ধরত! এসব শোনার পর আর নিজের চোখে দেখার পর মাথা ঠান্ডা করে লেখাপড়া করা অসম্ভব।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

তাই একদিন সকালে বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার সাজে বের হয়ে পাশের বন্ধুর বাড়িতে বইখাতা রেখে ইছামতীর বিলে পলো নিয়ে হাজির হলাম। যেতে যেতে ভীষণ টেনশন হচ্ছিল—বিকেলে মা টের পাবেন, কপালে কী আছে আজ! বাবা চাকরির সুবাদে তখন শহরে থাকতেন। ঘরের সবকিছু সামলাতে হতো শুধু মাকেই। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, দায়িত্বশীল ও আদর্শ নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পাশে থেকে দেখেছি—কীভাবে তিনি এলাকার অশিক্ষিত নারীদের রাতের অন্ধকারে টেনে এনে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন। নেতৃত্বে ছিলেন অনন্য, চরিত্রে দৃঢ়, আর আদর্শে কঠোর। কোথায় কী করি, সব খবরই তিনি পেয়ে যেতেন। কারণ, গ্রামের সবাই আমাদের পরিবারের দিকে নজর রাখত। বড় ভাই তখন দুইবার বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছাত্র, ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন সরকারি বৃত্তি নিয়ে—এলাকার মানুষের চোখে এক অনুপ্রেরণা। তাই আমাদের পরিবার ছিল সবার আড়ালে–আবডালে আলোচনার বিষয়।

যা–ই হোক, বিলে গিয়ে পলো ফেলতেই অনেকেই অবাক—স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসেছি দেখে! তবু সবাই মজা পেয়েছিল। গ্রামে তো সবাই আত্মীয়স্বজন। তারও প্রধান কারণ—আমার বাবার বাবা এবং নানা দুজনের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। সেজন্য সম্পর্কে ভাই ছাড়াও কারও কাছে আমি ভারবেটা, আবার কারও কাছে নাতি।

পলো দিয়ে মাছ ধরার নিয়ম হলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ফেলা। মাছ ধরা পড়লে হাত ঢুকিয়ে ধরা লাগে। বড় মাছ হলে পুরো পলোসহ তুলতে হয়। সেদিন আমার জীবনে ঘটল বিরাট ঘটনা।

এক বিশাল মাছ ধরা পড়ল আমার পলোর মধ্যে। মনে হলো, পলো ভেঙে যাবে! হাত ঢুকিয়ে দেখি—মাথা এত মোটা যে ঠিকমতো ধরাই যাচ্ছে না। পাশেই সম্পর্কে এক চাচা ছিলেন। তিনি বললেন, ‘খোলসের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ধরে রাখো, তারপর পুরো পলোসহ তোলো।” তার নির্দেশমতো করতেই মাছ উঠে এল—বিরাট এক রুই!

স্কুল ছুটির কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরলাম। মা আমার গায়ে কাদা দেখে প্রশ্ন করলেন, ঘটনা কী। তারপর মাছ দেখে সব বুঝে গেলেন—আজ ছেলে স্কুল ডাব্বা মেরে বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিল!

আজ আমি সুইডেনের এক গ্রামে বসবাস করি। নবগঙ্গার মতো একটি হ্রদ আছে আমার বাড়ির পাশে। আর সামনের দিকেই বাল্টিক সাগরের উপশাখা—যাকে এখানে বলা হয় ম্যালারেন। চারপাশজুড়ে বিস্তৃত কৃষিখেত। আমি এখানে সামারে একটি কৃষি খামার গড়ে তুলেছি, যেখানে বিদেশি আর দেশি শাকসবজি উৎপাদন করি সুইডিশদের সঙ্গে। সবটাই করি সম্ভবত শৈশবের মধুর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য! তবে এত কিছুর পরও কেন যেন মনে হয়—হোম সুইট হোম।