আমার মা রানী ফেরদৌসী
বাড়ির উঠানে নতুন কনের গোসলের চৌকিতে দাঁড়িয়ে ফেরদৌসী। হলুদ মাখা গায়ে সোঁন্দা মেথির সৌরেভে সুরভিত এই ষোড়শী আজ অচেনা এক জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। চোখে রাজ্যের স্বপ্ন, কম্পিত হৃদয় আর কত নীরব অভিযোগ। এইটুকু বয়সে মা–বাবা, ভাই–বোন ছেড়ে থাকবে কী করে? চারদিকে হইচই, সাত সোহাগীরা (বিবাহিত নারীরা) নানা রকম সামগ্রী নিয়ে ওকে ঘিরে গাইছে বিয়ের গান।
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ। ঢাকা শহরে মাঘ মাসের শীতের প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছে। বিয়ের জন্য ওদের পুরান ঢাকার বাড়িটা নতুন করে চুনকাম করা হয়েছে। লাল–হলুদ–সবুজ–নীল আরও কত রংবেরঙের নিশান আর আলোয় সেজে উঠেছে বাড়ির আঙিনা, অলিন্দ আর দেউরি। আজ ফেরদৌসীর বিয়ে। বিয়ের সাজে ঠিক যেন এক রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছিল ওকে। সে রাতে মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল এই রাজকন্যার ছয় ফুট লম্বা গৌরবর্ণ সুঠাম দেহের অধিকারী এক রাজপুত্রসম বরের সঙ্গে।
বিয়ের পরে এই রাজকন্যা তাঁর স্বামীর আদরে–সোহাগে ভালোবাসা যত্ন আর সম্মানে ধীরে ধীরে কখন যে তাঁর রানী হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা তিনি নিজেও জানেননি। হ্যাঁ, এই রানী ফেরদৌসীই আজ আমাদের ছয় ভাই–বোনের জন্মদাত্রী মা। বাবা চিরকাল তাঁকে রানীর আসনেই বসিয়ে রেখেছিলেন। সংসারের কোনোরকম ঝামেলা বা পেরেশানির আঁচ তাঁকে পেতে দেননি। নিজের কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে যখন একতলা দালান বাড়িটি তিনি তৈরি করেন, তখন শখ করে তার নাম রেখেছিলেন ‘ফেরদৌস মহল’।
মূল এক বিঘা জমির প্রায় আধা বিঘা জমি নিয়ে বাড়িটি তৈরি। চারদিকে বাউন্ডারি দেয়াল আর সেই দেয়াল ঘেঁষে ছিল নানা রকমের গাছ। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কুল, করমচা, জামরুল, নারকেল, সুপারি, নিম আরও কত কী। সামনে ছিল বিরাট বাগান। ঘোরানো ড্রাইভওয়েটি এসে থেমেছিল গাড়ির বারান্দায়। সেই ড্রাইভওয়েতে আট–দশটা গাড়ি ভালোভাবেই রাখা যেত।
মালির অতি যত্নে গড়া সেই বাগানে ছিল নানা রঙের মৌসুমি ফুল। গরমের মৌসুমে ছিল মাধবী লতা। বারান্দার রেলিং ঘেঁষে পিলার ছুঁয়ে একবারে ছাদে গিয়ে ঠেকেছিল। থোকায় থোকায় ফোঁটা সেই রঙিন মাধবীলতার রূপ যে কী দারুণ দৃষ্টিনন্দন ছিল, তা মনে পড়লে আজও পুলকে মন ছুঁয়ে যায়। বেলি, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ আর দোলনচাঁপার সুগন্ধ গোটা লনে ছড়িয়ে যেত। পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হালকা বাতাসে বয়ে আনা সেই সুগন্ধ যেন আজও চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করা যায়। শরৎকালের কুয়াশাঘেরা ভোরে শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা অজস্র শিউলি ফুল কুড়ানোর আনন্দ ছিল তুলনাহীন! কমলা রঙের বোঁটায় সজ্জিত সেই শুভ্র শিউলি ফুল আর ভোরের শীতল বাতাসে তার মনমাতানো সুগন্ধ আজও আমার হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। শীতের সময় গাঁদা, ডালিয়া, ক্রিসেন্ট থিমাম, কসমস আরও কত বাহারি রঙের ফুলের সমারোহ ফেরদৌসীর বাড়িটাকে সাজিয়ে তুলত।
এই ফেরদৌস মহলের পরিবেশটি ছিল অতি ভরপুর এবং জমজমাট। একটি পুত্র আর পাঁচটি কন্যা ছিল মহলের শোভা। তাদের দেখাশোনা ও অন্যান্য কাজের জন্য ছিল আরও কিছু গৃহকর্মী। আমাদের মা ছিলেন খুবই সাধারণ এবং নরম মেজাজের একজন মানুষ। ঘরসংসার সামলানো আর ছেলেপুলে মানুষ করাই যেন ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা। রান্নার হাত ছিল তাঁর অপূর্ব! আর আমাদের বাবা ছিলেন তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ! পরে মায়ের পাশে থেকে সেই সব চমৎকার রান্না এবং তার কলাকৌশল আয়ত্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
আমাদের অতি সরল–সহজ মা মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্নেহ–মমতার পরিচয় দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক যোদ্ধা। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে গভীর রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমার ভাইয়ের কাছে আসত। তখন আমাদের মা বিছানা ছেড়ে চুপি চুপি রান্নাঘরে গিয়ে মিটিমিটি আলোতে রান্না করে ওদের খাওয়াতেন এবং যাওয়ার সময় শুকনা খাবারদাবার ও টাকাপয়সা সঙ্গে দিয়ে দিতেন।
সময়ের গতিতে ধীরে ধীরে মহলের রূপ বদলে যেতে লাগল। কন্যারা একে একে বিদায় নিয়ে নিজেদের সংসারের রানী হয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। রয়ে গেল শুধু সুপুত্র। একদিন বিয়ে হলো এই পুত্রের। ঘরে এল নতুন বউ। তারপর সবকিছু আরও বদলে গেল। ছয়টি বাচ্চাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বাবা আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন। ফেরদৌস মহলের রানী ফেরদৌসী ও স্বামী শোকে কাতর হয়ে একদিন বিদায় নিলেন। সেই একতলা ফেরদৌস মহল আজ দশতলা অট্টালিকা! আরও কিছু মালিকানা সংযোগ হয়েছে সেখানে।
ফেরদৌস মহলের প্রতিষ্ঠাতা কাজী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর রানী ফেরদৌসী আজ আর নেই, তবুও তাঁদের ছোঁয়া যেন লেগে আছে এই নতুন দশতলা ফেরদৌস মহলের প্রতিটি ধূলিকণাতে।
‘এক পেঁচে শাড়ী পরা,
আঁচলে বাঁধা চাবির ছড়া,
পান খাওয়া রাঙা দুটি ঠোঁট,
মুখ তার মায়া ভরা।’
এই ছিলেন আমাদের মা ফেরদৌসী বেগম। আমার জীবনে এমন একটি দিন কাটেনি, যেদিন মাকে আমার মনে পড়েনি। তবে আজ মা দিবসে বিশেষ করে মনে পড়ে যায় সেই সব স্মৃতি, যা আমার মনের মণিকোঠায় চির অম্লান হয়ে আছে। আমাদের মা এবং প্রয়াত মায়েরা পরপারে শান্তিতে থাকুন। পরম করুণাময় আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদৌসে আমাদের সবার মায়েদের জায়গা দিন, এই কামনা করি।
*লেখক: জাহান সৈয়দ, ওকভিল, অন্টারিও, কানাডা
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]