আলহামরা: স্পেনে মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন-শেষ পর্ব

ছবি: লেখকের পাঠানো

আমরা মারবেলা থেকে গ্রানাডার উদ্দেশে রওনা হলাম। কিন্তু সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। রাস্তাটি একটি স্প্যানিশ জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে উঠে গিয়েছিল এবং অবশেষে রোন্ডা শহরের মনোরম দৃশ্য দেখা গেল। এটি একটি প্রাচীন শহর, যা অসুবিধাজনকভাবে ১০০ গজেরও বেশি গভীর নদী গিরিখাত দ্বারা বিভক্ত। গিরিখাতের দিকে তাকালে মনে হয় আরও গভীর। সুবিধাজনকভাবে, রোন্ডার দুই পাশকে সংযুক্ত করে তিনটি সেতু গিরিখাতজুড়ে বিস্তৃত। একটি, রোমান সেতু, প্রথম রোমান সময়ে নির্মিত হয়েছিল। আমি সেখানে গিয়ে দেখতে চাই যে তারা কীভাবে সেতুটি তৈরি করেছিল।

গ্রানাডার মতো, যেখানে আমরা দিনটি শেষ করব, রোন্ডা শহরের সঙ্গে অনেক সাহিত্যিকের সংযোগ রয়েছে। এর ষাঁড়ের লড়াইয়ের বলয়, গ্রীষ্মকালে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের, সে সঙ্গে পরবর্তীকালে অরসন ওয়েলস এবং তার আগে বিখ্যাত জার্মান কবি রেইনিয়ার মারিয়া রিল্কের প্রিয় জায়গা রোন্ডা। আমাদের ট্যুর গাইড আশা করে, যদি সে লটারি পায়, তাহলে এক দিন রোন্ডায় বাস করবে। আমরা ষাঁড়ের লড়াইয়ের জাদুঘর ঘুরে দেখলাম এবং তারপর শহর ঘুরে দেখলাম এবং গিরিখাতের ধারে অবস্থিত একটি বাসস্থান পরিদর্শন করলাম, যা ছিল অসাধারণ।

বিকেলের শেষ নাগাদ আমরা দক্ষিণ স্পেনীয় শহর গ্রানাডায় নেমে এলাম। এটি স্পেনের সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পাদদেশে একটি উর্বর অববাহিকায় অবস্থিত। আইবেরিয়ার বেশির ভাগ শহরের মতো রোমান আমলের বসতি। ১৪৯২ সালে গ্রানাডায় ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার হাতে আসে শেষ মুরিশ রাজ্য। গ্রানাডার আমির শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন। তার শর্তাবলিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল যে গ্রানাডার মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস বজায় রাখতে পারবে। আট বছর পর এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয় ও খ্রিস্টান বনাম মুসলিম দ্বন্দ্বের তিক্ততাকে বাড়িয়ে তোলে। গ্রানাডায় আমাদের আগমনের রাতটি ছিল স্পেনে আমার একমাত্র খারাপ খাবার, অতিরিক্ত লবণযুক্ত পায়েলা। আমি ভালো খাবার বানাতে পারি এবং আমি একজন স্থানীয় স্প্যানিয়ার্ডের তৈরি পায়েলা খেয়েছি। কিন্তু এই পায়েলা ছিল একটি প্রহসন।

আজ গ্রানাডা এক আধুনিক শহর, যদিও ঐতিহাসিক জেলাগুলো রয়েছে। আমার বিশ্বাস, একসময় বর্তমান অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলোর পরিবর্তে সবুজ খামাররে ভূদৃশ্যে শোভিত ছিল। তবে, পাঁচ শ বছরেরও বেশি সময় ধরে আলহামরা আধিপত্যপূর্ণ এক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।

স্পেনের রাজা-রানী ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ গ্রানাডা এবং আলহামরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। পূর্বে তারা পবিত্র শহর টলেডোতে তাদের শেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে বিবেচিত করেছিলেন, কিন্তু আলহামরার জাঁকজমক এবং মহিমা দেখে তারা সেখানে সমাহিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আজ তাদের দেহাবশেষ গ্রানাডার রয়েল চ্যাপেলে পুরাতন শহরের কেন্দ্রস্থলে গ্রানাডার ক্যাথেড্রালের পাশে অবস্থিত।

ছবি: লেখকের পাঠানো

আলহামরা কী?

