ছেলেটির নাম - মেয়েটির নাম
১.
ব্যস্ত শহরের কোলাহলমুখর বাস্তবতা ছাড়িয়ে পায়ে পায়ে দুজন নিবিষ্ট হন ঘন সবুজের আঙিনায়। এখানে বাস্তবের গতিময় ব্যস্ততা নেই বললেই চলে। মনজুড়ানো সবুজ নিসর্গ তাদের একেবারেই আপন করে নিয়েছে। তারা দেখে, তাদের দুজনার মতো অনেক দম্পতি চলে এসেছেন। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন নয়। তাই অন্য মানুষজন কম। তারা লক্ষ করে, আশপাশে অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় বসে আছেন। আবার অনেকে একে অন্যের হাত ধরে হাঁটছেন, ধীরলয়ে। কারও হাতে হাঁটার জন্য সহায়ক লাঠি। তাঁরা কথা বলছেন, হাসছেন। সবাই প্রাণবন্ত। দেখতে খুবই ভালো লাগছে।
প্রায় ৩০ বছর আগে দেশ থেকে চলে এসেছিলেন এই দম্পতি। মেরিল্যান্ডের সিলভারস্প্রিং এলাকায় পাখির বাসার মতো অ্যাপার্টমেন্টের ছোট্ট পরিসরে এই দম্পতি এখন বসবাস করেন। চার সন্তানের সবাই, তাঁদের পরিবার নিয়ে অন্যত্র ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। ছুটির দিন বা অন্যান্য সময়ে তাঁরা তাঁদের মা-বাবাকে দেখতে আসেন। ফোনে খোঁজখবর নেন। মা-বাবার প্রয়োজনে সাড়া দেন।
প্রায় প্রতিদিন বিকেলের মনোরম স্নিগ্ধতায় পরিস্নাত হতে লিফটের বোতাম টিপে নিচে নেমে আসেন তাঁরা। তারপর পার্কিং লটে রাখা নিজেদের লাল টয়োটা গাড়িতে চেপে বসেন। একজন স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখেন। অন্যজন পাশে থাকেন। চার-পাঁচ মিনিটের ড্রাইভিং দূরত্ব পেরোলেই সামনে বিস্তৃত সবুজ পার্ক। পার্কিং এলাকায় গাড়ি রেখে তাঁরা চলে আসেন পার্কের ভেতর।
হ্যাঁ, তাঁদের পছন্দের জায়গায়, লম্বা বেঞ্চ খালি আছে আজ। দুজন বসেন সেখানে। পাশেই রাখেন ছোট্ট ব্যাগ। সেখানে আছে পানির বোতল ও সলটেড বিস্কুট। তাঁরা বসে আছেন। এদিক–ওদিক তাকিয়ে দেখছেন। কাছাকাছি অনেক দম্পতি কথা বলছেন, হাসছেন। যেন উচ্ছল কপোত-কপোতীর মেলা বসেছে আজ এখানে!
এ সময় একজন মুখ খোলেন, ‘আচ্ছা। তোমার কি মনে পড়ে?’
‘কোন কথা গো?’
‘সেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা?’
‘কী আশ্চর্য! আমারও মনে একই প্রশ্নের উদয় হয়েছে! হ্যাঁ! মনে পড়ে! এখনও পড়েছে!’
‘আমারও এখন মনে পড়েছে।’
‘আমি তো রীতিমতো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি!’
‘আমিও! তুমি তো সেই মেয়েটি? নাকি!’
‘আমারও একই প্রশ্ন, তুমি কি সেই ছেলেটি? সত্য কি না!’
‘তা হলে চলো, এখন এ সময় আমরা চলে যাই সেই অতীতে।’
‘হ্যাঁ। তবে, তা–ই হোক।’
‘তাঁরা দুজন এ সময় মুখোমুখি হয়ে একজনের হাতে আরেকজন হাত রাখে।’
২.
একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মধুর ক্যানটিনে বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা মারে। দল বেঁধে অভিজাত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে ইংলিশ মুভি দেখে। ভালোবাসাবাসি করেনি জীবনে। তাই ভালোবাসার স্বাদ জানে না ছেলেটি। বালকবেলায় গ্রামের পাঠশালায় থাকতে একটি সুন্দরী মেয়ে ওকে চিঠি দিয়েছিল। ছেলেটি সেই চিঠি ওর মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল কিছু না বুঝেই। মা বলেছিলেন, ‘খবরদার! কোনো মেয়েকে চিঠি দিবি না!’ পাঠশালা থেকে স্কুল। স্কুল থেকে কলেজ এবং কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। এ দীর্ঘ পথে ছেলেটি অনেক মেয়েই দেখেছেন, কেউ শ্যামলা আবার কেউ অনিন্দ্য সুন্দরী! কেউ পরে সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজ। মাথায় কালো চুল। আবার কেউ পরে সালোয়ার-কামিজ। ববড চুল। কেউ হাসে মুচকি, আবার কেউ হাসে তুড়ি দিয়ে। ছেলেটি সবকিছু দেখেও যেন দেখেননি এমনই করে, কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ২২টি বছর।
তারপর নিজের অবয়বে দেখেছে বিরাট পরিবর্তন। নরম তুলতুলে দুটি গালে মিশমিশে কালো দাড়ি; সঙ্গে গোঁফ। প্রতিদিন ব্লেড ধরতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে ছেলেটি। বুকটা সুঠাম–শক্ত। ছোট ছোট লোমে ভরে উঠেছে সারাটি বুক তার। এই বুকে এসেছে মায়া-মমতা, উদারতা সবই। রঙিন ভালোবাসার রংও বুঝি লেগেছে! নিজেকে আয়নায় ফেলে সুযোগমতো নিজের চেহারা দেখে ছেলেটি। মিটমিট করে হাসে। কখনো ‘সিজার’ বলে গালি দেয় নিজেকে। আবার হাসে। গ্রামের সেই বৃষ্টি নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে। এখন সেই মেয়ে নিশ্চয়ই মা হয়েছে। স্বামী ও একগাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার পেতেছে। ছেলেটি গ্রামে যায় না কত বছর হয়ে গেল, নিজেই জানে না। ছেলেটি বাংলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
একটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বান্ধবীদের সঙ্গে দুলে দুলে হাঁটে। গুনগুন করে লতার গানের সুর কাটে। কখনো কখনো ফাংশানে, হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান গায়। ছিনিয়ে আনে পুরস্কার। বান্ধবীদের কেউ কেউ ঈর্ষা করে। ছেলেরা ভালোবাসতে চায়। অনেক চিঠি পায় মেয়েটি; কিন্তু বিনিময়ে কাউকেই উত্তর দেয় না। পাঠশালা থেকে স্কুল। স্কুল থেকে কলেজ। এবং কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—এ দীর্ঘ পথে মেয়েটি অনেক ছেলেই দেখেছে। কেউ শ্যামলা। আবার কেউ এককথায় বলতে গেলে সুকুমার! কেউ পরে সাধারণ পাজামা–পাঞ্জাবি। মাথায় রুক্ষ চুল। আবার কেউ বেলবটম। পায়ে হাইহিল। মাথায় বাবরি চুল। কেউ হাসে মুচকি। আবার কেউ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে। মেয়েটি সবকিছু দেখেও যেন দেখেনি এমনই ভাব করে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনের উনিশটি বছর।
তারপর নিজের অবয়বে দেখেছে, বিরাট পরিবর্তন। নরম তুলতুলে গাল দুটি লাল টুকটুকে। কাজলটানা চোখের চাহনিতে মায়া ঝরে পড়ে। প্রতিদিন প্রসাধনীর মধে৵ ডুবে থাকতে ভালো লাগে মেয়েটির। ছোট বুকটা স্ফীত হয়েছে বেশ আগেই! তাই ওকে ওড়না পরতে হয়। এই বুকে এসেছে মায়া-মমতা, উদারতা সবই। প্রেমের রংটা আরও গাঢ় হয়েছে বুঝি। নিজেকে আরশিতে ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মেয়েটি। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ‘ক্লিওপেট্রা’ বলে ডাকে। আবার হাসে। বালিকাবেলার কথা মনে হয়। অনেকের কথাই মনে পড়ে। স্মৃতির পাতায় ধূলিমলিন একটি মুখ, ভাস্বর হয়ে ওঠে মনের পটে। বাদল ছেলেটা হয়তো সংসার পেতেছে। স্ত্রী–পুত্র–কন্যা নিয়ে পরম সুখে আছে। গ্রামের বাড়িটা অনেক আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাই গ্রামে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করে না মেয়েটি। মেয়েটি সমাজকল্যাণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
ইদানীং একটি মেয়েকে দারুন ভালো লাগে। দিনরাত মেয়েটির কথা ভাবে ছেলেটি। ওর চলন, কথা বলা, হাসা, পোশাক পরা—সবই ভালো লাগে। ওর নামটা স্মরণ করতে চায়, ছেলেটি; কিন্তু চেনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই ‘নবীনবরণ’ উৎসবে মেয়েটাকে দেখেছে সে। সেই থেকেই মেয়াটি ছেলেটির মনের আসনটি দখল করে আছে। মেয়েটিকে একান্ত নিভৃতে পেতে চায় ছেলেটি। তাকে আদর করতে চায়। ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে চায়। এরই নাম বুঝি ভালোবাসা! মেয়েটির কাছে যেতে সাহস পায় না ছেলেটি।
একটি চিঠি পায় ছেলেটি। লিখেছে একটা মেয়ে। নাম বৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে। ধনীর দুলালী। ভাবের অতলে ডুবে যায় ছেলেটি। মেয়েটিকে অনেক দিন ধরে দেখে আসছে সে। বন্ধুরা অনেকেই ওকে ভালোবাসতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ উৎসবে মেয়েটি গেয়েছিল। ভালো গলা!
