ডিগ্রিধারী বেকার, সার্টিফিকেটের দেশে কর্মসংস্থানের সংকট!

বেকারফাইল ছবি

রিমা একসময় বড় স্বপ্ন দেখত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ভেবেছিল একদিন কোনো বহুজাতিক ব্যাংকে চাকরি করবে। মা–বাবার গর্ব, আত্মীয়স্বজনের ঈর্ষার কারণ হবে। কিন্তু সনদ হাতে পাওয়ার পর থেকে গত দুই বছর তাঁর দিন কাটছে চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজে, সিভি পাঠিয়ে আর ইন্টারভিউতে গিয়ে ‘আমরা আপনাকে জানাব’ শুনে। এমন গল্প শুধু রিমার নয়, বাংলাদেশের অনেক পরিবারের।

ডিগ্রির বন্যা, চাকরির খরা—

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ দশমিক ৫ লাখ তরুণ উচ্চশিক্ষা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। কিন্তু চাকরির বাজার সেই হারে বিস্তৃত হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে বেকার বা আন্ডারএমপ্লয়েড—অর্থাৎ তারা হয় কাজ পাচ্ছে না, নয়তো নিজের যোগ্যতার তুলনায় অনেক নিচু পর্যায়ে কাজ করছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে অবিশ্বাস্য হারে। সনদ দেওয়া এখন অনেকটা ফাস্টফুডের মতো হয়ে গেছে—সব জায়গায় সহজলভ্য, কিন্তু পুষ্টি কম। চার বছরের কষ্টসাধ্য পড়াশোনা শেষে যখন সনদ হাতে আসে, তখন দেখা যায় বাজারে তার মূল্য কয়েক টাকার ফ্রেমের মতোই।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

শিক্ষা বনাম দক্ষতা: দূর সম্পর্কের আত্মীয়

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের সম্পর্ক অনেকটা সেই বিখ্যাত ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়’-এর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হয় তত্ত্ব, কিন্তু চাকরির বাজার খোঁজে দক্ষতা। ফলাফল—একজন ম্যানেজমেন্ট গ্র্যাজুয়েট ইন্টারভিউতে গিয়ে ‘লিডারশিপ কী?’ প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘টিম মিলে ওয়ার্ক করা।’ তারপর নিয়োগদাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকজন প্রার্থীকে ডাকে।

প্রযুক্তি, হেলথকেয়ার, টেক্সটাইল বা আইটি—এসব খাতে কিছু চাকরির সুযোগ থাকলেও সেখানে মজুরি কম, কাজের চাপ বেশি, আর পদোন্নতির গতি কচ্ছপের চেয়েও ধীর। আর ভোকেশনাল কাজকে আমরা সমাজে এমনভাবে দেখি, যেন তা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ পেশা। ফলে তরুণেরা হাতে ডিগ্রি নিয়ে বসে থাকে, আর বাজার খুঁজে পায় দক্ষতার ঘাটতি।

বেকারত্ব
প্রতীকী ছবি

বিদেশে ডিগ্রির চেয়ে দক্ষতার দাম

বিদেশে কিন্তু সমীকরণ অন্য রকম। সেখানে দক্ষতাকে ডিগ্রির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যে তরুণ বাংলাদেশে ‘ফ্রিল্যান্সার’ পরিচয়ে হেয়প্রতিপন্ন হয়, বিদেশে গিয়ে একই কাজে পরিচিত হয় ‘আইটি কনসালট্যান্ট’ হিসেবে। আর বেতনও পায় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এই বৈপরীত্যই বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালেই প্রায় ৫২ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র বিদেশে পড়তে গেছে—২০০৮ সালের তুলনায় তা তিন গুণেরও বেশি। অনেকে পড়াশোনা শেষে আর দেশে ফেরে না। ফলে দেশে বাড়ছে রেমিট্যান্স, কিন্তু খালি হচ্ছে অফিস আর গবেষণাগার।

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ কেবল প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, কিন্তু স্থানীয় শিল্পে উদ্ভাবন, দক্ষ কর্মশক্তি আর নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ আরও কমে যাবে। তখন দেশের অফিসগুলোয় থাকবে কেবল বয়সী ম্যানেজার, আর তরুণদের সবচেয়ে বড় ভিড় দেখা যাবে এয়ারপোর্টের প্রস্থান লাইনে।

সমাধান হবে কিসে—

কথার ফুলঝুড়ি নয়, কার্যকর পদক্ষেপ—এই সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন কাগজে-কলমে নীতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপ।

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যেন পড়াশোনা বাজারের চাহিদার সঙ্গে মেলে।

ভোকেশনাল দক্ষতার মর্যাদা: দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণকে দ্বিতীয় শ্রেণির নয়, প্রথম সারির কর্মপথ হিসেবে দেখা দরকার।

ব্যবসায় পরিবেশ সহজ করা:  উদ্যোক্তাদের জন্য লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে হবে, যাতে তারা চাকরি খুঁজে দেওয়ার বদলে নতুন চাকরি তৈরি করতে পারে।

ন্যায্য মজুরি ও সুযোগ: তরুণদের এমন বেতন ও পরিবেশ দিতে হবে যাতে দেশে থাকা মানে আত্মত্যাগ নয়, বরং আত্মপ্রকাশ হয়।

বাংলাদেশে তরুণেরা কেবল সংখ্যা নয়—তারা ভবিষ্যতের চালিকা শক্তি। যদি এই শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারি, তবে ডিগ্রি থাকবে, সনদ থাকবে, কিন্তু থাকবে না কর্মসংস্থান। তখন আমাদের সবচেয়ে বড় শিল্প হয়ে উঠবে ‘বেকার তৈরি করা।’ সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যদি এখনই শিক্ষা ও শ্রমবাজারকে একসঙ্গে নিয়ে এগোনো যায়, তবে ‘ডিগ্রিধারী বেকার’ ট্যাগলাইন হয়ে যাবে না। না হলে হয়তো একদিন আমরা বিশ্বকে পরিচয় দেব—‘আমরা বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত বেকার জাতি।’

লেখক: হাসিবুর রহমান।