অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস ও জাতীয় আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েছবি: পিআইডি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেছে মুহাম্মদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন এ সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বহুমাত্রিক।

দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে শেখ হাসিনার সরকার মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে ক্ষোভ ও ক্রোধের জন্ম দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র ও জনতার গণ–অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। দেশে খুন ও গুম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতি এ দেশের প্রতিটি স্তরে ক্যানসার সেলের মতো ভয়াবহ আকারে দানা বেঁধেছিল। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র এখনো গত দেড় দশকের জঞ্জাল থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। তাই বলা যায় যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এমন একটা সময়ে, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত।

গত এক মাসে নতুন সরকার দেশের অর্থনীতির গতিশীলতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করার ঘটনায় কারাদণ্ড হওয়া ৫৭ বাংলাদেশির সবাইকে ক্ষমা করার আদেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জনপ্রিয়তার ফল আমাদের দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঘরে পৌঁছেছে, যা প্রবাসী হিসেবে আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার সেভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হচ্ছে না। এ কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

এটা ঠিক যে গণ–অভ্যুত্থান বা বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে দেশে সাময়িক সময়ের অস্থিতিশীলতা দেখা যায়। তবে কোনো কারণে যদি এ অস্থিতিশীলতা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রলম্বিত হয়, তাহলে এ গণ–অভ্যুত্থান বা বিপ্লব খুব সহজে ব্যর্থতায় পর্যুদস্ত হয়। ফলে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফরম্যাট নিয়ে বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জাতির আকাশে দুর্যোগের আভাস ধ্বনিত হচ্ছে। শপথ গ্রহণের পর এক মাস পেরিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু কোনো কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিয়ে এ সরকার আগামী দিনগুলোয় রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করবে, সে বিষয়টি তারা এখনো স্পষ্ট করেনি। নতুন এ সরকারকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকটের জায়গা হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে এ সরকারের কোনো ভিত্তি নেই। এটা ঠিক যে গণ–অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি দেশের সিংহভাগ মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। দেশের অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান একটি সরকারকে বিভিন্নভাবে কর্তৃত্ববাদী হতে সহায়তা করে এবং এ সংবিধানের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অসংগতি রয়েছে। এ সংবিধানের সংস্কারের প্রয়োজন। তবে সংবিধান পরিবর্তন করতে সাধারণ মানুষের মতামত অত্যাবশ্যক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রথমে স্পষ্ট করে বলতে হবে যে তাদের মেয়াদ ঠিক কত দিনের জন্য। ড. মুহাম্মদ সরকারের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিগত দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পার্থক্য কোথায় সেটি, এখনো স্পষ্ট নয়। যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা এ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তাদের উচিত হবে অতি দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। সে সঙ্গে এ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সংবিধানের যেসব বিষয় পরিবর্তন বা সংস্কার করা জরুরি, সরকারকে ওই বিষয়গুলোর প্রতি দ্রুত মনোনিবেশ করতে হবে। কিছু কিছু সংস্কার বা পরিবর্তন রয়েছে, যেগুলো কম সময়ের মধ্যে করা যায়। তবে বৃহৎ পরিসরে সংবিধানের সংস্কার বা পরিবর্তন করতে একটি নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদ প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের দেশে কোনো কার্যকর সংসদ নেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে কখনো বৃহত্তর পরিসরে সংবিধানের সংস্কার বা সংশোধন সম্ভব নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চাইলে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করতে পারেন এবং যদি দেশের সিংহভাগ মানুষের রায় তাঁর পক্ষে আসে, তাহলে একটি প্রতিনিধি পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার বা প্রয়োজনবোধে সংবিধান পুনর্লিখনের পথে এগোতে পারেন। যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করতে না চান, সে ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে কালবিলম্ব না করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা, যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের হাতে এ দেশের শাসনভার ন্যস্ত হয়।

এ সরকারকে নিয়ে আরও একটি কারণে বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যাঁরা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের অনেকে এ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। একটি সংস্থা পরিচালনা করা আর একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করা এক বিষয় নয়। কোনো কোনো এনজিও নিজস্ব কিছু এজেন্ডার ভিত্তিতে কাজ করে কিন্তু একটি রাষ্ট্র সব এজেন্ডার ঊর্ধ্বে সব শ্রেণি–পেশার মানুষকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। অনেকে এ কারণে বলেন, রাজনীতিবিদ ছাড়া কেউই সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা কোনো এনজিও বা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা কোনো বিশেষ অঞ্চলের মানুষের সরকার নয়, তাঁরা দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সরকার।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরিভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে, সেটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। গণহারে মামলা দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। গণপিটুনিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে। যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে সরাসরি প্রশাসনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। আদালত আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত হলে তাঁকে কোনোভাবে একঘরে রাখা যাবে না। একজন মানুষ ভয়ংকর অপরাধী হতে পারেন, কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণে তাঁর ওপর হামলার বিষয়টি আমি কোনোভাবে সমর্থন করি না। প্রত্যেক মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করে, ওই সময় আমি ছিলাম পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই সময়ের স্মৃতি থেকে যতটুকু মনে পড়ে, সে আলোকে যদি আমি বলতে চাই, ওই ওয়ান ইলেভেন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা এতটা নাজুক ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তৎপরতা সে সময় আমরা লক্ষ্য করেছিলাম। অথচ বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে পুলিশ প্রশাসন পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছে। পুলিশ স্টেশনগুলো এখনো স্বাভাবিক ছন্দে কাজে ফিরতে পারেনি। এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশকে বিভিন্নভাবে কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে তাদের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। পুলিশের হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রয়োজনে সরকার পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি। সরকার পতনের পর পরিবহন খাত থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, হাটবাজার, ময়লা সংগ্রহ, বালু উত্তোলন ইত্যাদি খাতে চাঁদাবাজির হাতবদল ঘটেছে কেবল। চাঁদাবাজি বন্ধ করার দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনো সরকারের পক্ষ দেখা যাচ্ছে না। দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত বেশ কয়েকজন অপরাধীকে একের পর এক জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ঠিক কোনো মানদণ্ড বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে, তা সরকার স্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে না।

