আগুনে মৃত্যুর দোষটা আসলে কার
রমজান মাস আর মাত্র কয়েক দিন দূরত্বে আছে, এরই মধ্যে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমাদের অর্ধশত ভাইবোন ওপারে চলে গেলেন। এরই মধ্যে এক সুরায় আবার শোয়াইব (আ.) নবীর উম্মতের কাহিনি পড়ছিলাম।
হঠাৎ মনে হলো, এসব কি নিতান্তই কাকতালীয়? আমি বিশ্বাস করি, কাকতালীয় বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সবই আন্তসম্পর্কিত। আমরাই মূর্খ, চিন্তাভাবনা করি না বলে লিংক ধরতে পারি না। আমাদের মস্তিষ্কের আকৃতি অতি ক্ষুদ্র, সেই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের রাডারে মহাবিশ্বের পরিচালকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সমীকরণ ধরা না পড়াটাই স্বাভাবিক।
আমার এক বড় ভাইয়ের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। তিনি তখন প্রথম আমেরিকা এসেছেন। মহা আনন্দে ডাউনলোড করে সিনেমা দেখেন। তাঁর রুমমেট একজন আমেরিকান। ওই বেকুবটা কষ্ট করে পয়সা খরচ করে থিয়েটারে সিনেমা দেখতে যায়। তিনি তাঁর বন্ধুর উপকার করতে বললেন, ‘এই যে এভাবে ডাউনলোড করলে তুমি বিনা পয়সায় ঘরে বসেই এইচডি কোয়ালিটির সিনেমা দেখতে পারবে।’
ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘কিন্তু এইটাই কি পাইরেসি না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু কারই বা ক্ষতি হচ্ছে?’
বন্ধুটা তখন বলে, ‘কারও না কারও তো ক্ষতি ঠিকই হচ্ছে। কী দরকার এইভাবে “চুরি” করে?’
বড় ভাই মানসিকভাবে তীব্র আঘাত পেলেন। তিনি এই অ্যাঙ্গেলে কল্পনাই করেননি। আসলেই তো তিনি চুরি করছেন। অন্যের সম্পদ বিনা পয়সায় বিনা অনুমতিতে ভোগ করছেন। এত দিন তিনি, তাঁর বন্ধুবান্ধব, তাঁর দেশবাসী—সবাই চুরিই করে এসেছে। সফটওয়্যার থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি সিনেমা, কোনো ক্ষেত্রে আমরা অরিজিনালটা ব্যবহার করি? খুবই নির্বিকারভাবে আমরা ফেসবুকে পোস্ট দিই, ‘অমুক সিনেমার ডাউনলোড লিংক আছে?’
অনেক বন্ধুবান্ধব সেসব লিংক দিয়ে কমেন্ট ভরে ফেলেন।
পাইরেসির কারণে কী ক্ষতি হতে পারে, সেটার উদাহরণ আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, প্রিন্স মাহমুদ, হাসানসহ অন্য বড় বড় কিংবদন্তি ব্যান্ডশিল্পীরা যখন তাঁদের প্রাইমে, যাঁরা প্রতি মাসেই একটা করে নতুন গান উপহার দিতেন, তাঁরা নতুন কাজ বন্ধ করে দিলেন। কারণ, লোকে ক্যাসেট/সিডি কিনে না। পয়সা বাঁচাতে রেকর্ড করে ফেলে। এ ওর গান মেরে দিচ্ছে। বাউল শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে কিছু শিল্পী কোটিপতি হয়ে গেলেন, তিনি বেচারা সুনামগঞ্জের গ্রামেই ধুঁকে মরলেন। কপিরাইটের মাম্মি ড্যাডি। ওটার অস্তিত্ব আমাদের দেশে নেই।
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে আমাদের যে গর্ব, সেটা আরও হাজার গুণ বেশি সমৃদ্ধ হতো, যদি না আমরা সেই জোচ্চুরি না করতাম।
আমাদের তৃণমূল পর্যায়ে নৈতিকতার (এথিকস) অভাব আছে। আমরা বুঝতেই পারি না। ফকির থেকে কোটিপতি ব্যবসায়ী, মন্ত্রী কেউই এই ভাইরাসমুক্ত নই।
ধরেন আমার একটা জায়গা আছে। রেসিডেন্সিয়াল ভবনের লাইসেন্স নিতে আমার কম টাকা লাগবে, আর কমার্শিয়াল ভবনের অনুমতি নিতে একটু বেশি টাকা লাগবে। আমি রেসিডেন্সিয়াল ভবনের অনুমতি নিয়ে কমার্শিয়াল ভবন তৈরি করব।
অনুমতি নেব পাঁচতলার, বানাতে বানাতে সাত-দশতলা বানিয়ে ফেলব। ওপরে যত বেশি তলা হবে, তত লাভ।
