দাসপ্রথার ইতিহাস, ব্রিটিশ নৈতিকতা ও অপরাধের দায়বদ্ধতা
ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হলো ট্রান্স–আটলান্টিক দাস বাণিজ্য, যার ফলে কালো চামড়ার লক্ষ লক্ষ মানুষকে আফ্রিকা থেকে জোরপূর্বক আমেরিকা ও ইউরোপে বিক্রি করা হয়েছিল। ট্রান্স–আটলান্টিক দাসপ্রথার ব্যাপ্তিকাল ছিল আনুমানিক ১৬ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত, প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলে এই ঘৃণিত প্রথা। মূলত ১৫ শতকের শেষভাগ থেকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা, বিশেষ করে ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ডাচ ও স্প্যানিশরা, আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে তাঁদের আমেরিকা ও ইউরোপের উপনিবেশগুলোয় নিয়ে যেত।
দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক আন্দোলন এবং প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের শেষের দিকে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, ব্রিটেন ও আমেরিকায় দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে, যা পরে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করে। ব্রিটেনে ১৭৮৭ সালে উইলিয়াম উইলবারফোর্স এবং থমাস ক্লার্কসনের মতো ব্যক্তিরা Society for Effecting the Abolition of the Slave Trade প্রতিষ্ঠা করেন, যা দাসপ্রথা বিলুপ্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৮০৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করে, তবে দাসত্বের সম্পূর্ণ অবসান ঘটে ১৮৩৩ সালে Slavery Abolition Act পাসের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে, দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন (Abolitionist Movement) ১৮ ও ১৯ শতকের শুরুতে তীব্র আকার ধারণ করে। ফ্রেডরিক ডগলাস, হ্যারিয়েট টাবম্যান, উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসনসহ অনেক নেতা দাসপ্রথা বাতিলের জন্য লড়াই করেন। গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬৫ সালে ১৩তম সংশোধনী (Thirteenth Amendment) পাশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, দাসপ্রথা এবং দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করার জন্য প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে। ১৯২৬ সালে League of Nations দাসপ্রথা বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে একটি কনভেনশন গৃহীত করে এবং পরে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights-এ দাসত্ব নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
আধুনিক বিশ্বে ব্রিটেনের ট্রান্স–আটলান্টিক দাসপ্রথায় ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি ১৯৯০-এর দশক থেকে দৃশ্যমান হতে শুরু করে এবং ২০০০ সালের পর আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এই দাবি তোলার পেছনে ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব এবং দাসপ্রথার ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন, বিশেষ করে ক্যারিবীয় ও আফ্রিকান দেশগুলোয়। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন হিউম্যান রাইটস-এ দাসপ্রথাকে একটি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি ওঠে। এরপর ২০০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের World Conference Against Racism-এ দাসপ্রথা ও ঔপনিবেশিকতার জন্য ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলোকে দায়ী করে ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জোরালো হয়। ২০০৬ সালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ট্রান্স–আটলান্টিক দাসপ্রথাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেন, তবে তিনি ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এরপর থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো ব্রিটেনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করে আসছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিপীড়ন এবং লুটতরাজের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক ব্রিটেনের অর্থনৈতিক ভিত্তি। ব্রিটেনের আজকের এই পাথুরে অর্থনীতি গড়ে উঠেছে আফ্রিকান দাসদের রক্ত ও শ্রমের ওপর। তবে আগামী সপ্তাহে (২৫-২৬ অক্টোবর) সামোয়ায় অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ সম্মেলনে দাসপ্রথায় ব্রিটেনের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বা ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট। ব্রিটেনের বর্তমান লেবার সরকার দাসপ্রথার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের অফিশিয়াল মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, স্টারমার সম্মেলনে উপস্থিত থেকে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যৌথ চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ নিয়ে আলোচনা করবেন। অথচ এমন এক ঐতিহাসিক সত্যিকে অস্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোর অর্থ হলো, ব্রিটেন তাদের নৈতিক দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ সরকারের এই পদক্ষেপ উপনিবেশের শিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। যুক্তরাজ্য দেশটির অভ্যন্তরে এবং অন্যান্য দেশ থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখোমুখি রয়েছে। বিখ্যাত কবি উইলিয়াম কুপার, যিনি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘The Negro's Complaint’-এ উল্লেখ করেছিলেন:
“Why, why, is this difference made,
If God and nature made us all?
Is it lawful to enslave the free,
And trample freedom into dust?”