এটি স্পেনের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। ৩৫ একরজুড়ে দেয়ালের ভেতর রয়েছে একটি মুরিশ দুর্গ, রাজা পঞ্চম চার্লসের প্রাসাদ, বিস্তৃত বাগান এবং মুকুট রত্ন, মুরদের দ্বারা নির্মিত তিনটি নাসরিদ প্রাসাদ রয়েছে। আমি এগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করব না; কারণ, আমার কাছে এগুলো বিচার করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই।

আলহামরার সাম্প্রতিক অতীত, অর্থাৎ গত আড়াই শ বছর ধরে, আকর্ষণীয়। স্পেনে নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় ফরাসিরা আলহামব্রার দখল করেছিল। স্পেন এবং পর্তুগালের অন্য জায়গার মতো, তারা সবকিছু লুট করে নিয়েছিল এবং আলহামরা ক্ষেত্রে কিছু অংশ উড়িয়ে দিয়েছিল। ভিটোরিয়ার যুদ্ধে ডিউক অফ ওয়েলিংটনের বিজয়, যে যুদ্ধে অবশেষে ফরাসিরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, তার আংশিক কারণ ছিল লুটপাটের বিশাল ওয়াগন ট্রেনের কারণে ফরাসিদের প্রস্থান ধীর হয়ে যায়। এরপর আলহামব্রার জন্য দুঃখজনক সময় আসে, যার ফলে এটি ভেঙে পড়ে।

আলহামব্রা পুনরুত্থানের আংশিক কারণ রোমান্টিক আন্দোলনের লেখক এবং কবিরা। লর্ড বায়রন আলহামব্রা সম্পর্কে একটি কবিতা লিখেছিলেন। আলহামব্রায় তিন মাস বসবাসের পর ওয়াশিংটন আরভিং একটি জনপ্রিয় বই, ‘টেলস অফ আলহামব্রা’ লিখেছিলেন। স্পেন সম্পর্কে তাঁর অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে এই বইটিও মুসলিম ঐতিহ্য প্রচারে অনেক অবদান রেখেছে।

আজ ওয়াশিংটন আরভিং মূলত তাঁর ছোট গল্প ‘দ্য লেজেন্ড অফ স্লিপি হলো’ এবং এর মাথাবিহীন ঘোড়সওয়ারের জন্য পরিচিত। তবে, আরভিং ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে প্রশংসনীয় এবং বিখ্যাত আমেরিকান লেখকদের একজন এবং একজন কূটনীতিক এবং স্পেনের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন।

আরও পড়ুন

প্রায় এই সময়েই স্প্যানিশরা আলহামরা সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের জন্য বহু দশক ধরে প্রচেষ্টা শুরু করে। তাদের প্রচেষ্টার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। আলহাম্ব্রা প্রাতঃরাশ ভ্রমণের পর, আলহাম্ব্রা প্যালেস হোটেলের বারান্দায় একটি মনোরম মধ্যাহ্নভোজ করেছি। আমাদের টেবিলটি আমাদের শহরের একটি মনোরম দৃশ্য দিয়েছে। সেই সন্ধ্যায় বিনোদনের জন্য আমরা একটি প্রাণবন্ত ফ্ল্যামেনকো নৃত্য এবং সংগীত প্রদর্শন উপভোগ করেছি।