ইমার্জেন্সি সিঁড়ি, সীমানা ও ভবনের মাঝখানে ফাঁকা ইত্যাদি নিয়ম মানতে গেলে তো লস। আমি দেয়ালঘেঁষে, অথবা দেয়ালের ওপরেই বাড়ি তুলে ফেলব। কিসের ইমার্জেন্সি সিঁড়ি? সেই ‘এক্সট্রা’ জায়গায় আরও কিছু দোকান তুলে দেব।
রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদির ঘাপলা নিয়ে আলাদা করে লিখতে চাইছি না।
ভাড়া দিতে শুরু করলাম।
বাংলাদেশে এখন নম্বর ওয়ান ব্যবসা রেস্তোরাঁ ব্যবসা। সবাই আমার স্পেসে রেস্তোরাঁ দিতে চায়। ভাড়া বেশি দিতে রাজি আছে। আমিও ভাড়া দিতে থাকব। একবারের জন্যও আমার বিবেক বলবে না এই ভবন রেস্তোরাঁর লোড নিতে পারবে না। হাজারো মানুষের রান্নার জন্য যে গ্যাসপাইপ প্রয়োজন, সেটা আমার ভবনে নেই।
উপায় হচ্ছে সিলিন্ডার।
সেই সিলিন্ডার থেকে গ্যাস চুলায় যাবে প্লাস্টিকের পাইপ করে, যে পাইপ সাধারণত পানির জন্য ব্যবহৃত হয়।
লক্ষ করুন, না সরকার, না ফায়ার সার্ভিস, না পুলিশ আমাকে মারধর করে জোর করে এসব দুর্নীতি করিয়েছে। পুরো কাজটা আমি ও ভাড়াটে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই স্বাধীনভাবে করেছি।
এভাবেই চলে সবকিছু।
শীতের দিনে পাড়ার ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলবে ইলেকট্রিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ চুরি করে।
গ্যাসের সংযোগ নেবে সরকারি গ্যাসলাইন ফুটো করে পাইপ ঢুকিয়ে নিজের বাড়ি পর্যন্ত টানিয়ে নেবে।
খাবার বিক্রি করবে, তো খাবারে ভেজাল মেশাবে। ওষুধ বিক্রি করবে, সেখানেও ভেজাল মেশাবে।
অমুকের বাড়ির গাছের লাউ তমুকে চুরি করবে। তরমুজ থেকে শুরু করে মাছের কানকো পর্যন্ত—সবকিছুতে আলগা রং ব্যবহার করবে।
‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড় ধরা!’—এ প্রবাদটা আমাদের দেশেরই না?
আপনি আমাকে বলেন, সরকার জোর করে এদের দিয়ে এসব করিয়েছে?
বলতেই পারেন, ‘সরকারের দায়িত্ব এসব ধরা।’
আমি যদি পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘কেন সরকারকেই ধরতে হবে? এর চেয়ে বহুগুণ সহজ কি এই না যে আমরা এমন কাজ করবই না? সৎভাবে বাঁচা কি এতটাই কঠিন?’
সিরিয়াসলি বলছি। আমি যদি কালকে জনতার সুবিধার জন্য একটি পাবলিক টয়লেট তৈরি করে দিই, দেখা যাবে প্রথম দিনেই সেই টয়লেট থেকে কেউ টয়লেট টিস্যু নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে।
তারপরে দেখবেন বালব নাই।
এরপর দেখবেন বেসিনের কল কেউ খুলে নিয়ে গেছে। পরের দিন আস্ত বেসিন গায়েব হয়ে যাবে।
রেলওয়ে বা মসজিদের টয়লেটে বদনার মতো ফালতু জিনিস চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কি আছে দুনিয়ায়? আমি–আপনি চুরি না করলে করেটা কে?
বাংলাদেশে নিউজ হয় ‘অমুক যাত্রীর হারানো ব্যাগ ফিরিয়ে দিলেন সিএনজিচালক।’
পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘এইটাই কি স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল না? টাকাটা তো সিএনজিচালকের বাপের ছিল না যে তিনি নিয়ে নেবেন। একজন সুনাগরিক হিসেবে ওর দায়িত্ব হচ্ছে কাস্টমারের ফেলে যাওয়া মাল পুলিশের কাছে জমা দেওয়া। যাতে কাস্টমার তাঁর হারানো মাল খুঁজতে থানায় এসে সহজে পেয়ে যান।
বরং সংবাদ শিরোনাম হওয়া উচিত ছিল, ‘প্যাসেঞ্জারের হারানো ব্যাগ নিয়ে চম্পট দিয়েছেন সিএনজিচালক!’
জাপানে আপনি ব্যাগ হারান, দেখবেন ঠিকই খুঁজে পেয়েছেন। আরবে সোনার দোকান ফেলে রেখে দোকানদার নামাজ পড়তে যান। আমাদের দেশে কেন বাসার ভেতর থেকেও শোপিস চুরি হয়ে যায়? সমস্যাটা কোথায়?
