'ডুয়ানি'র নতুন বছর উদ্‌যাপন ও গেট টুগেদার

নিউ ইংল্যান্ডে ঘন তুষারপাত ও হিম ঠান্ডায় যখন জমে যাওয়ার মতো অবস্থা, তখন একেবারে ঘরে বসে শুধুই কি টিভি চ্যানেলগুলো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এদিক–সেদিক লেফট–রাইটে টিপে টিপে সময় কাটানো যায়? সকালের সেই ঠান্ডা উপেক্ষা করে গাড়ি হাঁকিয়ে কিংবা ট্রেনে অফিসমুখী যাত্রা, নতুবা ব্যবসা বা বাণিজ্য অভিমুখে ছুটে চলা দৈনন্দিন কাজ। এরই মধ্যে সবাই মিলে বিদেশ বিভূঁইয়ে এক জায়গায় একত্রে আড্ডা দেওয়া একেবারেই মন্দ নয়, বরং একচিলতে হলেও সাঁঝের আনন্দ দেয় বৈকি।

তাই তো গত ২১ জানুয়ারি স্থানীয় সময় (ইস্টার্ন) বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিশাল জনাকীর্ণ পরিবেশে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালমনাই অ্যাসোসিয়েশন অব নিউ ইংল্যান্ড (ডুয়ানি) আয়োজিত নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন ও উইন্টার গেট টুগেদার অনুষ্ঠিত হয়। গ্রেটার বোস্টনের নর্থ রিডিংয়ের অ্যালডার্সগেট চার্চে জাঁকজমকপূর্ণ এ অনুষ্ঠানের শুরু হয় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। তিলাওয়াত করেন ডুয়ানির পাবলিক কমিউনিটি ও এক্সটারনাল রিলেশন সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান।

কোরআন তিলাওয়াতের পরপরই একটি শোক প্রস্তাব আনেন ডুয়ানির মিডিয়া ও কমিউনিকেশন্স সেক্রেটারি রাহিদুর রহমান। কদিন আগেই (৪ জানুয়ারি) গ্রেটার বোস্টনের ক্যামব্রিজ শহরে সায়েদ ফয়সাল নামের মাত্র ২০ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি তরুণ ক্যামব্রিজ শহরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ফয়সাল তাঁর পরিবারের সঙ্গে ক্যামব্রিজ শহরে থেকে পড়াশোনা করতেন। ফয়সাল ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে (বোস্টন ক্যাম্পাস) কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। উদীয়মান তরুণ ফয়সালের আলোকিত জীবন এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হঠাৎ নিভে যাবে পুলিশের গুলিতে, তা যেন কেউ মেনে নিতে পারেননি। ফয়সালের এভাবে চলে যাওয়ায় তাই স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তাই তো ফয়সালের স্মরণে ও তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ডুয়ানির এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।

অনুষ্ঠানের উপস্থাপক কামরুল হাসান শুভ্র এরপর অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ডুয়ানির জেনারেল সেক্রেটারি মো. রওশন আলমকে। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ২০২২ সালের ডুয়ানির কাজগুলো তুলে ধরেন এবং ২০২৩ সালে ডুয়ানি আরও কী কী কাজ করতে পারে, তা তুলে ধরেন। ২০২২ সালে ডুয়ানি আয়োজিত উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসিত কাজগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে তিনটি এডুকেশনাল সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। টাইটেলগুলো ছিল (ক) ইলিশ মাছের জিনোম সিকুয়েন্সিং (স্পিকারঃ QIAGEN ফার্মাসিউটিক্যালসের গবেষক ও ডুয়ানির সদস্য মং সানু মারমা), (খ) কোভিড-১৯ এবং ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্টস (স্পিকার: বায়োএনটেকের সায়েন্টিস্ট ও ডুয়ানির এডুকেশনাল সেক্রেটারি∙জাকারিয়া খন্দকার), (গ) হেলদি লিভিং: নো পিলস & প্রিক্স (স্পিকার: Mass General Hospital–এর গবেষক (রিটায়ার্ড) ও ডুয়ানির ট্রেজারার নূর মুহাম্মদ)। ২৬ মার্চ স্বাধীনতাদিবস উদ্‌যাপন, ঈদ পুনর্মিলনী এবং ঢাবির শতবর্ষ পালন, সাউথ বোস্টনের ক্যাসল আইল্যান্ডে বাৎসরিক পিকনিক আয়োজন, ডুয়ানির লাইফ মেম্বার ৬ থেকে ১৭–তে উন্নয়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে একটি কমিটি গঠন ছিল উল্লেখযোগ্য।