ইদানীং একটি ছেলেকে দারুন ভালো লাগে। দিনরাত ছেলেটির কথা ভাবে মেয়েটি। ওর চলন, কথা বলা, হাসি, পোশাক পরা সবই ভালো লাগে। ওর নামটা জানে না সে; কিন্তু চেনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনেই নজরে পড়েছিল ছেলেটি। ‘নবীনবরণ’ উৎসবে ছেলেটিকে দেখেছে। সেই থেকেই ছেলেটি মেয়েটির মনের আসনটি দখল করে আছে। ছেলেটিকে একান্ত নিভৃতে পেতে চায় মেয়েটি। তাকে আদর করতে চায়। ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে চায়। এরই নাম বুঝি ভালোবাসা! ছেলেটির কাছে যেতে সাহস পায় না মেয়েটি।
একটি চিঠি পায় মেয়েটি। লিখেছে একটা ছেলে। নাম বাদল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিকস নিয়ে পড়ে। ধনীর দুলাল। ভাবের অতলে ডুবে যায় মেয়েটি। ছেলেটিকে অনেক দিন ধরে দেখে আসছে সে। বান্ধবীরা অনেকেই ওকে ভালোবাসতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ উৎসবে ছেলেটি কবিতা আবৃতি করেছিল। ভালো আবৃতি করে!
ছেলেটির সামনে পরীক্ষা। স্বাভাবিক নিয়মেই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে। তা ছাড়া এ পরীক্ষার ওপরই নির্ভর করছে ওর ভবিষ্যৎ। ওর সব আশা–আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ, সাধনার প্রতিফলন ঘটবে সামনের এ পরীক্ষায়। মা-বাবার স্বপ্ন, সাধনার যথার্থ মূল্য দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য, বিদেশ যেতে হবে। ভালো একটি চাকরি ধরতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, মা-বাবাকে ধন্য করতে হবে।
লেখাপড়ার এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওই মেয়েকে ভোলেনি ছেলেটি। স্পর্ধাশীল এই মেয়ে, ছেলেটির মন আচ্ছন্ন করে আছে! বলিহারি, কী তার অধিকার! এমনই এক স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে ছেলেটি ভাবনায় ডুবে থাকে। মনের অতলান্তে, ভালোবাসার ঢেউ গুনে যায়। নিত্য প্রভাত ও সাঁঝে উদয়াস্তের খেলা দেখে। আকাশে মেঘ ও নীলের অনন্ত লুকোচুরির খেলা দেখে। ভালোবাসার আরশিতে নিজের পাশে আর একটি ছায়া খুঁজে ফেরে। চাতক তার চাতকীকে কাছে ডাকে।
মেয়েটির সামনে পরীক্ষা। স্বাভাবিক নিয়মেই পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে। তা ছাড়া এ পরীক্ষার ওপরই নির্ভর করছে ওর ভবিষ্যৎ। ওর সব আশা–আকাঙ্ক্ষা, ত্যাগ ও সাধনার প্রতিফলন ঘটবে সামনের এ পরীক্ষায়। মা-বাবার স্বপ্ন, সাধনার যথার্থ মূল্য দিতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য, বিদেশ যেতে হবে। ভালো একটি চাকরি ধরতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, বাবাকে ধন্য করতে হবে।
লেখাপড়ার এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওই ছেলেকে ভোলেনি মেয়েটি। এমন এক স্পর্ধাশীল ছেলে, মেয়েটির মন আচ্ছন্ন করে আছে! বলিহারি, কী তার অধিকার! এমনই এক স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে মেয়েটি ভাবনায় ডুবে থাকে। মনের অতলান্তে, ভালোবাসার ঢেউ গুনে যায়। নিত্য প্রভাতে ও সাঁঝে উদয়াস্তের খেলা দেখে। আকাশে মেঘ ও নীলের অনন্ত লুকোচুরির খেলা দেখে। ভালোবাসার আরশিতে নিজের পাশে আর একটি ছায়া খুঁজে ফেরে। চাতকি তার চাতককে কাছে ডাকে।
৩.