শুরুতেই বলেছিলাম, রমজান মাসের কয়েক দিন আগেই ঘটনা ঘটেছে এবং একই সঙ্গে শোয়াইব নবীর (আ.) উম্মতের ঘটনাটাও পড়ছিলাম। সংযোগটা হচ্ছে ‘তাকওয়ায়’।
আমাদের মুসলিমদের ধর্মের প্রধানতম স্তম্ভ হচ্ছে ইমান বা তাকওয়া অর্জন। তাকওয়া মানে হচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি, আমি মহাবিশ্বের যেকোনো এলাকায় লুকিয়ে থাকি না কেন, আমার প্রতিটা কর্মকাণ্ড আমার ওপরওয়ালা দেখছেন। তাকওয়া নেই মানে আমি মুসলিমই না।
রমজানে রোজা রাখা মূলত এই তাকওয়া অর্জনের ট্রেনিংই। আমি ইচ্ছা করলেই বিরিয়ানি খেতে পারি, কিন্তু এরপরও সারা দিন না খেয়ে থাকি। কারণ, ‘আমার রব আমাকে দেখছেন।’
বাংলাদেশিরা রোজাকে খুবই সিরিয়াসলি নেন। এই মাসে কেউ দিনের বেলা রেস্টুরেন্ট খোলা রাখলে মুসলিম জনতা সেই রেস্টুরেন্টের ওপর রুষ্ট হয়। তেড়ে যাওয়ার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে।
কিন্তু সেই জনতাই রমজানের মূল শিক্ষাটা নেয় না। তাকওয়া। যদি নিত, তাহলে আমরা পাইরেটেড কিছু ব্যবহার করতাম না, বিল্ডিং কোড মেনে চলতাম, দোকানে কাস্টমারকে ঠকাতাম না, কাস্টমার হয়ে দোকানদারকে ঠকাতাম না ইত্যাদি।
দুনিয়ার আর প্রতিটা মুসলিম দেশে (কাফের–নাসারার দেশের মুসলিম দোকানেও) দাম কমলেও রমজান মাসেই আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলে, মজুতদারেরা রমজান মাস, ঈদ ইত্যাদির ফায়দা তোলে।
এই হচ্ছে আমাদের ‘তাকওয়ার’ নমুনা।
অথচ ইসলাম নাজেলই হয়েছে যাতে আমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারি। এই যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, হজ, জাকাত, রোজা—সবই তো তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যেই। আমরা তাহলে ধর্মটাকে শুধুই একটা রিচুয়ালিস্টিক প্র্যাকটিসের মধ্যেই বন্দী করে রেখেছি।
ঘটনা এমন না যে দেশে শুধু মুসলিমরাই ঘটাচ্ছে আর বাকি অন্য ধর্মের বা নাস্তিক লোকেরা খুব সাধু।
নারে ভাই। উপমহাদেশের তিনটা দেশই মহা দুর্নীতিবাজ। আমাদের দুর্নীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্কই নেই। ওটা সামাজিক কারণে আমাদের রক্তের প্রতিটা অণুতে, প্রতিটা কোষে, অনুভবে আছে মিশে। এই একটা ক্ষেত্রে আস্তিক, নাস্তিক কোনো ভেদাভেদ নেই।
আর ওই যে ওপরে বড় ভাইয়ের ঘটনা বললাম, উনার আমেরিকান বন্ধুটা সুযোগ পেয়েও পাইরেটেড সিনেমা ডাউনলোড করে না। কাফের–নাসারা হলেও ওর ভেতরে সেই এথিকস, সেই ‘তাকওয়া’ ঠিকই আছে।
একজন সাধারণ আমেরিকান (যেকোনো উন্নত দেশ) দেখবেন গভীর রাতের ফাঁকা রাস্তাতেও ওরা ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলছে বা সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়ায় প্রচণ্ড জ্যামের মধ্যেও ফুটপাতে মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছে না।
বেশ কিছু বছর আগে আমাদের স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলন শুরু করেছিল, মনে আছে? লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালককে গাড়ি চালাতে দিচ্ছিল না, লেন মেইনটেইন করতে বাধ্য করছিল সবাইকে, আনফিট গাড়ি রাস্তায় নামতে দিচ্ছিল না।
আমাদের সাধারণ জনতা এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। নিয়মশৃঙ্খলা মানার অভ্যাসটাই যে আমাদের নেই!
যেই মুহূর্তে ওরা রাস্তা ছাড়ল, আবারও যেই লাউ সেই কদুই হয়ে গেল।
আজকে আমি সড়ক আইন ভঙ্গ করে কাউকে মারছি, কালকে অন্য কারও গাড়ির নিচে আমি পড়ব।
আমরা এভাবে অপঘাতে মরব না তো কে মরবে ভাইয়েরা ও বোনেরা? আগুন লাগার ঘটনা থেকে শুরু করে সব ঘটনাকে খুনও বলতে পারেন, আবার আত্মহত্যাও বলতে পারেন।
আমি যদি ভুল বলে থাকি, কমেন্ট করতে পারেন।
**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন প্রবাসের পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]