বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫: সাংবাদিকতার অগ্রগতি ও আশঙ্কা
প্রতিবছর ৩ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। এটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয়, বরং মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো ১৯৯৩ সালে দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়—প্রেসের স্বাধীনতা, তথ্যের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষার প্রশ্নে এ দিবসটি আজ বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিকতা কোন পথে?
সাংবাদিকতা আজ বৈশ্বিকভাবে বহুমাত্রিক সংকটের সম্মুখীন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, করপোরেট নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তিগত হুমকি ও ডিজিটাল সেন্সরশিপ—এসব চ্যালেঞ্জ স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)-এর ২০২৫ সালের বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা সূচক বলছে, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকেরা হত্যার হুমকি, গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। এই বাস্তবতা শুধু স্বৈরাচারী রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক বলয়েও বিদ্যমান। ফলে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ২০২৫ রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্রের পতন, বাংলাদেশের অগ্রগতি
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের সূচকে ৫৭তম স্থানে নেমে এসেছে, যা তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ক্রমহ্রাসমান অবস্থা এর জন্য দায়ী।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ১৬ ধাপ অগ্রগতি অর্জন করে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম স্থানে উঠে এসেছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম। আরএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাঁচটি সূচকে—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত, সামাজিক ও নিরাপত্তা, সব ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছে। দেশের স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৭১।
এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক বার্তা। বিশেষ করে যখন প্রতিবেশী ভারত (১৫৯তম) ও পাকিস্তানের (১৫২তম) চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাস্তবতা কিন্তু সতর্ক করে
আরএসএফ রিপোর্টে বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদের পাশাপাশি উদ্বেগও তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সাংবাদিকদের ওপর ৩৯৮টি হামলা, হুমকি বা হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসেই ঘটেছে ৮২টি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়ে সাংবাদিকদের প্রতি সহনশীলতার অভাব প্রকট আকারে ধরা পড়েছে।
তা ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অনলাইন নজরদারি এবং রাজনৈতিক সংবেদনশীল প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেপ্তারের প্রবণতা সাংবাদিকদের আতঙ্কিত করে তুলেছে। ফলে সূচকে উন্নতির পরও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এখনো চ্যালেঞ্জিং।
২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য: Press for the Planet
চলতি বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘Press for the Planet: Journalism in the Face of the Environmental Crisis’। এ থিমটি ইঙ্গিত দেয়, পরিবেশ সংরক্ষণে সাংবাদিকদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, বন উজাড় ও প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে তথ্যনির্ভর প্রতিবেদন শুধু জনসচেতনতা নয়, রাষ্ট্রীয় নীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরএসএফের রিপোর্ট যেমন কিছু স্বস্তি দিয়েছে তেমনি মনে করিয়ে দিয়েছে ‘স্বাধীনতা’ কেবল সূচকে উন্নতির মানদণ্ড নয়, এটি সাংবাদিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্ন।
একটি জাতির গণতন্ত্র ও উন্নয়ন কতটা গভীর, তা নির্ভর করে ওই জাতির সাংবাদিকেরা কতটা স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে পারেন তার ওপর। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস তাই কেবল এক দিনের প্রতীক নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের বিবেকের মুখোমুখি হওয়ার দিন।