ঈশপের চশমায় ঈদ

ছবি: লেখকের পাঠানো ছবি

ওরা তিন বান্ধবী। কীভাবে কীভাবে যেন ওদের মেলবোর্নে মিলন ঘটল। ঈদের সকালেই গোসল সেরে নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে আতরলোবান নয় পারফিউম ঢেলে ম–ম সুবাসে বাতাস মোহিত করে ওরা প্রথমে গেল ঈদের নামাজে।

তিনজনের একজন সদ্য বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে এসেছে। ছোটবেলাতে কিছুদিন তিনজন একসঙ্গে ময়মনসিংহে স্কুলে পড়েছিল। বাকি দুজন এ দেশে আছে অনেক দিন। তাদের সন্তানেরাও ইউনিভার্সিটি শেষ করবে শিগগিরই। বাংলাদেশ থেকে আসা রাফিয়া নিঃসন্তান। বিশাল ট্রাভেল এজেন্সির মালিক নিজে। স্বামীও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্ণধার। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রায় সব মহাদেশ ঘুরেছে, বাকি ছিল অস্ট্রেলিয়া। এবার তাই অস্ট্রেলিয়া আগমন।

রাফিয়ার ভাইয়ের বাসা থেকে তিন বান্ধবীর ঈদ আনন্দ ভ্রমণ শুরু। অন্য দুজন ডলি ও রওনক। তারা বলল—মেলবোর্নে ঈদ দেখাব তোমাকে, কত মজার কাণ্ড দেখবে চল।
প্রথম মসজিদ নাম দেওয়া এক বড় ঘরে নামাজ পড়তে গেল তারা। রাফিয়ার জন্য এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সে গোড়া নয়। তবে মেয়েদের বসার জায়গাটা অস্বস্তিকর রকমের খোলামেলা লাগল। রাফিয়ার মনে হলো মেয়েদের নামাজের জায়গা স্বতন্ত্র হলে শোভন হতো। খোলামেলা হওয়াতে পুরুষদের সবাই নয় কেউ কেউ মেয়েদের ঈদসজ্জার প্রদর্শনী দেখতেই বেশি মনোযোগী হলেন। ঈদ মেলা হলে বিষয়টা মানা যেত হয়তো। নামাজ বলে কথা। মেয়েরা ব্যস্ত সাজসজ্জার সচেতন প্রদর্শনে। শিশু-কিশোর-পুরুষরা ব্যস্ত বিভিনèবাড়ি থেকে নিয়ে আসা মুখরোচক খাবার আস্বাদনে। বাংলাদেশে মসজিদে যাওয়া হয়নি কখনো এই অভিজ্ঞতা রাফিয়ার কাছে অভিনব।

‘গত ঈদে দেখলাম তো, জান মেয়েটা দুনিয়ার অলস আর আমড়া কাঠের ঢেকি; ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাকরি করে এইটুকুই সার, হাতের কাজের বেলায় লবডঙ্কা’।

নামাজ শেষে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো ওরা। রাফিয়া চুপচাপ দেখছে আর ভাবছে। আবহাওয়া চমৎকার, দিনটিও ছুটির। ঈদের নয়, তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরিষ্কার–পরিচ্ছনè রাস্তায় গিজগিজে ভিড় নেই, গাড়ি-বাসে ধূলার আস্তরণ নেই। এমন নির্মল পরিবেশে মনের আনন্দে চুটিয়ে ঈদ উৎসব উদ্‌যাপন করছে কিছু লোকজন। মিষ্টিভাষী রওনক বললে
‘রাফিয়া কিছু বললে না যে’
‘কি বলব বল?’
ডলি তখন অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল
‘কেন নামাজ কেমন লাগল?’
‘নতুন রকম, আগে কখনো এমন দেখিনি তো’।

রাফিয়ার গলার স্বর এমনি শান্ত ধীরস্থির শুনে বোঝার উপায় নেই মন্দ লেগেছে নাকি আনন্দ পেয়েছে।

