ভালোবাসা-২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সারা দিন কাটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি বা পাবলিক লাইব্রেরিতে। ইবাদুল্লাহর বারান্দা কেবল সে সময়টুকুর জন্য, যখন অন্য কোথায় থাকা যায় না অথবা থাকা শোভন নয় অথবা থাকলে নিশ্চিত পুলিশের খপ্পরে পড়তে হবে। এ সময় কিছুতেই পুলিশের খপ্পরে পড়তে চাই না। সামনে হয়তো আমার পুলিশি প্রতিবেদন দরকার পড়বে। একবার একটা দাগ পড়ে গেলে, তা তুলতে অনেক কিছু ঢালতে হবে। কী দরকার।

আমি বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটা আমার তৃতীয় ও শেষ সুযোগ। দুবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়েছি ঠিকই, শেষমেশ হয়নি। কী কী সব প্রশ্ন করে ঠিক ধরতে পারি না। ফল বের হয়, অনেকের দরজা খোলে, বছর ঘুরতে না ঘুরতে বেছে বেছে সিঁদুরে আম কেনার মতো পাত্রী বা পাত্র খুঁজে তারা বিয়ে করে ফেলে, আমার কিছুতেই কপাল খোলে না। সরকারি চাকরিতে এটাই আমার শেষ সুযোগ, বয়স থাকবে না এরপর।

সরকারি চাকরি হবে বলে যে আরেকজন অপেক্ষায় আছে, সে–ও থাকবে না। সে নিজে এই অপ্রিয় সত্যটা অবশ্য নিজে মুখে বলেনি। না বললেই কি? বোঝা যায়। দুবারের চেষ্টায় বিসিএস হয়নি বটে, কিন্তু এটুকু বুঝতে না পারার মতো গাড়ল তো নই। তার হাবভাবে আমি এ অপ্রিয় সত্যটাও বুঝে নিয়েছি।

বুঝেছি বলেই ইদানীং সত্যটার আঁচ আমার গায়ে লাগছে। আমি আঁচের তাত বুঝতে পারছি, কিন্তু মানতে পারছি না। যেন আমার সব শক্তি দিয়ে জাঙ্গাল ভেঙে গড়িয়ে নামা পানির তোড় ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। পারছি না।

মাস্টার্সের পর পাশের গ্রামের সরকারি স্কুলে একটা চাকরি হয়েছিল। সেই চাকরিতে বাবার মুখটা চুন হয়ে থাকত। যেন চাকরি করছি না, পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধ করছি। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় যখন বাড়ি থেকে বের হতাম, বাবার মুখ দেখে মনে হতো আমি যেন মানুষ খুন করতে যাচ্ছি। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বাবার সেই মরমে মরে যাওয়া মুখটা ভুলতে পারতাম না।

বাবারই–বা দোষ কী? জীবনভর ছিলেন সরকারের ছোট চাকরিজীবী। বড় বাবুদের ধমকি ছাড়া আর তো কোনো সঞ্চয় ছিল না। আশায় বুক বেঁধে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছোট চাকরিতে জমানো সারা জীবনের ক্ষুদ্রত্ব মুছে দেবেন ছেলে। একদিন সে বিসিএস অফিসার হবে। সেই সাফল্যের দিন দেখে তিনি হাসতে হাসতে মরতেও পারবেন। আজরাইলকেও ভয় লাগবে না তখন।

প্রায়ই বাবা বলেন, আমার মরহুমা মায়েরও নাকি একই ইচ্ছা ছিল, আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করি। আমি বিসিএসে চাকরি পেলে মা নাকি তার মায়ের বাড়ির গ্রাম গোবিন্দপুরের চৌধুরীদের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে। গলাজুড়ে গয়না পরবে। পান খাবে আর বাড়ির কাজের লোকদের ওপর হুমকি–ধমকি করবে।

তাই হাল ছাড়িনি। আসলে হাল ছাড়তে পারিনি।

তবে ভূরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) থেকে বিসিএসের চেষ্টা সফল করা কঠিন। গ্রামের কাদাখোঁচা জীবন, স্কুলের চাকরি, অসুস্থ বাবা আর ছোট বোনকে ছেড়ে শেষবারের চেষ্টা হিসেবে নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী আবাসনের রোদমহলে জীবনযাপনের এই বনেদি বন্দোবস্ত আমার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিসিএস পরীক্ষার পড়াশোনার জন্য ভালো। অনেকেই পড়ে। দল বেঁধে পড়ে। একা একা পড়ে। ছেলেরা ছেলেরা পড়ে। মেয়েরা মেয়েরা পড়ে। ছেলেমেয়ে মিলেমিশেও পড়ে। ক্লাসে কেউই প্রায় যায় না আজকাল; ক্লাসে কী পড়ানো হচ্ছে খোঁজও রাখে না। তবে তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে ডেমোক্র্যাট রিপাবলিক অব কঙ্গোর রাজধানীর নাম মুখস্থ করে, পাপুয়া নিউগিনির মুদ্রার নাম মুখস্থ করে, ভুটানের রাজা এবং তাঁর একাধিক স্ত্রীর নাম, নেপালের মাওবাদী নেতার জন্মের সাল, তাঁদের বয়স, উচ্চতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কোনো কিছুই তাদের মুখস্থের তালিকা থেকে বাদ যায়নি।