এরপর সবাই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ও আমেরিকার জাতীয় সংগীত সমবেতভাবে পরিবেশন করা হয় ডুয়ানির কালচারাল সেক্রেটারি ফৌজিয়া খানম শিল্পীর তত্ত্বাবধানে।
মূল অনুষ্ঠানটি সাজানো ছিল তিনটি পর্বে। ১. বোস্টনসহ নিউ ইংল্যান্ডে বসবাসরত প্রাক্তন ঢাবি স্টুডেন্টদের সুমধুর ক্যাম্পাস স্মৃতিচারণা। ২. ডুয়ানির লাইফ মেম্বারদের সার্টিফিকেট বিতরণ এবং ৩. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জেনারেশনের ১২ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী তাঁদের সুমধুর ক্যাম্পাস–স্মৃতিচারণা তুলে ধরেন। স্বাধীনতার আগের ও পরের জেনারেশনের ঢাবিতে পড়াকালীন সময়ে তাঁদের যে অনুভূতি এবং দুঃখ-বেদনা-আনন্দ মিলে যে সুখের স্মৃতি—তা গভীর মনোযোগ সহকারে ‘চা ও টা’–এর সঙ্গে উপস্থিত স্রোতারা পিনপতন নীরবতায় শ্রবণ করেন। সম্মানিত স্মৃতিচারণাকারীরা হলেন নিউইংল্যান্ডে বসবাসরত এ  কে এম রেজাউল করিম, আবদুল্লাহ শিবলি, বামন দাস, জামাল খান, মাহমুদ আখতার, মো. শরীফ আহমেদ, ফরিদুর রহমান মিলটন, শাহিদা রহমান, আরাফাত-ই-জাহান কস্তূরী, নাজদা আলম, কাজী এম নুরুজ্জামান ও শরিফুল ইসলাম শিপন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় ধাপে মোট ১৭ জন লাইফ মেম্বারের মধ্যে উপস্থিত ১০ জনকে ডুয়ানির ‘লাইফ মেম্বার’ সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। লাইফ মেম্বারদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেন ডুয়ানির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডুয়ানির সৃষ্টিলগ্ন (২০১১ থেকে) থেকে জড়িত বোস্টনের পরিচিত মুখ মো. নকীব উদ্দিন। ডুয়ানির শর্তপূরণ করে যাঁরা লাইফ মেম্বার হয়েছেন, তাঁরা হলেন এ কে এম রেজাউল করিম, আকরাম ভূঁইয়া, ইসমাত-ই-হাকিম, মো. আকমল হোসেন, মোহাম্মেদ এ হাকিম, সৈয়দ বদরে আলম সাইফুল, অধ্যাপক এম শওকত আনোয়ার,∙মোহাম্মেদ রওশন আলম, মমিন কে উদ্দিন, আজাদ হোসেন, মো. নকীব উদ্দিন, শাহিদা রহমান, মুয়াজ্জেম এইচ কাজী (মাসুম), সাজ্জাদ হুসাইন (লিটন), জাকারিয়া খন্দকার, ফৌজিয়া খানম শিল্পী ও রাহিদুর রহমান।

অনুষ্ঠানের তৃতীয় ধাপটি ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও আকর্ষণীয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ডুয়ানির কালচারাল সেক্রেটারি ফৌজিয়া খানম শিল্পী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজানো ছিল গানে (পরিবেশন করেন সুকণ্ঠী প্রিয়তা, আবদুল্লাহ শিবলি ও মিসেস রুমি), কবিতায় (পাঠ করেন মাসরুর, জহিরুল ভূঁইয়া মুকুল ও আকরাম ভূঁইয়া), যন্ত্রসংগীত (বাজনা বাজান মাহিবা, বর্ণীল ও সপ্তর্ষি) এবং পুঁথি পাঠের (পাঠ করেন জাকারিয়া খন্দকার) মাধ্যমে—যা ডুয়ানির সদস্যরা তাঁদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে উপভোগ করেন।

কয়েক ঘণ্টার এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধীজনদের ‘চা ও টা’–এর পাশাপাশি বোস্টনের বহুল পরিচিত বাঙালি সুস্বাদু খাবারের রেস্তোরাঁ ফুডল্যান্ড থেকে আগত ডিনার ও ডেজার্ট পরিবেশন করা হয়।

এখানে বলে রাখা ভালো যে ডুয়ানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গ্র্যাজুয়েটদের সংগঠন। মূলত আমেরিকার পূর্ব উপকূলের নিউ ইংল্যান্ডে অবস্থিত ছয়টি অঙ্গরাজ্যকে (ম্যাসাচুসেটস, কানেকটিকাট, রোড আইল্যান্ড, নিউ হ্যাম্পশায়ার, মেইন, ও ভারমন্ট) ঘিরেই এর পরিধি। অলাভজনক, অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই সংগঠনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ঢাবির প্রাক্তন গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ইন্টেলেকচুয়াল ভাবের আদান-প্রদান ও সুসম্পর্ক স্থাপন।

বিজ্ঞপ্তি