এমন একটা মা দে না

সন্তানের সঙ্গে মা। ছবি: এআই/প্রথম আলো

বিশ্ব মা দিবসের প্রাক্কালে পুলিশ অফিসার পলাশ চলে গেলেন। মা একটা অপরূপ শব্দ, একটা অনন‍্য সম্পর্ক, যেটা পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পর্কের একটা। নিজের জীবন বাজি রেখে মা সন্তানের জন্ম দেন, তিল তিল করে বড় করে তোলেন। যাঁর অনেক কিছু আছে, তিনি যেমন চেষ্টা করেন; যাঁর তেমন কিছু নেই, তিনিও অন‍্যের বাসায় কাজ করে হলেও চেষ্টা করেন সন্তান যেন পড়াশোনা করে, যোগ‍্য হয়, নিজে সবাইকে নিয়ে একটা সুন্দর গড়ে তোলে এবং সুন্দর একটা জীবন পায়।

আমার সঙ্গে কাজ করে ক‍্যাথি (আসল নাম না বলি)। প্রথম প্রেগন‍্যান্সির সময় ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করত সে। যেহেতু আপাতদৃষ্টে তার কোনো সমস‍্যা নেই এবং সে অনুযোগ করেনি কিছু নিয়ে, সুতরাং আমাদের মতোই কাজ করল সে প্রায় পুরো নয় মাস, বাবুটা হওয়ার সময় ওর ইউটেরাইন রাপচার হলো। ওর বাবু আর আমার বন্ধু বেঁচে গেল, একটু বেশি দিন ক‍্যাথি নিজের বাবুর সঙ্গে থাকতে পারবে বলে ছুটিও নেয়নি ও আগে আগে। ছয় মাস পর ও যখন ফিরে এল কাজে, শুনলাম, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। কঠিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট মনার বড় হয়ে ওঠার গল্প দেখছি। সে মেয়ে দ্বিতীয় বাচ্চা নিল ওর বাবুটা একা একা বড় হবে বলে। কঠিন যত্নে মানুষ করছে ওদের। কোনো দিন একটা উঁহু শব্দ শুনিনি ওর মুখে অথচ কত দিন ঘুমাতে পারে না ও, কে জানে। এটা একটা এক্সট্রিম উদাহারণ। তবে বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সুন্দর জীবন নিয়ে উৎকণ্ঠিত একদল মা আমার বন্ধু। আমি ওদের কাছ থেকে সব শুনে, দেখে শিখি। দুটি বিড়ালের বাচ্চা অ্যাডপ্ট করেছে আমার বাচ্চারা। ওরা পড়াশোনার জন‍্য চলে গেলে এগুলোকে কে দেখবে, এমন উৎকণ্ঠা দেখে আমারই এক বন্ধু বলে দিল, কিচ্ছু চিন্তা কোরো না। নম্বর দিয়ে দেব, যখনই লাগবে জানিয়ো, ক‍্যাট সিটার চলে যাবে বাসায়। মায়ের সব সময়ের একটা উৎকণ্ঠা, আমি না থাকলে আমার সন্তানকে কে দেখবে? ওরা বড় হলে, নিজের দেখাশোনা করতে পারলে মরেও শান্তি মায়ের। এ কাহিনি সর্বজনীন। দেশ–কাল মানে না।

লেখক

এখন পরিণত বয়সের কিছু সমস‍্যার কথায় আসি। যে সন্তানকে এত যত্নে মানুষ করা হয়েছে, সে সন্তান যাতে পরবর্তী জীবনে সুখী থাকতে পারে, বাবা বা মায়েদের এতটুকু মানসিক প্রস্তুতি থাকা এখন সময়ের দাবি। ছেলে বিয়ে করল বা মেয়ে বিয়ে করল, একজন নতুন মানুষের সঙ্গে তাকে মিলেমিশে সুন্দর করে জীবন কাটাতে হবে। সুযোগ থাকলে একটু নিজেদের মতো থাকতে দিলে সমস‍্যা কোথায়? ছেলেসন্তান বলেই ছোটবেলার মতো সব সময় মাকে সময় দেবে, এটা কেমন কথা? মায়ের সুস্থ–সুন্দর করে বেঁচে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে এবং মাঝেমধ্যে এসে খোঁজখবর করলে কী সমস‍্যা? একান্ত যদি একসঙ্গে থাকতেই হয়, নিজের সংসারে যেমন দাপটে মা ছিলেন, ছেলের সংসারে সে জায়গাটা বউকে দিলে, নিজের সম্মান নিয়ে একটু চুপচাপ থাকলে কী সমস‍্যা? এই যে পলাশ চলে গেলেন, তাঁর মা তো শত কাঁদলেও এই ছেলে ফিরে পাবেন না। আর বউটার কথা চিন্তা করেও কষ্ট হচ্ছে। এই বাচ্চা বয়সে পৃথিবীতে ভীষণ দামি একজন মানুষ তিনি হারালেন। আত্মহত্যা কোনো কিছুর সমাধান নয়, পৃথিবীর সব কষ্টের শুরু। একজন ভীষণ মেধাবী মানুষকে এ পর্যায়ের মানসিক বিপর্যয়ের নিয়ে যাওয়ার দায় মাকে নিতেই হবে। সঙ্গে পরিবারের অন‍্য ভাইদেরও। দেশ একজন মেধাবী পুলিশ অফিসার হারালো, যাঁর সেবা আমাদের দরকার ছিল।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com

আমরা এমন মা চাই, যাঁরা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করেন, দোয়া করেন এবং চেষ্টা করেন। কোনো সন্তান নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসেন না। তাকে রিটায়ারমেন্ট প্ল‍্যান হিসেবে বড় করারও কিছু নেই। সে সুস্থভাবে বেঁচে থাকলে মায়ের জীবনও অনন‍্যসুন্দরই থাকবে। নয়তো এ জীবন কোনো জীবনই নয়, যদি আমাদের সামান‍্য কারণেও সন্তানের অপূরণীয় ক্ষতি হয়।