মুক্তিযুদ্ধ ও মমতার গল্প

ফাইল ছবি

মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি, আহত ব্যক্তিদের সীমাহীন কষ্টযন্ত্রণা ও বীরত্বের কাহিনি তো আছেই, এ ছাড়া একজন যোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনে বা জনপদে সাধারণ নারী বা মেয়েদের কোনো মনছোঁয়া কাজ বা সহযোগিতার কথা কি আপনার মনে পড়ে?

যোদ্ধা বলে উঠলেন—

পুরো দেশটাই ছিল রণক্ষেত্র, আমাদের যুদ্ধটা ছিল জনযুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তবে গুটিকয় দুষ্টু স্বার্থপর আর কতিপয় বোকা ছাড়া প্রায় সবাই নানাভাবে যোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

—ঠিক তা–ই, আপনারা যাঁরা গেরিলা যোদ্ধা, আপনাদের নানাভাবে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসতেই হতো। তখন নারীরা কীভাবে সাহায্য করতেন?

—তাঁরাও মায়ের স্নেহে, বোনের মমতায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যেমন যত আচমকা, যত অসময়ে আমরা কোন বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উঠেছি অতি তাড়াতাড়ি বাড়ির মেয়েরা আমাদের জন্য খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হতেন। অবাক লাগে ভাবতে গ্রামাঞ্চলে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র মেয়েরা কীভাবে নিমিষে কোথায় যে নিয়ে লুকিয়ে রাখতেন, সময়মতো সেগুলো আবার আমাদের হাতে তুলে দিতেন।

—এমন সব ঘটনা প্রায় সব যোদ্ধাদের স্মৃতিতে আছে, আপনার স্মৃতিতে এমন কোনো ঘটনা আছে কি, যা আপনাকে আজও মাঝেমধ্যে ভাবায়?

যোদ্ধা একটু যেন উদাস হলেন

—একটা ঘটনা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে আর ওই মেয়েদের মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখিনি বলে একটা কষ্টে ভুগি। তাঁরা ছিলেন তিনজন। একজন নারী ও দুটি বালিকা। মাঝরাতে তাঁরা মায়ের স্নেহে, বোনের মমতায় যে আতিথেয়তায় আমাদের ছুঁয়েছিলেন, তা ভাষায় বুঝিয়ে বলা বড় কঠিন। কেন তাঁদের চেহারা মনে রাখিনি ভাবতে খারাপ লাগে। এর পেছনে কারণ আছে।

—কেন? কী কারণ বলুন তো?

—সারাদিন অনেক পথ হেঁটে মাঝরাতে আমরা গ্রামে ঢুকছিলাম। রাজধানীতে এক অপারেশনে যাওয়ার পথে ওই গ্রামে রাত কাটাব সবাই। আমরা ছিলাম অসম্ভব ক্লান্ত তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। ক্লান্তি আর ক্ষুধাতে চোখ বুজে আসছিল। চোখ মেলে চেয়ে থাকাও ছিল কষ্টের। কীভাবে গ্রামে পৌঁছলাম সেও এক লড়াই। বলছি তা।

সময়টা আগস্টের শেষ কি সেপ্টেম্বরের শুরু। রাত নামছে চারপাশ অন্ধকার করে। আকাশে চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে আবার লুকিয়ে যাচ্ছে। পাঁচজন তরুণ সেই প্রায় অন্ধকার রাত্রে হাঁটছে আর হাঁটছে। শস্যখেতের ভেজা ভেজা মাটি মাড়িয়ে, কখনো কখনো–বা কাদায় ডেবে যাওয়া পা টেনে বের করে করে পা ফেলতে হচ্ছে তাঁদের। খেতের আইলে ওঠা চলবে না, যেখানে ইট বিছানো সড়ক আছে তাতেও হাঁটা যাবে না। চোখ–কান খোলা রেখে কাঁধের ঝোলা সামলে নিজেকে ধানখেতে ডুবিয়ে রেখে খুব সতর্কভাবে সামনে এগুচ্ছেন তাঁরা। বয়স তাঁদের ২০ থেকে ৩০ এর মাঝামাঝি। প্রত্যেকের পিঠে একটি করে ঝোলা, প্রয়োজনীয় টুকটাক কিছু কিছু জিনিস তো আছেই ঝোলাতে। এখন রাস্তা দুর্গম বলে পায়ের জুতাজোড়াও ঠাঁই পেয়েছে এতে।

