ভালোবাসার গল্প কুড়াই
‘এই ঠান্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না। ফ্রস্টবাইট হতে পারে, ইয়ং লেডি!’
শীতের তীব্রতায় চোখে অশ্রুকণা জমছে। এদিকে বৃদ্ধের মুখে ‘ইয়ং লেডি’ সম্বোধন শুনে ঠোঁটে লাজুক হাসি।
একগাদা কাপড়, টুপি, উঁচু বুট পরে বের হয়েছি হাঁটতে। অপরিচিতের মুখে আন্তরিক সম্বোধনে আপনজনের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। মা-বাবা যেভাবে সাবধান করতেন, ‘এ দুর্যোগে বাইরে যেয়ো না। বৃষ্টিতে ভিজো না, রাতে গোসল কোরো না।’ তাঁর কণ্ঠে স্নেহের সেই উত্তাপ, যা ফেলে এসেছি সহস্র কিলোমিটার দূরে।
হোক না এই শুভ্র তুষারের দেশে চিরহরিৎ পাইনগাছের ডালে বরফের স্তূপ নিয়ে খেলতে থাকা কুকুরটির বেল্ট হাতে ধরা অবস্থায়। তবু তো বললেন। এ অজানা অনাত্মীয় দেশে কে কাকে নিয়ে চিন্তা করে!
তাঁর লালচে চামড়ার মুখের খানিকটা দৃশ্যমান। শীতের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মাথায় মোটা উলের টুপি। তার ওপর জ্যাকেটের হুড টেনে রাখা। বাতাস থেকে বাঁচতে মাফলার নাক পর্যন্ত ওঠানো।
বুড়ো হওয়ার লক্ষণ কী জানো? কাউকে দেখলেই মন চায় উপদেশ দিতে।
ঠান্ডায় চিমসানো মুখে মৃদু হাসি।
বৃদ্ধ তখন বলছেন, লাভ অব মাই লাইফ...আমার সুইটহার্ট ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। ওকে কিছুদিনের মধ্যেই নার্সিং হোমে চলে যেতে হবে।
আহা! খুব খারাপ লাগছে শুনে।
জানি। খারাপ লাগবেই। এই এলাকায় ৫৪ বছর ধরে আছি। ১৯৭০ সালে বাড়ি কিনেছিলাম বিয়ের পর মাত্র ১৮ হাজার ডলারে। ২৫ বছর বয়স তখন। বিয়েতে উপহার পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে দুই হাজার ডলার। ডাউন পেমেন্ট দিয়েছিলাম। কিছু ধার করে পাশের জমিটাও নিয়েছিলাম মাত্র ছয় হাজারে।
ওয়াও! এত সস্তা?
হা হা হা! এই বাড়ি জমির দাম এখন মিলিয়ন ডলার।
কুকুরটি তখন বন্ধু ভেবে আমার পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করছে আদরের প্রত্যাশায়। গ্লাভস পরা হাতে সামান্য হাত বুলাই ওর মাথায়। আমার কুকুরভীতি।
ভদ্রলোক হাসেন। অভয় দেন।
ও খুবই শান্ত বাচ্চা।
আমার স্ত্রী নার্সিং হোম যাওয়ার পরদিন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
অবাক হয়ে বলি, কোথায়?
নার্সিং হোমের কাছে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট নিচ্ছি। একা মানুষ। এর বেশি লাগবে না। পাঁচ ছেলে-মেয়ে আর ১১ জন নাতি-নাতনিকে সব ভাগ করে দেব। এ মন্দার দিনে তরুণ প্রজন্মকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। কেমন করে আমার নাতি-নাতনিরা বাড়ি কিনবে সাহায্য না করলে? সবারই উচিত নিজের পরিবারকে সাহায্য করা।
আপনি চমৎকার মানুষ। আমি দোয়া করব আপনার স্ত্রীর জন্য, উনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল তাঁর ক্লান্ত চোখ। কুঁচকানো চামড়ার আড়াল থেকে বললেন, তোমার ভাষায় দোয়া কোরো তার জন্য, যেন সে শান্তিতে চিরবিদায় নিতে পারে। আমাকে খুব শিগগির ভুলে যাবে। আমার আফসোস নেই। জীবন উপভোগ করেছি তাকে সঙ্গে নিয়ে। তুমি কি বিশ্বাস করবে, সে আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা?
আমার তখন সত্যি সত্যি চোখে পানি এসেছে। চশমায় বাষ্প জমেছে। বৃদ্ধ আমার দিকে না তাকিয়েই আবার বললেন, গুডলাক, ইয়ং লেডি। কিছু মনে করো না, আমার বকবক শুনে। বাই!
প্রখর সূর্যকিরণে তুষারের কণা হীরকচূর্ণ হয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঝকঝকে নীলাকাশে ভালোবাসার প্রগাঢ় বাণী উড়িয়ে নিয়ে গেল একঝলক হাওয়া এসে। ছড়িয়ে যাক এই ভালোবাসা কোটি কোটি মানুষের প্রাণে।
আমি চেয়ে রই, বৃদ্ধের গমনপথের দিকে।
ভালোবাসার গল্প কুড়াই। মায়ায় বেঁধে রাখি আমাদের প্রিয়জনদের।