কুপারের এই লাইনগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতা এবং স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। আফ্রিকান জনগণকে যারা দাস বানিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিল, তারা শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং একটি জাতির অপরাধ হিসেবেই অপরাধী। অথচ বর্তমান ব্রিটিশ সরকার তাদের পূর্ববর্তী সরকারের মতোই দায় অস্বীকার করে যাচ্ছে, ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রশ্ন তুলতেই তারা অপারগ।
উপনিবেশবাদের মূল চালিকা শক্তি ছিল শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ। দাসপ্রথা ছিল সেই শোষণব্যবস্থার সবচেয়ে নিষ্ঠুর উদাহরণ। আধুনিক পৃথিবীতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও এর প্রভাব এখনো অনুভূত হয়। আফ্রিকান জনগোষ্ঠী এবং তাদের উত্তরসূরিরা আজও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে এই শোষণের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমা না চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ না দেওয়া শুধু অমানবিকই নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নৈতিক সংকট তৈরি করছে।
কমনওয়েলথভুক্ত অনেক দেশই দাসপ্রথার শিকার হয়েছিল। আফ্রিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অন্য অঞ্চলের দেশগুলো উপনিবেশবাদের ফলে তাদের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি এবং সম্পদ হারিয়েছে। এমনকি আজও এই দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, মানবাধিকার রক্ষায় এবং সামাজিক পরিবর্তনে অবরত সংগ্রাম করছে। কমনওয়েলথ সম্মেলন এসব ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য একটি মঞ্চ হতে পারে, যেখানে ব্রিটেন তাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতে পারত।
আসন্ন সম্মেলনে নতুন সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচন করা হবে। তিন (ঘানা, গাম্বিয়া, লেসোথো) প্রার্থীর সবাই দাসপ্রথা ও ঔপনিবেশিক শাসনে লিপ্ত দেশগুলোর কাছ থেকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা অন্য কোনো ধরনের ‘পুনর্বাসনমূলক ন্যায়বিচার’–এর পক্ষে জোরালো সমর্থন করেছেন। তাঁরা চাচ্ছেন, যারা ইতিহাসে এই অন্যায়ের জন্য দায়ী, তাদের যেন দায়বদ্ধ করা হয়। তবে ব্রিটেন তার নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করছে না; এটি তাদের পূর্ববর্তী সরকারের নীতির পুনরাবৃত্তিমাত্র।
রাজা তৃতীয় চার্লস কেনিয়ার ঔপনিবেশিক নিপীড়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু ক্ষমা চাননি। ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি ব্রিটিশ মন্ত্রীদের অনুমোদন সাপেক্ষ ছিল। অথচ ক্ষমা চাওয়া এবং দায় স্বীকার করা হতে পারত একটি নতুন সম্পর্কের সূচনা। ক্ষমা মানেই ইতিহাসের ভুল মুছে ফেলা নয়; বরং এটি হতে পারে ইতিহাসের অপরাধকে স্বীকার করে ভবিষ্যতে সম্পর্ক গঠনের ভিত্তি স্থাপন করা। কবি কুপারের মতো বহু কবি এবং লেখক দাসপ্রথার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কুপারের ‘The Negro's Complaint’ কবিতায় তিনি আরও লিখেছেন:
“I tread the path the Negro trod;
I view him with a brother’s eye.
I see him labouring at the oar,
I hear his anguish, hear his sigh.”
এই পঙ্ক্তিগুলোতে কুপার দেখিয়েছেন, মানবিক চেতনায়, আমরা সবাই সমান। দাসপ্রথা শুধু এক জনগোষ্ঠীকে নয়, মানবতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ব্রিটেন যদি এই মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে সম্মান না জানায়, তবে এটি কেবল রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং এটি মানবাধিকারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রশ্নবিদ্ধতা প্রকাশ করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রিটেন যদি প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্ব দিতে চায়, তবে তাদের ইতিহাসের দায় মেনে নিয়ে দাসপ্রথার শিকার দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবা উচিত। চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা ইতিমধ্যেই তাদের সংশ্লিষ্টতা মেনে নিয়ে পুনর্বাসনমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি প্রমাণ করে, যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে, তবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ব্রিটিশ সরকারের উচিত এই উদ্যোগগুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে, দেশ হিসেবে একটি সত্যিকার ক্ষমা এবং পুনর্বাসনের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসা। শেষমেশ, কবি উইলিয়াম কুপারের মতো কণ্ঠস্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং মানবতার পক্ষে কথা বলার কোনো বিকল্প নেই, নেই কোনো ভৌগোলিক গণ্ডি। ব্রিটেনের অতীতের ইতিহাসের দায় স্বীকার করা এবং দাসপ্রথার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া মানে হলো, ব্রিটেন একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক সম্পর্কের সূচনা করতে প্রস্তুত। তা না হলে, ব্রিটেন তার নৈতিকতা এবং নেতৃত্বের যোগ্যতা দুটি হারাবে বিশ্বমঞ্চে।