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পর্ব শেষ। মনকে একঘেয়েমির জাল থেকে মুক্ত করার জন্য, ছাত্র-ছাত্রীরা বেরিয়ে পড়ে। কেউ যায় বিদেশ ভ্রমণে। কেউ যায় বনভোজনে। আবার কেউ কেউ পা বাড়ায়, শৈশবের মধুর স্মৃতিঘেরা সবুজ শ্যামলিমা বৈচিত্রে৵র লীলাভূমি গ্রামের দিকে। গ্রামের সেই অবারিত নীলের আকাশ খুঁজে ফেরে পুরোনো বন্ধুদের। সেই কলতানমুখর নদী অহরহ হাতছানি দিয়ে ডাকে অতীতকে। ঘন লতাপাতাঘেরা বনানী, লুকোচুরি খেলার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকে আগের সেই শিশুদের।
পুরোনো দিনের স্মৃতিময় সেই গ্রামকে, নতুন করে আবার স্পর্শ করতে চায় ছেলেটি। তাই পিচঢালা পথ ছাড়িয়ে মেঠোপথে পা রাখে সে। একরাশ ধুলার অন্ধকারে মিশে যায় সে। তা–ও ভালো লাগে ছেলেটির কাছে। এখানে শিশিরেরা আদর করে সবুজ পল্লবদলকে সিক্ত করে দেয়। এখানে সূর্যটা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ধানগাছের শিষে শিষে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে আকাশচুম্বী বাঁশঝাড়গুলো সোল্লাসে স্বাগত জানায়। পথের ধুলার সোঁদাগন্ধে মাতম হয়ে যায় ছেলেটি। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের কৃত্রিমতা নেই। নেই বাগানে ফুল ফোটানোর প্রয়াস। এখানে ভ্রমরেরা দল বেঁধে, পুষ্প থেকে পুষ্পকুঞ্জে প্রাণের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। নববসন্তের কিশলয়, পরাগ ছড়িয়ে দেয় আকাশে–বাতাসে। লঞ্চে বসে, প্রকৃতির মধে৵ ডুবে যায় ছেলেটি।
বৃষ্টির চিঠিখানা চোখের সামনে মেলে ধরে। বারবার পড়ে। যৌবনবসন্তকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই বৃষ্টি, তার যৌবনধজা উড়িয়ে ছেলেটিকে ভালোবাসতে চেয়েছে। ছেলেটি কি তাকে ফিরিয়ে দেবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বন্ধুর প্রেমের রানী, তার পাণি গ্রহণে উদ্যত। সে কি ফিরিয়ে দেবে তাকে? তার মনের আয়নায়, দাঁড়ি-গোঁফওয়ালা পাশের ছায়াটির বিকল্প এই সুদর্শনা বৃষ্টি কি আসবে তার জীবনে? চাতক কি খুঁজে পাবে তার চাতকীকে? সৈকতের উদ্যত স্ফীত ঢেউয়ের মতো লাফিয়ে ওঠে ছেলেটির মন।
পুরোনো দিনের স্মৃতিময় সেই গ্রামকে নতুন করে আবার স্পর্শ করতে চায় মেয়েটি। তাই পিচঢালা পথ ছাড়িয়ে মেঠোপথে পা রাখে সে। একরাশ ধুলোর অন্ধকারে মিশে যায় সে। তা–ও ভালো লাগে মেয়েটির কাছে। এখনে সূর্যাস্তের রক্তাক্ত প্রেম আদরে আদরে আপ্লুত করে দেয় সবুজ পৃথিবীকে। এখানে সূর্যটা মেঘের সঙ্গে, ভালোবাসার নীলে খেলে দেওয়া-নেওয়ার খেলা। এখানে আকাশচুম্বী তাল-তমাল ডানা নাড়িয়ে তাকে জানায় সাদর সম্ভাষণ। পথের ধুলার সোনালি আস্তরণে ডুবে যেতে চায় মেয়েটি। এখানে শহরের কৃত্রিমতা নেই। আছে গ্রামের নিত্য স্বাভাবিক দেশি ফুলের অপূর্ব সমাহার। এখানে ফুলেরা দল মেলে অপেক্ষা করে ভ্রমরের। নবযৌবনের উষার দিগন্তে দাঁড়িয়ে, কামনায় উদ্যত অরুণ চুম্বনে চুম্বনে রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। ট্রেনে বসে, প্রকৃতির মধে৵ ডুবে যেতে চায় মেয়েটি।