গণ–অভ্যুত্থানের সময় যাঁরা বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে এসেছে ঠিকই কিন্তু তা বাস্তবায়নে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এমনকি অনেক আহত ব্যক্তির স্বজন দাবি করছেন যে তাঁরা অর্থাভাবে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে পুরো এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগেনি। এ ধরনের পদক্ষেপ আগামীতে অসংখ্য শিক্ষার্থীর পথচলায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। কোন প্রক্রিয়ায় এ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে, তা সরকার এখনো নিশ্চিতভাবে কিছুই জানায়নি।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। চাহিদা অনুযায়ী কীভাবে বাজারে পণ্যের সরবারহ নিশ্চিত করা যায় অথবা বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাম্প্রতিক কিছু কার্যকলাপ আমাকে হতাশ করেছে। শুরু থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দাবি করে আসছিল যে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু বর্তমানে এ সংগঠনের অনেক সমন্বয়ককে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুনছি, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফির একটি বক্তব্য ‘স্বৈরাচার হটাইতে পারছি, সাংবাদিকদের ১৫ সেকেন্ডেই ফিনিশ করে দেব’- আমার মধ্যে রীতিমতো উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আমার বারবার মনে হয়েছে, একজনকে সরিয়ে আমরা আরেকজনকে ক্ষমতায় আনতে যাচ্ছি না তো, যারা একই?

আমার মনে হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব ধরনের কার্যক্রম এ মুহূর্তে স্থগিত করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উচিত এখন পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা। পড়াশোনা শেষ করার পর তাঁরা যদি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দিতে পারেন। তাঁদের অনেকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। এখন তাঁদের উচিত নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করা। সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা, আনসারদের বিদ্রোহ দমন করা বা বাজার মনিটরিং করা তাঁদের কাজ নয়। ভবিষ্যতে আমাদের দেশ যদি আবার অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হন, তখন তাঁরা মাঠে নেমে কাজ করতে পারেন। অথবা সরকারের পাশে থেকে সহায়ক শক্তি হিসেবে তাঁরা কাজ করতে পারেন। এ মুহূর্তে তাঁরা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে আসুক, এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দুই তরুণ শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্তি করার বিষয়টি আমার কাছে ভালো লাগেনি। কেননা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিচালনা করার কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। সানা মেরিন যখন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর। জেসিন্ডা আরডার্নও তরুণ বয়সে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিমের দেশগুলোয় আইনের শাসন আছে, চেক অ্যান্ড ব্যালান্স আছে। এসব দেশ নিয়মের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। পশ্চিমা যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পরিচালনা করা অনেক বেশি দুরূহ।

আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বুঝতে হবে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনে এ দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সমান ভূমিকা রয়েছে। আমাদের সবার সাড়ে ১৫ বছরের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলাফল ৩৬ জুলাই। দুর্ভাগ্যবশত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ কেউ এ অর্জনের পেছনে নিজেদের অংশগ্রহণকে মুখ্য হিসেবে তুলে ধরছেন। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের লড়াই বা সাধারণ মানুষের অবদানকে তাঁদের অনেকে সেভাবে মূল্যায়ন করছেন না।

হাজারো মায়ের বুকের আর্তনাদ, অসংখ্য মানুষের বুকের তাজা রক্ত ও এ দেশের আপামর জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। অনেকের দৃষ্টিতে ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। এ স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এখন শ্রাবণ মাস। শ্রাবণের এ বিপ্লব বা গণ–অভ্যুত্থান আরব বসন্তের মতো এ দেশে আবির্ভূত হয়েছে, এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি আমাদের ভবিষ্যৎ যেনও আরব বসন্তের মতো একই পরিণতি বরণ না করে সে দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ এক মাসে তাঁদের বিভিন্ন ব্যর্থতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুধাবন করতে হবে যে আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ মানুষ আজ বড় আশা নিয়ে তাঁর সরকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জনসাধারণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের প্রতিফলন অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর সরকারকে কায়মনোবাক্যে কাজ করতে হবে। গণ–অভ্যুত্থান বা বিপ্লব যাতে কোনোভাবে ম্লান না হয়ে যায়, সে জন্য আমাদের বর্তমান সরকারকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]