ফুটবলীয় হাস্যরস যেন ব্যক্তিগত দ্বন্দের কারণ না হয়

লিওনেল মেসি ও নেইমার
ছবি: রয়টার্স

ফুটবল আমার কাছে বিনোদনের অংশ। পছন্দের দলের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মজার ছলে সবাই সবার মতো করে লিখছেন। রোনালদো, মেসি, নেইমারদের শেষ বিশ্বকাপ জেনে দর্শকের উন্মাদনা যেন বেড়েছে দ্বিগুণ। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হাঁটে–মাঠে–ঘাটে ছড়িয়েছে ফুটবলীয় উত্তাপ। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর এলেই বাংলাদেশের মতো ফুটবল–ভক্তদের এমন উত্তেজনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিরল। নিজের ভালো লাগা দলকে সমর্থন করতে গিয়ে এবং সেরা প্রমাণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে সমর্থকদের। ফুটবলীয় উত্তেজনায় এটি স্বাভাবিক হলেও দুঃখের বিষয় হলো অনেক সমর্থকের পক্ষেই এই ফুটবলীয় হাস্যরস স্বাভাবিক নয়! অনেকেই হাস্যরস করতে এসে সেটিকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নেন, মিশিয়ে ফেলেন ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে, যা খুব হতাশার বটে।

অনেক সমর্থকই পাল্টাপাল্টি হাস্যরসাত্মক মন্তব্যের একপর্যায়ে বিনোদনের অংশ খেলাকে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। ফুটবল বিশ্বকাপ চার বছর পরে আসে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও অনেকের চেষ্টা থাকে খেলা দেখার এবং নিজের পছন্দের দলের পক্ষে সমর্থন জোগানোর। এ আসরটা সারা বিশ্বে একসঙ্গে ঝড় তোলে। নানান মানুষের নানান মত থাকতে পারে। তবে বিশ্বকাপের এই মুহূর্তটা সবার জন্য একটু বিশেষ আনন্দ–বিনোদনের খোরাক জোগায়। কিন্তু ফুটবলীয় হাস্যরস যেন আমাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দের কারণ না হয়! মুখে সবাই হাস্যরস করছেন, তবে বাস্তবে তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, এটা কখনো কাম্য নয়। ফুটবলকে ব্যক্তিজীবনে জড়িয়ে ফেলে বিনোদন আর ব্যক্তিজীবন একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলছেন অনেকেই।

বিনোদনের অংশ জেনেও ফুটবলীয় হাস্যরসকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নেওয়া কোনোমতেই একজন পরিণত মানুষের আচরণ হতে পারে না। আপনি যদি বিনোদনের মধ্যে হাস্যরসই বুঝতে না পারেন, আপনার বরং এমন হাস্যরস পরিহার করা উচিত। কারণ, একেকজন একেক রকম। আমাদের প্রত্যেকের শিক্ষা, বোঝার ক্ষমতা আলাদা। তাই ফুটবলীয় বিনোদন নিতে এসে হাস্যরস যদি আপনি একান্তই সহ্য করতে না পারেন বা এটির সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা রাখার পার্থক্য না বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার এমন হাস্যরসে শামিল হওয়া সমীচীন নয়। ভাবতে যাবেন না যে সবাই আপনার মতোই চিন্তা করছেন। আমরা কারও জীবনের গল্প জানি না।

আমাদের আশপাশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা প্রতিনিয়ত চাইলেও একটু হাসতে পারছেন না জীবনের নানা পরিস্থিতিতে, নানান বাস্তবতায়! এ বিশ্বকাপটা সেসব মানুষের অনেকের মুখেই হাসি ফোটায়, আনন্দ উচ্ছ্বাসের একটা মুহূর্ত তৈরি করে। আমার মতে, মানুষের সেটাই করা উচিত, যেটা করে সে প্রশান্তি পায়। আমাদের সবার জীবন আলাদা, জীবনের গল্পগুলোও আলাদা। তাই সেটাই করুন, যেটা করে আপনি শান্তি পান। আপনার পাশের লোকের ভালো লাগুক বা না লাগুক, তা দেখে কখনো আপনার জীবনের হাসি থামিয়ে দেবেন না। আপনার হাসি–আনন্দের অধিকার আপনার হাতেই রাখুন। তাই পরিণত মানুষ ফুটবলীয় হাস্যরস করেন না বা করতে যাবেন না, এমনটা বলা বন্ধ করুন। আপনার জীবনকে আপনি ফোকাস করুন, ব্যস্ত থাকুন। অন্যের ব্যক্তিজীবনের হাসি-কান্নার সুযোগ অন্যকে নিতে দিন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় পেলে মানুষের কিছু হাস্যরস করা প্রয়োজন, সেখানে নানান রকম বিরূপ মন্তব্য থাকা উচিত নয়।