তারপর তারা গেল একজনের বাড়ি ঈদ মোলাকাত করতে। সুন্দর লনবাগানসহ বড়সর বাড়ি। বাড়ির মেজবান হেনা অতিথিদের আন্তরিক উষ্ণতায় ভরিয়ে দিল। নানা ধরনের টক-মিষ্টি ও ঝাল খাবারের এন্তার আয়োজন। খাবারদাবার রাখাও হয়েছে সর্বাধুনিক নানা আকারের শ্বেতপাথরের মতো তৈজসপত্রে। হেনা নিজের হাতে এটা সেটা পেটে তুলে দিতে চাইছিল। ওরা তিনজন অনেক দোহাই, অনেক অনুরোধ উপরোধ শেষে হেনার অত্যাচারী আপ্যায়নের হাত থেকে রেহাই পেল। ডলি যদিও প্রত্যেকটি খাবারের পদ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করল। তারপরে হঠাৎ যেন আবিষ্কার করল হেনা নতুন কিছু করে ফেলেছে এবার। তখনি সে ধরে বসল, ‘হেনা ব্যাপার কি বলত, গতবার ঈদে সব পদ নিজের হাতে তৈরি করেছিলে, যারাই খেয়েছে, কত সুনাম করেছে তোমার। এবার সব কিনে এনেছ মনে হচ্ছে’— মুখ ব্যাজার করে হেনা বলল।
‘ঠিক ধরেছ, একটাও নিজের হাতে বানাইনি। রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে সব বানিয়ে এনেছি’
তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘নিন্দুকেরা আর বলার সুযোগ পাবে না যে আমি কঞ্জুস, কিপটা টাকা বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে খাবার বানাই সব সময়’
দম ফেলে প্রায় ভেজা গলায় আবার বলল হেনা
‘আমার রান্না মজা বলে তারা খেয়েছে চেটেপুটে ঠিকই কিন্তু আমার আন্তরিক খাটনির জন্য কোথাও এতটুকু প্রশংসার বাক্য উচ্চারণ করেনি কেউ’
এই ফাঁকে রওনক রাফিয়াকে ফিসফিসিয়ে জানাল যে চারপাশে হেনার নামে কিপটামির বদনাম ডলিও ছড়িয়েছে। ডলিই ব্যথিত হেনাকে আলিঙ্গন আর আদর করে ওদের নিয়ে ওই বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি সটকে পড়ল।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

গাড়িতে যেতে যেতে ডলিকে আশাহত মনে হলো। হয়তো বা কিপটা দুর্নামটা হেনার গা থেকে খসে পড়ার দুঃখে। এক সময়ে সে নিজেই যেন প্রাণ ফিরে পেল। এবার শুরু করল খাদ্য নিয়ে আলোচনা।

‘দেশে কিন্তু ঘরে তৈরি নানা পদের খাবারের মাঝে বাড়ির কর্ত্রীর গুণপনা আর পরিবারের খান্দানিয়ানা দেখা যেত, এখনো কি এমন হয় রাফি?’
রাফিয়া একটু সময় নিয়ে কথা শুরু করল
‘হয়, আবার হয়ও না’
‘কী রকম বলত?’
রওনকের কৌতূহলি জিজ্ঞাসা।
‘যেমন মেহমান ডাকলে মানুষ ঘরেও নিজের হাতে কিছু কিছু পদ তৈরি করে আবার বাইরে থেকেও দু–এক পদ কিনে আনে’
‘বাইরে থেকে কি মিষ্টিটিষ্টি কিনে আনে?’
আবার ভাবল রাফিয়া
‘এখন দাওয়াতে দেখি ঢাকা ক্লাবের আচার গোস্ত আর কস্তুরির চিতল মাছের কাটলেট খুব আনিয়ে নেয়, মাছের ফিলেট রানèরেস্তোরাঁ থেকে আনায় অনেকে’
‘সবচেয়ে ভালো লেগেছে কোনটা?’
ডলির গোলগাল স্বাস্থ্যবতী সুখী চেহারা বলে দেয় তার খাদ্যাসক্তির কথা। প্রশ্নটাও তাই তার
‘শেষ দাওয়াতে সব খাইনি তো আর হরেক রকম পদ রাক্ষসও পারবে না সব খেতে, তাই কোনটার চেয়ে কোনটা ভালো বলতে পারব না, তবে ঘরে নিজের হাতে তৈরি ডিমের হালুয়া ছিল খুব ভালো; শক্ত দানা দানা নয় আবার জাফরান দেওয়াতে ডিমের গন্ধ ছিল না একটুও’
ডলি বলে
‘একেই বলে খানদানি ঘরোয়া রান্না! হেনার হাতের রান্না বেশ মজা।’
তারপর উষ্মা উগরে বলল ‘কম পদ করতি নিজের হাতে করতি মানুষ তৃপ্তি করে খেত, তা নয় পয়সার প্রদর্শনীর জন্য টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা রেস্টুরেন্টের কেনা খাবারে বোঝাই; দেখেছ কি রকম অর্থের বড়াই!’

রাফিয়া অবাক হয়ে ভাবল, গত বছর নাকি এই ডলিই হেনাকে কিপটা বলে ওর যত্ন করে তৈরি শখের রান্নাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে, এবার করছে হেনার ধনদৌলত দেখানেপনার মুণ্ডুপাত। রাফিয়া ভাবল, মানুষ বড় আজব জীব। রওনক বলল, ‘এবার যে বাড়িতে যাবে, সেখানে দেখবে খাবারের মধ্যে শুধু দোকানের কেনা খাবার, সব দেশের খাবার পাবে ইন্ডিয়ান, গ্রিক, ইতালিয়ান, লেবানিজ, টার্কিশ সব রয়েছে...
‘কী করে জানলে?’