রাজা পঞ্চম চার্লসের প্রাসাদ চত্বরে বসে ‘টেল্স অব আলহামরার’ কথা ভাবতে ভাবতেই আনিকা তার দলবল নিয়ে হাজির হলেন। এবার আমরা ভেতরে যাব। ট্যুরিস্ট ব্যুরো আমাদের টিকেট আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, জনপ্রতি ১২ ইউরো। আমরা যার যার টিকেট স্ক্যান করে ভেতরে এলাম। বিশাল এক কমপ্লেক্স। আমাদের দলটিকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হল, একটি সুইডিশ গাইডে সুইডিশ গ্রুপ অন্যটি ইংলিশ গাইডের গ্রুপ, আমরা একটু বৈচিত্র্যের আশায় ইংলিশ গ্রুপে ঢুকে গেলাম। গাইড চমৎকার ধারা বিবরনীতে আলহামরার ইতিহাস, গঠন প্রণালি, মুসলিম শিল্পকর্ম তুলে ধরলেন। পুরো কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখতে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো লাগে। আমরা প্যালেস অব লায়ন্স, পোর্টাল প্যালেস ও কোমারেস প্যালেস, হল অব দ্য কিংস, কোর্ট অব লং পন্ডস, কোর্ট আব মীরলেস দেখে অবশেষে এলাম ঐতিহাসিক ‘হল অফ অ্যাম্বাসেডর–এ’।

প্রায় দুই শ বছর আগে এই হলে এসেছিলেন ‘টেলস অব আলহাম্বিরা’র লেখক ওয়াসিংটন আরভিং। তিনি যা দেখেছিলেন তার অনেক কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তিনি লিখেছেন, অ্যাম্বাসেডরদের হলের প্রবেশপথ দেয়াল ধরে নিজেকে পথ দেখিয়ে নিচের দিকে একটি ছোট দরজার কাছে পৌঁছাই, দরজা খুলে যাওয়ার পর, হঠাৎ আমি হল অফ অ্যাম্বাসেডরসের উজ্জ্বল প্রবেশদ্বারে প্রবেশ করে চমকে উঠলাম; প্রবেশদ্বারটি একটি মার্জিত গ্যালারি দ্বারা প্রাসাদ থেকে পৃথক করা হয়েছে, যা মরিস্কো স্টাইলে খোলা কাজের স্প্যান্ড্রেলসহ সরু স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত। পূর্ব কক্ষের প্রতিটি প্রান্তে আংশিক ঘেরা স্থান রয়েছে এবং এর সিলিংটি সমৃদ্ধভাবে চুনকাম করা হয়েছে। একটি দুর্দান্ত প্রবেশপথ পেরিয়ে আমি নিজেকে সুপরিচিত ‘হল অব অ্যাম্বাসেডার্সে’ আবিষ্কার করলাম, যা মুসলিম রাজাদের শ্রোতা কক্ষ। বলা হয় এটি ৩৭ ফুট বর্গক্ষেত্র এবং ষাট ফুট উঁচু; এখনো অতীতের মহিমার চিহ্ন বহন করে আছে। দেয়ালগুলো সুন্দরভাবে চুনকাম করা এবং মরিস্কো কল্পনায় সজ্জিত; উঁচু ছাদটি মূলত মুরদের পেন্সিল অলংকার বা স্ট্যালাকাইট দিয়ে উজ্জ্বল রঙ এবং সোনালি রঙের অলংকরণে অসাধারণ। দুর্ভাগ্যবশত এক ভূমিকম্পের সময় তা ভেঙে পড়ে যার পাঁজর অদ্ভুতভাবে তৈরি এবং সমৃদ্ধ রঙিন; এখনো তাতে প্রাচ্য, ‘এরাবিয়ান নাইটসের কথা মনে করিয়ে দেয়।’