আমিও খেয়ে না খেয়ে হুড়কো এঁটে মুখস্থ করে মুখে থুতু তুলে ফেলা বিসিএস চাকরিপ্রার্থী দলের একজন।

অন্যদের সঙ্গে পড়ি ঠিকই, কিন্তু সবাই মনে মনে জানি, আমরা একজন অন্যজনের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী। শত্রুও বলা যায়। সবাই ভেতরে ভেতরে একে অন্যের মৃত্যু কামনা করে। মনে মনে ছুরিতে শান দেয়। একজন অন্যজনের অদৃশ্য ঘাতক হয়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পড়াশোনা করতে করতে মাঝেমধ্যে যে সেই ঘাতক চেহারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে না, এমন নয়। তবে কেউ কাউকে বুঝতে দিই না। সরকারি অফিসারদের যেমন মুখে এক আর মনে আরেক হতে হয়, আমাদের সবারই ইতিমধ্যে সে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। পিএটিসির প্রশিক্ষণের আগেই আমরা সরকারি চাকরির উপযুক্ত হওয়ার জন্য স্বশিক্ষিত হয়ে উঠছি।

গত ছয় বছর এ ক্যাম্পাসেই কেটেছে আমার। মাঝখানে বছরখানেক বাদ দিয়ে আবার এ এলাকাতেই এসে উঠেছি।

এত বড় ঢাকা শহরে এ এলাকাটাই আমার নিজের। মনে হয় একমাত্র আপনজন। আমি হাত বাড়ালে সে–ও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি পা বাড়ালে সে–ও পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসে, বুকের ভেতর টেনে নেয়। এখানকার ঘাস, গাছ, পথ, ফুটপাত, দেয়াল, চাওয়ালা, আমড়াওয়ালা, ফুচকা বা কাসুন্দি মাখানো মুড়ির দোকানদারকেও আমার আপন মনে হয়।

অন্য এলাকার বাড়ি, রাস্তাঘাট, গাড়ি, দোকানপাট—সবকিছু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন দাঁত কেলিয়ে হাসে। উটকো ঝামেলা মনে করে, হুমকি দেয়। তাড়িয়ে দেয়। দূরে সরিয়ে দিতে না পারলে সারাক্ষণ অসম্মানের চোখে তাকিয়ে থাকে।

কেবল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই মনে হয় মন বাড়িয়ে পরমাত্মীয়ের মতো কাছে টানে।

আরও একটা গূঢ়তর কারণ আছে নবিরন-ইবাদুল্লাহর ঘরে সাবলেট নেওয়ার। সেটা অবশ্য আমি ছাড়া দু–একজন খুব কাছের বন্ধু জানে।

আমার বারান্দা ঘরের ঠিক উল্টো দিকে, রাস্তার ওপারে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল। ওরই চার তলার কোন একটা ঘরে তারানা থাকে। তারানা আজিম। আমার তিন বছরের জুনিয়র। লতার মতো ছিপছিপে মেয়েটি, কপালের কাছে গড়িয়ে পড়া চুল সরিয়ে, চোখ তুলে যখন তাকায়, তখনই যেন অন্ধকার ফুঁড়ে সকালের সূর্য ওঠে। যখন কথা বলে, মনে হয় কলমির লতার নিচ দিয়ে তিরতির করে জল গড়িয়ে যেতে যেতে খানিকটা মুখর শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়।

আগে আমাদের ঘড়ি ঘণ্টার হিসেবে চলত না। চলত মন ভরা না–ভরার হিসেব দিয়ে। পাশাপাশি বসে, হাত ধরে, আলো–অন্ধকারের ভেতর নিঃশব্দে চুমু খেয়ে। বুকের ভেতর কোথায় বেলি বা চামেলি লুকানো আছে, তার হদিস বের করার চেষ্টা করে।

আজকাল অবশ্য খুব একটা দেখা হয় না তারানার সঙ্গে। যারপরনাই ব্যস্ত ও। নতুন চাকরি, এ সময় কাজে ফাঁকি দেওয়া যায় না। সময় বের করার প্রশ্নই আসে না। সম্পর্ক নয়, এখন তার কাছে মূল্যবান সময়ের সঠিক ব্যবহার।

তারানা বেসরকারি ব্যাংকে ঢুকেছে গত বছর। সে–ও বিসিএস দেবে। এটা তার প্রথমবার। না হলেও ক্ষতি নেই। বেসরকারি ব্যাংকেই তার আরাম লাগছে। ভালো বেতন। কাজের পরিবেশও ভালো। বড় বড় ব্যবসায়ী, আর্মি পারসন, পেশাজীবী লোকদের সেবা দেওয়ার আনন্দই আলাদা। ওসব ব্যাংকে হেঁজিপেঁজি লোক ঢোকে না। সাহসই পায় না।

তারানা বলে, চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই এসব জায়গায় তরতর করে ওপরে ওঠা যায়।

এ এক বছরেই ওপরে ওঠার অনেকগুলো সিঁড়ি সে চিনে ফেলেছে। সেসব সিঁড়ির কোনটাতে সে উঠবে, কোনটাতে পৌঁছানো যাবে শীর্ষে, সেসব ভাবছে এখন। বাকিটা সুযোগের অপেক্ষায়। রাইট পারসন ইন রাইট প্লেস এট দ্য রাইট টাইম।

তারানা সেই রাইট পারসন হয়ে উঠতে চায়। চলবে...

**দূর পরবাসে লেখা পাঠতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]