বাদলের চিঠিখানা চোখের সামনে মেলে ধরে। বারবার পড়ে। যৌবনবসন্তকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এই বাদল, তার যৌবনধজা উড়িয়ে মেয়েটিকে ভালোবাসতে চেয়েছে। মেয়েটি কি তাকে ফিরিয়ে দেবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বান্ধবীদের প্রেমের রাজা, তার পাণি গ্রহণে উদ্যত। সে কি ফিরিয়ে দেবে তাকে? তার মনের আরশিতে, কালোকেশী ‘ক্লিওপেট্রার পাশের ছায়াটির বিকল্প, এই সুদর্শন বাদল কি আসবে তার জীবনে? চাতকী কি খুঁজে পাবে তার চাতককে? সৈকতের উদ্যত স্ফীত ঢেউয়ের মতো লাফিয়ে ওঠে মেয়েটির মন।
এক জায়গায় এসে হঠাৎ থেমে যায় ছেলেটি। এ কে? সে অবাক হয়ে ভাবে, তার কল্পনার রানি, দুরান্তের চাতকী আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে! বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে যাকে অহরহ খুঁজে ফিরত— সেই মেয়ে তার একান্ত কাছে! আচ্ছা, সে এখানে কেন? বৃষ্টির কথা মনে পড়ে। নাহ্। বৃষ্টির চেয়ে আরও বেশি সুন্দরী। কল্পনার আয়নায় দেখা সেই ‘ক্লিওপেট্রা’ আজ বাস্তবে তার সামনে দাঁড়িয়ে!
এক জায়গায় এসে হঠাৎ থেমে যায় মেয়েটিও। এ কে? সে অবাক হয়ে ভাবে, তার কল্পনার রাজা, দূরান্তের চাতক আজ তারই সামনে দাঁড়িয়ে! বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে যাকে অহরহ খুঁজে ফিরত—এই সেই ছেলে তার একান্ত কাছে! আচ্ছা, সে এখানে কেন? বাদলের কথা মনে পড়ে। নাহ্। বাদলের চেয়ে আরও বেশি সুন্দর! কল্পনার আয়নায় দেখা সেই ‘সিজার’ আজ বাস্তবে তার সামনে দাঁড়িয়ে!
পরস্পরের দিকে বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা।
এগিয়ে যায় ছেলেটি।
এগিয়ে আসে মেয়েটি।
চারটি চোখের দৃষ্টি, একবিন্দুতে মিলে গেল!
ওরা আরও কাছে এগিয়ে এলো। আরও কাছে। আরও কাছে ...। এ সময় শৈশবের স্মৃতি ওদের দুজনকে রাঙিয়ে দিল! ওরা পরস্পর হেসে উঠল একসঙ্গে। ওদের দুজনের ঠোঁট কেঁপে ওঠে।
ছেলেটি বলে, ‘আমার নাম গোলাপ। আমি তোমার! তুমি আমার!’
মেয়েটি বলে, ‘আমার নাম জবা। আমিও তোমার! তুমিও আমার!’
গোলাপ ও জবা ওরা দুজনই এখন সেই অতীত পাঠশালার ছাত্র-ছাত্রী!
৪.
ফিজিকসের অধ্যাপক গোলাপ এবং কেমিস্ট্রির অধ্যাপক জবা, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবনা, এখন তাঁদের নিত্যদিনের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের হাতে এখন অঢেল সময়! তাঁরা দুজন একই পাঠশালায় দাঁড়িয়ে, তাঁদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান।
‘এই গোলাপ দেখ! সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়! ওমা! আমরা তো খেয়ালই করিনি!’
‘তাই তো জবা! চল, চল।’
‘ভেবেছ? আমাদের জীবনের সূর্যও কিন্তু অনেক হেলে পড়েছে!’
‘তা ঠিক। তবে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই আমাদের সেই ছেলে এবং সেই মেয়েটির জীবনের লেনাদেনার বাকি কাজটি সেরে ফেলতে হবে!’
ঘরে চল তো। সেই হিসাবটা সেরে নিতে হবে আগে। তারপর জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে বাকিটা …!’
পার্ক থেকে বেরিয়ে দুজন, গাড়িতে চেপে বসেন। গাড়ি ছুটে চলেছে তাঁদের নিজেদের ///////কুলার//////// দিকে।