ধানখেত, পাটখেতের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে সতর্কভবে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। রাস্তা ভুল যাতে না হয়, সে জন্য আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী দূরের থেকে কেউ একজন শিস দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। কান খাড়া রেখে সে শিস শুনে রাস্তার নিশানা ঠিক রেখে চলতে হচ্ছে।

ছবিটি ড. মফিজুল্লাহ কবীরের বই Experiences of an Exile at Home: Lifein Occupied Bangladesh থেকে গৃহীত

‘তারপর ধানখেত ছেড়ে আমরা গ্রামের শেষ সীমায় এক বাড়ির উঠানে পৌঁছলাম। আশপাশে আর কোনো ঘরবাড়ি দেখা গেল না। তখন প্রায় মাঝরাত। লেপাপোছা মাটির বারান্দায় টিমটিম হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে। আমাদের সবার প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুর ওপর তোলা। পায়ের পাতা থেকে গোছ পর্যন্ত কাদায় ঢাকা। এমন সময় পাশের খড়ের ছাউনি দেওয়া পাকের ঘর থেকে এক নারী বের হয়ে আসলেন। এক প্যাঁচ দিয়ে পরা শাড়ি মাথায় আঁচল। সেই আঁচলের খোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন যাতে মাথা থেকে আঁচল খসে না যায়। নারী মৃদু কণ্ঠে কাদের যেন ডাকলেন। পাকের ঘর থেকে দুটি মেয়ে সুর সুর করে বেরিয়ে এল। তারা ১২ কি ১৩ বছরের দুজন। মাথায় আঁচল নারী প্রায় শোনা যায় না—এমন কণ্ঠে কিছু বললেন তাঁদের। ওরা দুজন খড়ের ঘর থেকে দুটি কলসি নিয়ে কোথায় যেন গেল। নারী নিজে একটি জলচৌকি এনে বারান্দার কাছে রাখলেন। আমাদের বললেন, ‘আপনারা বারান্দায় বসে জলচৌকিতে পা রাখেন। আমার মেয়েরা পানি আনতে গেছে পা ধোবেন।’ তখন বারান্দার অন্য ধারে চাটাই বিছিয়ে টুকরিতে করে গরম ভাত, হাঁড়িতে ডাল এনে রাখলেন একজন লোক। তিন দিন পর ভাতের গন্ধে আমরা ভীষণ ব্যাকুল। এদিকে পাভর্তি কাদা। কাদা না ধুয়ে স্বস্তি বা আরাম লাগবে না। এমন সময় মেয়ে দুটি কলসি নিয়ে ফিরল। আমাদের গেরিলা কমান্ডার বারান্দায় বসে জলচৌকিতে পা রাখতেই মেয়েরা কলসি থেকে টিনের মগে পানি নিয়ে নিয়ে পায়ে ঢালতে লাগল। যোদ্ধারা একে একে হাত দিয়ে ঘষে ঘষে কাদামাখা পা পরিষ্কার করলেন। কারও মুখে কোনো কথা নাই। চারদিকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ, যার যখনই পা ধোঁয়া শেষ হচ্ছে, সেই চাটাইতে গিয়ে খেতে বসছে। আমি ছিলাম দলে সর্বকনিষ্ঠ। সবাই আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন, আমি তাঁদের সম্মান করতাম, ভালোবাসতাম। তবে ওই রাতে সবাই এত ক্ষুধার্ত ছিলেন যে গরম ভাত তাঁদের তীব্রভাবে যেন ডাকছিল। সবার শেষে আমি জলচৌকিতে পা তুলে বসলাম। মেয়ে দুটি পানি ঢালছিল। আমার পায়ে কাদা ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে সবার খাওয়া দেখতে চাইছি বারবার। আমিও তো ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির। আমি এত ক্লান্ত ছিলাম যে হাত দিয়ে পায়ের কাদা ঘষে তোলার শক্তি ছিল না আমার। দুই হাত মাটিতে ঠেকিয়ে পেছনে শরীর এলিয়ে বসে আছি। তারা পানি ঢালছে পায়ে।  হঠাৎ পায়ে কারওর হাতের ছোঁয়ায় তাকালাম। দেখি ছোট্ট একজন মেয়েকে মাথায় আঁচল নারী পায়ের কাদাগুলো তুলতে নির্দেশ দিচ্ছেন। মেয়েটিও তার মায়ের কথা শুনে হাত দিয়ে আমার পায়ের কাদা ধুয়ে–মুছে পরিষ্কার করে দিল। পা ধোয়া হতেই আমিও চট করে চাটাইতে গিয়ে খেতে বসে গেলাম। ছোট মেয়ে দুটিকে ধন্যবাদ বলা বা মাথায় আঁচল নারীকে সালাম দেওয়া সুযোগ পেলাম না। ভাত, ডাল ও সামান্য সবজি তা–ও তখন অমৃত মনে হচ্ছিল। তখনি ঘটল এক ঘটনা। ঘরের পেছন দিক থেকে ঝপাং করে পানিতে কেউ পড়ল মনে হলো।

