‘ভিআইপি’যেভাবে হলাম!

আমাদের দেশের কথিত ভিআইপিদের জন্য জল, স্থল ও আকাশপথের যানবাহনকে অপেক্ষা করতে দেখে অভ্যস্ত এই আমার জন্যই যখন বিমান অপেক্ষা করে, তখন নিজেকে সত্যি সত্যিই ‘ভিআইপি’ বলে মনে হয়। আর বিদেশের মাটিতে বলে ভিআইপির আগে একটা অতিরিক্ত ‘ভি’ লাগিয়ে ‘ভিভিআইপি’ করে দিলেও কুচ পরোয়া নেহি!

ঘটনার কারণ হলো যে আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকয়াভিক থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ফেরার পথে দুটি ট্রানজিট ছিল। প্রথমটি নরওয়ের রাজধানী অসলো আর দ্বিতীয়টি ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি। ট্রানজিটের সময়ও ছিল খুব কম। সরাসরি ফ্লাইট যদিও ছিল, তবে সময় মেলাতে না পারায় আর পরদিন অফিসে মিটিং থাকায় ওই দিনই আমাকে ফিরতে হবে বলে বেশি পয়সা দিয়ে ঘুরপথে আসতে হয়েছে। ভ্রমণ দুটি আলাদা বিমানে হলেও টিকিট কিনেছি ফিনএয়ার থেকে। ফিনল্যান্ডের পতাকাবাহী এই ফিনএয়ার ভরসা করার মতোই বিমান সংস্থা।

রিকয়াভিক থেকে রওনা দেওয়ার সময় বিমান ঠিক সময়ে ছেড়ে ঠিক সময়েই অসলোতে এসেছে। তবে অসলো থেকে যে বিমানে হেলসিংকি যাব, সেটা এসে পৌঁছেছে দেরি করে। এরপর যাত্রী নামিয়ে নতুন যাত্রী উঠিয়ে বিমান ছাড়তে আধা ঘণ্টার মতো দেরি হয়। হেলসিংকি থেকে আমার কানেকটিং ফ্লাইটের ট্রানজিট সময় মাত্র ৪০ মিনিট। এই বিমান আধা ঘণ্টা দেরি করায় এখন মাত্র ১০ মিনিটে এক বিমান থেকে নেমে অন্য গেটে গিয়ে আরেক বিমানে ওঠাটা ‘না মুনকিন না হলেও মুশকিল বটে’। বলে রাখা ভালো, যে বিমান ছাড়ার মিনিট দশেক আগেই সাধারণত বোর্ডিং গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। কি আর করা, মনে উদ্বেগ নিয়েই বিমানের সিটে গিয়ে বসলাম। বিমানে ওঠার সময় একবার অবশ্য মনে হয়েছিল যে ক্যাপ্টেনকে গিয়ে বলি ‘একটু জোরে টেনে যাবেন, না হলে কানেকটিং ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’ আমাদের দেশে দূরপাল্লার বাসে অনেকেই তো এ রকম বলে। বুঝিয়ে বললে তাঁরাও নিশ্চয় কনসিডার করবে। শেষে ভাবলাম, থাক, নিজের বাঙালপনা বিদেশিদের কাছে খোলাসা করে কি লাভ!

বিমান ওড়ার অনেকক্ষণ পর কেবিন ক্রুদের কাজের চাপ কমে গেলে আমি একজনকে গিয়ে আমার কানেকটিং ফ্লাইট মিস হওয়ার আশঙ্কার কথা জানালাম। ভদ্রমহিলা মুঠোফোনের অ্যাপে দেখে জানাল যে অন্য বিমানের গ্রাউন্ড স্টাফ যেহেতু জানে যে আমি এই বিমানেই আসছি, তাই তাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও আমার জন্য বোর্ডিং গেটে অপেক্ষা করবে। এরপর বোর্ডিং গেটগুলোর নম্বর চেক করে জানাল, যে দুই গেটের দূরত্ব যেহেতু অনেকখানি, তাই নেমে দৌড়ে গেলে হয়তো বিমানের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই আমি বোর্ডিং গেটে পৌঁছাতে পারব। এরপর ভদ্রমহিলা হেলসিংকি বিমানবন্দরে আমার বোর্ডিং গেটে যাওয়ার দিকনির্দেশনা বুঝিয়ে দিলেন। চেক-ইন ল্যাগেজের কথা জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিলেন যে আমি উঠতে পারলে আমার ল্যাগেজও ঠিকই উঠে যাবে।

