শুভ জন্মদিন হুমায়ূন আহমেদ, জনপ্রিয়তা কমেনি

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের আজ (১৩ নভেম্বর) জন্মদিন। আমি যখন নটর ডেম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন সবে রবীন্দ্র-নজরুল, বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র, শংকর, ম্যাক্সিম গোর্কি, দস্তয়ভস্কি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সমসাময়িক লেখকের বই পড়া শুরু করেছি। সেই সময় প্রথম পরিচিত হই হুমায়ূন আহমেদের তিনটি বইয়ের সঙ্গে। ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এবং বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। অসাধারণ লেগেছিল তাঁর বই তিনটি। তিনটি উপন্যাস ও গল্প আমার অন্তরে স্থান করে নিয়েছিল। এরপর অনেক দিন তাঁর কোনো গল্প-উপন্যাস পড়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত তৃতীয় বর্ষে আবার শুরু করি তাঁর গল্প-উপন্যাস। তাঁর অনেক গল্প-উপন্যাস পড়েছি, কিন্তু প্রথম যে তিনটি বই আমার মনে গভীর দাগ কেটেছিল, পরবর্তী লেখায় তেমন প্রভাবান্বিত হইনি। তবে তাঁর সৃষ্ট অসাধারণ চরিত্র হিমু এবং মিছির আলি আমার খুব ভালো লাগে। হুমায়ূন আহমেদ আবার আমার প্রিয় হয়ে উঠলেন ছোট পর্দায় তাঁর লেখা ও পরিচালনায় নাটকের মাধ্যমে। তাঁর নাটকের সংলাপ এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন  করেছিল। আর সে কারণেই বোধ হয় বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক।

আমরা যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, সে সময় রসায়ন বিভাগের অনেক শিক্ষক চলে গিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। রসায়ন বিভাগ শিক্ষকশূন্য হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আসতেন আমাদের ক্লাস নিতে। তখন আমার মনে আশা জেগেছিল হুমায়ূন আহমেদ স্যারও হয়তো আসবেন। কিন্তু আমার আশা পূরণ হয়নি। ছাত্রজীবনে তাঁকে কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা থাকলেও কোনো দিন দেখা করার সুযোগ হয়নি। দেখা করার বিশেষ কারণ কোয়ান্টাম মেকানিকস। তিনি তাঁর এক গল্পে লিখেছেন, পিএইচডি করার সময় তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়েছিলেন এবং প্রথম পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময় তিনি ১০০% নম্বর পেয়েছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব! আমি তখন রসায়নশাস্ত্র পড়ছিলাম এবং আমার একটি কোর্স কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। কোয়ান্টাম মেকানিকস অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল একটি সাবজেক্ট। অতি পারমাণবিক কণা অথবা তরঙ্গের মাপনীতে পদার্থের আচরণ বর্ণনা করে, কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই সংজ্ঞায় কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু এ মাপনপদ্ধতির জটিল সমীকরণ নিয়েই খাবি খাচ্ছিলাম। তাই আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল, তাঁর ১০০ শতাংশ নম্বর পাওয়া কি নিছক গল্প নাকি বাস্তব? সীমিত জ্ঞান দিয়ে অসীম জ্ঞানের একজন মেধাবীকে যাচাই করাও ধৃষ্টতা। তারপরও ইচ্ছা বলে কথা।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

অবশেষে আমার বিয়ের পর প্রথম তাঁর দেখা পেয়েছিলাম একুশে বইমেলায়। তিনি ভক্তদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। ভাবলাম, এই তো সুযোগ, আমি ও আমার স্ত্রী লাইনে দাঁড়ালাম। সেই সময়ে শাওনকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি চলছে। আমি ও আমার স্ত্রী দুটি বই তাঁর সামনে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার, ব্যাপারটা কি সত্যি? তিনি চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, কোন ব্যাপার? আমি বললাম, আপনি কোয়ান্টাম মেকানিকসে ১০০% নম্বর পেয়েছিলেন। তিনি আশ্বস্ত হলেন, হয়তো ভেবেছিলেন আমি শাওন-সম্পর্কিত প্রশ্ন করব। তিনি আমাকে বললেন, তুমি ফিজিকস নাকি কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলে? আমি বললাম, আমি রসায়নে মাস্টার্স করেছি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কত পেয়েছ? এবার আমি বিব্রত। তিনি বললেন, আমি একজন শিক্ষক। আমাকে বললে ক্ষতি কি? আমি আমার নম্বর বললাম, তিনি বললেন বাহ্‌! বেশ ভালো নম্বর পেয়েছ তো? আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তারপর তার বইতে লিখলেন, শিল্পী ও গালিবকে আমার শুভেচ্ছা। সেই তাঁর সঙ্গে প্রথম ও শেষ দেখা। আজও আমি এবং আমার স্ত্রী সে কথা মাঝেমধ্যে আলোচনা করি।

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: অন্য আলো

মৃত্যুর পর বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সুন্দর একটি লেখা লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের অনেক প্রশংসা করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সাহিত্যিক, গান বা কবিতা তিনি তেমন একটা লিখেননি। তবে যে কয়টি গান তিনি রচনা করেছেন, তা পাঠক-শ্রোতার মন কেড়েছে, এ কথা সত্যি। তিনি ছিলেন সাহসী লেখক, তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই নিয়ে লিখতেন। তিনি তাঁর নাটকের চরিত্র নির্দোষ বাকেরের ফাঁসির সিদ্ধান্তে লাখো লোকের মিছিল বের করার মতো ক্ষমতাধর নাট্যকার, তেমনি দেশের দুঃসময়ে ‘তুই রাজাকার’ কথাটি প্রথম উচ্চারণ করিয়েছিলেন টিয়া পাখির মাধ্যমে। এমন লেখকের অকালপ্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। হুমায়ূন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক বলে গণ্য করা হয়। তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়েছে। তাঁর কাছে বাংলার মানুষের আরও অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সে প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেননি। কারণ, মরণব্যাধি ক্যানসার তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু জনপ্রিয়তা কেড়ে নিতে পারেনি। বাংলার অগণিত পাঠকের মধ্যমণি হয়ে রইবেন তিনি চিরকাল। শুভ হোক আপনার জন্মদিন। প্রিয় লেখক, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আমরা আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি। আপনি স্বর্গবাসী হোন, সেই প্রার্থনা করি পরম করুণাময়ের কাছে।

....ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়...

*লেখক: বায়াজিদ গালিব, রম্যগল্প লেখক, ক্যালগেরি, কানাডা