‘গত ঈদে দেখলাম তো, জান মেয়েটা দুনিয়ার অলস আর আমড়া কাঠের ঢেকি; ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাকরি করে এইটুকুই সার, হাতের কাজের বেলায় লবডঙ্কা’।
যাকে রওনক আমড়াকাঠের ঢেঁকি আর কাজের বেলায় লবডঙ্কা বলেছে তার বাড়িতে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল।

বিরাট বিশাল বাড়ি নয়। তবে খুব ছিমছাম করে সাজানো। আসবাবপত্রে জৌলুস নাই তবে রুচির বিকিরণ আছে। ছোট্ট কয়েকটি মাত্র পর্সিলিনের টবে ছোট ছোট নানা ধরনের অর্কিড। বোঝাই যায় এ ধরনের জিনিস অনেক যত্ন আর ভালোবাসায় তৈরি।
বাড়ির কর্ত্রী নওশাবা ছিপছিপে গড়নের নারী। মিষ্টিভাষী চটপটে স্বভাবের। তার খাবার টেবিলে একগাদা খাবারের সমারোহ নাই। তবে যাই আছে সব মনোলোভা। ঝালমিষ্টি-নোনতা সবই আছে তবে পরিমিত। উপেক্ষা পড়া খাবার দিনের শেষে বিনে যাবার দুর্ভাগ্যের কবলে পড়বে না। মিষ্টি খাবার জর্দা সেমাই, কাস্টার্ড, কেক। নুনতা খাবার কাবাব, চিজ অন পটেটো, লুচি, আবার লাল আটার তৈরি লুচির আকৃতির হাতে গড়া রুটি। মোরগপোলাও, ফ্রাইড রাইস ছিল। পাশেই কালো চোকৌ বাটিতে ইয়োগার্ত-মিণ্ট (টকদই, পুদিনাপাতা, কাচা মরিচ, চিনি, লবণ দিয়ে) সস। ঘি-মিষ্টির সঙ্গে প্রশান্তি দেবে এই সস।

নওশাবার ঈদ আয়োজন দেখে ডলি আর রওনক বিস্মিত। নওশাবা খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করার মানুষ নয়। অতিথিদের রুচি ও পছন্দকে সম্মান দেখিয়ে তাদের যার যা ভালো লাগে, দেখেশুনে তুলে নেওয়ার অনুরোধ করল।

কাবাব, চিজ অন পটেটো আর ইয়োগার্ত-মিণ্ট সস খুব চলল। রওনক ও ডলি বলল
‘দারুণ হয়েছে, রেসিপি দিও প্লিজ’
‘রেসিপি দেব অবশ্যই, তবে একটা জিনিসের মাপ বলতে পারব না, যার ওপরেই আসলে নির্ভর করে মজা, সেটা আপনারা আন্দাজমতো দেবেন’
রওনক জানার জন্য মরিয়া হয়ে বলল
‘সেটি কী বলো তো ভাই?’

রহস্যের হাসি হেসে নওশাবা বলল—‘বলছি নামটা পরে, তবে পরিমাপ পার্সন টু পার্সন ভেরি করবে কিন্তু’ডলি এরই মাঝে নিচু গলায় রাফিয়াকে বলল যে নওশাবার সব সময় বাহাদুরি ফলানো চাই। গতবার একগাদা খাবার কিনে এনে করেছে পয়সার প্রদর্শনী এবার গাধার খাটুনি খেটে গুণের গরিমা দেখাচ্ছে।

রাফিয়া অবাক হলো দেখে যে ঈশপের চরিত্ররা আজও চারপাশে কেমন সুন্দর বেঁচেবর্তে আছে। এদের খুশি করতে গেলে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে তবু এরা খুশি হবে না। ঈশপের গল্পের বুড় তার ছেলে আর গাঁধা তিনজন কি বিপদেই না পড়েছিল চলার পথে সবার মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে।

‘বুড়ো আর তার ছেলে যাচ্ছে সঙ্গে তাদের গাধাটিও রয়েছে। কিছু লোক বলল ‘বোকা কোথাকার! গাধার কাজ বোঝা টানা ওকে শুধু শুধু আরাম করিয়ে হাঁটাচ্ছে’। বুড়ো ছেলেকে গাধার পিঠে বসিয়ে চলল এবার। পথিকরা তখন বলল ‘বুড়ো মানুষটা কষ্ট করে হেঁটে যাচ্ছে জোয়ান ছোকরা কিনা আয়েস করে গাধার পিঠে বসে’। ছেলেকে নামিয়ে বুড়ো চড়ে বসল। তখন আরেকদল বুড়োকেও টিটকারি দিল। তারপর ছেলেকেও টেনে তুলে পাশে বসাল লোকটি। এবার অন্য কজন বলল ‘দেখ কি নিষ্ঠুর ওরা! দু–দুটো মানুষ গাধার পিঠে কেমন করে চড়তে পারল’। মানুষকে খুশি করার জন্য বাপ-ছেলে এবার গাধাকে বেঁধেছেদে কাঁধে নিয়ে চলল। সেতু পার হওয়ার সময়ে ভয়ে ছটফট করতে থাকা গাধা ছিটকে পানিতে পড়ে তলিয়ে গেল।
গল্প থেকে বাস্তবে ফিরল রাফিয়া রওনকের তাড়াতে। চলে আসার সময়ে দরজার বাইরে পা ফেলতে ফেলতে রওনক বলল, ‘নওশাবা এবার তাইলে বল রেসিপির ওই আইটেমের কী নাম?’  
‘এর নাম আন্তরিকতা।’