এরপর আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম, এখানে আমার সিট যেহেতু বিমানের মাঝামাঝি, তাই লাইন ধরে নামতে কিছুটা দেরি হবে। এখন যদি এর কোনো বিহিত করা যায়। তিনি আমাকে সিটে গিয়ে বসতে বলে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটু পরে এসে আমাকে বিমানের একবারে সামনে, অর্থাৎ বিজনেস ক্লাসে নিয়ে বসাল। যাক, ফ্লাইট মিস হওয়ার দুশ্চিন্তার মধ্যেও কিছুটা বাড়তি আরাম পাওয়া গেল।

যাহোক, বিমান ল্যান্ড করার পর গেটে যাওয়া, বোর্ডিং ব্রিজ লাগানো, গেট খোলা ইত্যাদির শেষ হওয়ার পর আমি বিমান থেকে সবার আগে নেমেই নাক বরাবর দৌড় দিলাম। কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড় আর জোরে হাঁটা। এর মধ্যে একবার অবশ্য মনে হলো যে আস্তে গেলেও চলে, তাঁরা তো জানেই যে আমি আসছি, থাকুক না একটু অপেক্ষা করে। পরে ভাবলাম যে বিমানবোঝাই যাত্রী নিয়ে খামাখা একজনের জন্য অপেক্ষা করার কোনো মানে হয়? একটু দৌড়ালে কী হবে, দৌড় তো স্বাস্থ্যর জন্যও উপকারী।

এভাবে এক থেকে দেড় কিলোমিটার দৌড় ও জোরে হাঁটার পর নির্ধারিত গেটে গিয়ে উপস্থিত হয়ে তারপর থামি। কাঁটায় কাঁটায় উড়োজাহাজ ছাড়ার সময়ের সামান্য কয়েক সেকেন্ড আগে বোর্ডিং গেটে পৌঁছে দেখি আমাকে স্বাগত জানাতে তখনো একজন গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই ভদ্রমহিলার প্রথম কথা, ‘একটু দম নাও, এরপর সোজা নিচতলায় নেমে বিমানে গিয়ে ওঠো।’ আমিও সুবোধ বালকের মতো ধীরে সুস্থে বিমানে গিয়ে উঠলাম। যাওয়ার পথে অবশ্য সেলফিটা তুলতে ভুল হয়নি।

আমিই ছিলাম তাঁদের শেষ যাত্রী। বিমানে উঠে ধীরস্থির হয়ে বসার পরও ছাড়ছে না দেখে মনে হলো আমার দৌড়াদৌড়িটা কি তাহলে খামাখাই হলো। অবশ্য মিনিট দুয়েক পরই ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন যে একটা লাগেজের জন্য কিছুটা দেরি করতে হচ্ছে। সেটা এলেই বিমান ছেড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হবে।

এতক্ষণ নিজে ভিআইপিভাবে থাকলেও ঘোষণাটা শুনে সেই ভাব চুপসে গেল। শেষে কিনা আমার চেয়ে আমার লাগেজই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো? মালিক নিজে দৌড়ে এসে বিমান ধরল, অথচ তাঁর লাগেজের জন্যই কিনা এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অর্থাৎ মালিক এখন হয়ে গেল শুধু পি। অর্থাৎ পাবলিক, আর তার লাগেজ হয়ে গেল ভিআইপি। একেই বলে সূর্যের চেয়ে বালু গরম, কামলার চেয়ে আমলা!