—আপনারা!  আপনারা তখন কি করলেন?

—আমরা  সবাই ভাতের থালা রেখে শত্রুর মোকাবিলায় উঠে দাঁড়ালাম

—আপনারা তো ক্লান্ত ছিলেন

—ঠিক তা–ই, তবে দেশ যখন ডাক দেয়, তখন সব ক্লান্তি তুড়ি মেরে দূরে ঠেলে দিতে হয়। আমরা তাই করতে পারলাম, সত্যি পেরেছিলাম!

—তারপর?

—বাড়ির কর্তা হাত ইশারায় আমাদের বসতে বললেন, নিচু গলায় বললেন, ‘বাবারা শত্রু নয়, আমার পিছ পুকুরে বড় মাছ ঝাপ দিয়েছে, তোমরা খাও’। ওই মুহূর্তে আমাদের কাছে এর চেয়ে শান্তির কথা, এমন মধুর বাণী আর কিছু হতে পারে না।

তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ক্ষুধা মিটল। পায়েও কাদা নেই আর। আহ্‌ কী স্বস্থি! এবার মনে হলো ওই মাথায় আঁচল নারী ও মেয়ে দুটির সঙ্গে একটু কথা বলি। কী বলব, তা–ও জানি না। তবু মনে হলো এত মায়াময় যাদের ব্যবহার, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে আমার ভালো লাগবে। হতাশা এই যে সে রাতে তো নয়ই আর কখনোই, কোনো দিন তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। গ্রামটার নাম সম্ভবত বেলাবো ছিল। তাই হবে মনে হয়। মায়ের যত্ন, বোনের স্নেহমমতা পয়সা দিয়ে কেনা যায় না, এর কোনো দাম হয় না। শত্রুঘেরা যুদ্ধের সে রাতে আমরা কজন শ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যে অমূল্য সেই মমতা জুটেছিল। সেই মায়াভরা মুখ বা চেহারা মনে করতে পারি না বলে বুকের মধ্যে আজও কষ্ট হয়।’

মুক্তিযুদ্ধের বহু বছর পর মেলবোর্নে এক ঘরোয়া আড্ডায় মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেনের মুখে শোনা ঘটনা আপন ভাবনার তুলি বুলিয়ে সে রাতের ছবিটি  এখানে তুলে ধরা  হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের জীবনসঙ্গী।

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]