আমি ইউরোপ থেকে ফুটবল নিয়ে লেখালেখি করি বলে অনেকেই আমাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, ইউরোপে বসে বাংলাদেশের ফুটবল–উন্মাদনা নিয়ে আমার মন্তব্য করা মানায় না। আমি তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনি ইউরোপে থাকছেন বলে কি নিজের শিকড় ভুলে যাবেন, যে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ ফুটবল উন্মাদনায় মাতেন, আমিও একদিন সেই দেশেই ছিলাম, সেই জ্বর আমার গায়েও লাগে। বিশ্বকাপ ফুটবলটা এক মাসের আয়োজন। এই সময়টা আনন্দ, হাস্যরস করে কাটালে সমস্যার কিছু দেখছি না। তবে এর মানে এই নয়, এই ইস্যুকে কেউ বাড়াবাড়ি করে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব–সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাবেন।

পরিণত মানুষ হিসেবে ফুটবলীয় হাস্যরস অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যান। অনেকেই অনেককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনফ্রেন্ড পর্যন্ত করে দেন। ভাবা যায়, খেলাকে কোথায় নিয়ে যায় মানুষ। বাংলাদেশে ফুটবলীয় হাস্যরস বোঝার মতো ক্ষমতা এখনো অনেক মানুষের হয়নি! ফুটবলটা তাঁদের কাছে শুধু বিনোদন নয়, বরং ম্যাডনেস। ইউরোপে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নিয়ে দেখি গানে গানে হাস্যরস করে। তবে ওরা দেশীয় সমর্থকদের মতো অর্বাচীন নয়।

বিনোদন আর ব্যক্তিগত জীবন এক নয়। ফুটবল নিয়ে হাস্যরসে মজার আগে একজন প্রাপ্ত বয়স্কের এই ফারাকটা বোঝা জরুরি। ফুটবলীয় হাস্যরস করতে আসার আগে জেনে নিন, আপনি বিনোদন আর ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন কি না! কারণ পরিণত মানুষ জানেন, কোনটা বিনোদনের উদ্দেশ্যে হাস্যরস আর কোনটা ব্যক্তিগত। দুটোর পার্থক্য না বুঝলে বিপদ।

ইউরোপে সারা বছরই ফুটবলীয় উত্তাপ থাকে। প্রতি সপ্তাহেই চলে দুই দলের সমর্থকদের মুখোমুখি হাস্যরস। গানে গানে তাঁরা একে অন্যকে দুর্বল আখ্যায়িত করেন। প্রতি উত্তরে অন্য দলের সমর্থকেরাও গানে গানে তাঁদের জবাব দেন। তবে বাংলাদেশের সমর্থকদের মতো আবেগে কান্না করা, আত্মহত্যা করা বা দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি–সংঘাতের পর্যায়ে কেউ যান না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষ বিনোদনের উদ্দেশ্যে ফুটবল দেখতে এসে হাস্যরসকে ব্যক্তিগত সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যা কখনো কাম্য নয়।

ফুটবল বিনোদনের অংশ হলেও কিছু সমর্থক এটিকে ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলছেন। ফুটবলীয় হাস্যরস করতে এসে তাঁরা মানুষকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন। এর ফলে বিনোদনের উপলক্ষ হয়ে উঠছে সংঘাতময়। বিনোদনের উদ্দেশ্যে খেলা দেখা হলেও প্রতিপক্ষের সমর্থকের মজার ছলে করা কৌতুক না বুঝে এটি নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দে জড়িয়ে পড়েন, এহেন সমর্থকেরা সত্যিকার অর্থে বিপদ ডেকে আনবেন। কোথায় আর্জেন্টিনা, কোথায় ব্রাজিল—দিন শেষে আপনার দেশের ভাই আপনার আপন। অথচ সাময়িক বিনোদন, হাস্যরস না বুঝে এভাবে একে অন্যের প্রতি হিংসাত্মক হয়ে ওঠা কাম্য নয়।

বিনোদন আর ব্যক্তিগত জীবনকে আলাদা করুন। দিন শেষে আমরা ভাই ভাই, একই দেশের নাগরিক। আপনি মেরে আপনার ভাইয়ের মাথা ফাটাবেন, একথা যাদের সমর্থনে/ উন্মাদনায় করলেন, আপনার প্রিয় দল কখনো জানতেও পারবে না। জানলে আপনার মতো সমর্থক তারা চাইবে না। কারণ, তারা জানে, ফুটবল বিনোদনের খোরাক, আর বিনোদন নিতে এসে কোনো ভায়োলেন্স হবে, সেটা কখনোই প্রত্যাশিত নয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বহু দূর, দিন শেষে আপনি আমি সবাই এক দেশের মানুষ।

রোনালদো-মেসি-নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ। আর কখনো সমান উন্মাদনা নিয়ে দেখা হবে না বিশ্বকাপ। লিজেন্ডরা সারা জীবন বেঁচে থাকুক ভক্তদের অন্তরে।