রাজকীয় সিংহাসনটি প্রবেশদ্বারের বিপরীতে একটি ফাঁকা জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে এখনো একটি শিলালিপি আছে যে রাজা প্রথম ইউসুফ (যিনি আলহামরার নির্মাণ সমাধা করেছিলেন) এটিকে তার সাম্রাজ্যের সিংহাসন রূপে স্থাপন করেছিলেন। এই মহৎ হলের সবকিছুই চিত্তাকর্ষক মর্যাদা এবং জাঁকজমকের সঙ্গে সিংহাসনকে ঘিরে রাখার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে মনে হয়। টাওয়ারটি বিশাল শক্তির, পুরো ভবনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং খাড়া পাহাড়ের ঢালকে ঢেকে রাখে। হল অফ অ্যাম্বাসেডার্সের তিন দিকে বিশাল প্রাচীরের মধ্য দিয়ে জানালা কেটে বিস্তৃত দৃশ্যকে আকর্ষণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় জানালার বারান্দাটি বিশেষ করে দারোর সবুজ উপত্যকার দিকে দৃষ্টি যায়, বাঁ দিকে এক দূরবর্তী দৃশ্য; ঠিক সামনে রাস্তা, সোপান এবং বাগানের মিশ্রণ। দুর্ভাগ্য সেই ব্যক্তি যে এই সব হারিয়েছে! চার্লস পঞ্চম, এই জানালা থেকে এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন।

যে জানালায় চার্লস পঞ্চম রাজকীয় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, সেই জানালার বারান্দাটি আমার প্রিয়। আমি সবেমাত্র সেখানে বসে একটি দীর্ঘ উজ্জ্বল দিনের সমাপ্তি উপভোগ করছি। আলহামার বেগুনি পাহাড়ের আড়ালে ডুবে যাওয়া সূর্য, দারোর উপত্যকার উপরে উজ্জ্বলতার স্রোত, যা আলহাম্ব্রার লাল টাওয়ারগুলোর ওপর একটি বিষণ্ন জাঁকজমক ছড়িয়ে দিয়েছিল; অস্তগামী রশ্মিতে আচ্ছন্ন সামান্য উষ্ণ বাষ্পে ঢাকা ভেগা নদীটি দূরে সোনালি সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। বাতাসের এক নিশ্বাসও সেই সময়ের নীরবতাকে বিঘ্নিত করেনি, এবং দৃশ্যগুলোর মধ্যে স্মৃতি প্রায় জাদুকরি শক্তির পরিচয় দেয়, এবং টাওয়ারগুলোতে সন্ধ্যার সূর্যের আলো অতীতের গৌরবকে আলোকিত করে।

লেখক ওয়াশিংটন আরভিং আলহামরা পতনের ৩৩৭ বছর পর এবং বর্তমান সময় থেকে ২০০ বছর আগে আলহাম্ব্রা দেখে বলেছিলেন, ‘এ্যারাবিয়ন নাইটস’, অ্যাম্বাসেডরদের হলের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ২০০ বছর পর আলহামরা অনেক কিছুই বদলে গেছে, অনেক কিছু বিলীন হয়ে গেছে। যেটুকু অবশিস্ট আছে সেটুকু দেখেই আমরা বিস্ময় ও বিস্মিত হয়েছি। ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি শেষ মুরিশ মুসলিম গ্রানাডার শাসক আবদাল্লা মোহাম্মেদ বিন আলী যিনি বোয়াদিন নামেও পরিচিত, স্পেনের ক্যাথলিক রাজা দ্বিতীয় ফারদিনান্দ ও তদ্বীয় পত্নি ইসাবেলের হাতে আলহামরাকে তুলে দেন, শেষ হয় স্পেনে মুসলিম শাসন। খুব তরিৎ আলহামরা অ্যাম্বাসেডরদের হলের সিংহাসনে বসে ইসাবেলা নাবিক ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের হাতে সমুদ্রভ্রমণের সনদ তুলে দেন। আলহামরার শেষ সময়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসও সাক্ষী ছিলেন। আর এই আলহামরা থেকে ইসাবেলা জারী করেন এক ডিক্রি, দেশের সব ইহুদিকে হয় খ্রিষ্টান হতে হবে নতুবা দেশ ছাড়তে হবে। মুসলিম শাসনে ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলিম একত্রে বসবাস করতে পারলেও খ্রিষ্টান শাসনে নয়। ইতিহাসের বৈটিত্র্য অভিজ্ঞতা নিয়ে আলহামরা এখনো ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ...

* লেখক: লিয়াকত হোসেন, স্টকহোম, সুইডেন। [email protected]

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]