ডাক লেক নামকরণের সার্থকতা

ছবি: লেখক

প্রতিবছরে অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবারে কানাডায় থ্যাঙ্কস গিভিং ডে, দিনটি উদ্‌যাপনের জন্য সরকারি ছুটি থাকে। ছুটিটা ভিন্নভাবে উপভোগ করতে লং ড্রাইভে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলে-মেয়ে বাইরে না যাওয়ার বাহানা ধরল। স্বামী-স্ত্রী শুধু দুজনে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের এ প্রদেশে শীত শুরু হয়ে যাবে। এখানে শীত খুব দ্রুতগতিতে এক দিনের মধ্যেই একহাঁটু তুষারের শ্বেতশুভ্র চাদর দিয়ে গোটা ভূপৃষ্ঠ ঢেকে ফেলে। ভাবলাম, এ বছরে শেষবারের মতো প্রকৃতির শরৎ ও হেমন্ত ঋতুর কমলা-হলুদ-সবুজ রঙের বৈচিত্র্যময় রূপের বিন্যাসে পাতাঝরার সৌন্দর্যটা সময় থাকতে নিরিবিলি উপভোগ করে আসি।

আমরা থাকি কানাডার সাসকাচোয়ান প্রদেশের সাস্কাটুন শহরে। গাড়িতে ফুল ট্যাংক গ্যাস ভরে রওনা দিলাম প্রিন্স আলবার্ট নামের একটা ছোট শহরের পথে। গাড়ি ছুটে চলেছে যানজটহীন হাইওয়ে ধরে। রাস্তার নীরবতা ভেঙে মাঝেমধ্যে দুই-একটা গাড়ি বিপরীত দিক থেকে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি লার্চগাছের সবুজ থেকে প্রায় ফ্লুরোসেন্ট সোনালি হলুদের অপরূপ সজ্জাবিন্যাস। এর ফাঁকে মাঝেমধ্যে আবার কোথাও বিশাল বিশাল চিরশ্যামল ক্রিসমাস এবং পাহাড়ি পাইনের ঘন সবুজ গাছের সারি। আর সেই সঙ্গে পড়ে আছে একরের পর একর দিগন্তজোড়া বিস্তৃত মাঠে কাটা ফসল। মেশিন দিয়ে ফসল কাটার কারণে মাঠে পড়ে আছে একই মাপের পরিত্যক্ত ফসলের শুকনা গোড়া। তার ওপর নীল আকাশের আগুনঝরা রোদের আলো প্রতিফলিত হয়ে মাঠের পর মাঠ চোখে পড়ছে হলুদাভ সোনালি রঙের ঝিলিক। রাস্তাটা আমাদের কাছে যদিও বেশ পরিচিত, কিন্তু প্রকৃতির এই রং বদলের খেলায় আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম।

ছোটবেলা থেকে আমার একটা অভ্যাস আছে, চলতি পথে রাস্তার পাশের সাইন বোর্ড পড়ে ওই জায়গার নাম জানা। একটা জায়গার সাইন বোর্ডে লেখা আছে ডাক লেক (Duck Lake)। এই ডাক লেক শহরটি সাস্কাটুনের ৪৪ কিলোমিটার উত্তরে এবং প্রিন্স অ্যালবার্ট থেকে ৪৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। প্রায় ১১০ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে আমাদের গাড়ি এই শহরের লোকালয়হীন একদম নির্জন জায়গা দিয়ে অতিক্রম করছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি গাড়িতে বেজে চলেছে মীরা দেববর্মনের লেখা, ও শচীন দেববর্মনের গাওয়া আমার একটা প্রিয় গান,

‘শোনো গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি
লেগেছে চোখেতে নেশা, দিক ভুলেছি আমি...’

আমরা তখন আকাশে কিছু হাঁস এলোমেলো ওড়াউড়ি করতে দেখলাম। রাস্তা বাঁ পাশের থেকে দেখা যায়, বেশ খানিকটা দূরে ফসলের খেতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশাল এক লেক আকৃতির জলাশয় বা বিল ও বলা চলে। দূর থেকে বিলটা আমাদের কাছে খুব অপরিচিত লাগছিল। আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না জল ছলছল ওই বিল সূর্যের ঝলমলে রোদে এমন তুষার সদৃশ দেখাচ্ছে আজ! শীত তো এখনো পুরা আসেনি, সুতরাং এটা তো নিশ্চিতই তুষারে আবৃত নয়! তবে বিলের এত পানি কোথায় গেল? আমার স্বামী বলল, ‘মনে হচ্ছে ওগুলো স্নো গিজ (তুষার আভ হাঁস), দেখবে নাকি?’ যেহেতু এ ধরনের অজানা সৌন্দর্য আমার চোখে আগে পড়েনি, তাই আমি রাজি হয়ে যাই।

ছবি: লেখক

গাড়ি হাইওয়ে থেকে নেমে পাথরকুচি বিছানো সাব রাস্তা ধরে মাঠের ভেতর দিয়ে বিলটার দিকে একটু এগিয়ে গেল। সাদা সাদা যা কিছু আমরা দূর থেকে দেখছিলাম, তা হলো হাজারো হাঁসের মেলা। রাস্তাটা শস্যখেতের মাঝখানেই শেষ। আর সামনে এগোনোর জায়গা নেই। আমরা ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে বিলের কিছুটা কাছাকাছি হেঁটে গেলাম। যখন সাদা তুষার হাঁসের দল পানিতে ভেসে বেড়ায়, তখন এই তুষার হাঁসের সমাবেশ দেখা আরেকটি বিশাল তুষারজগতে দাঁড়িয়ে থাকার মতোই। অল্প কিছু হাঁস ডানায় শাঁ শাঁ শব্দ তুলে ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে আবার ঝুপঝাঁপ করে বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে ভেসে পড়ছে। আবার কয়েক সেকেন্ড পর কিছু হাঁস অগণিত ডানা ঝাঁকুনি এবং ‘হুউক, হুউক’ ডাক দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আর বাকি হাঁসগুলো লেকের নির্জলা পানিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে বটে, তবে তারা একই স্বরে ক্রমাগত কোরাস, যা তীক্ষ্ণ চিৎকার, কর্কশ শব্দ করেই চলেছে। একই জায়গায় একই সঙ্গে এত অজস্র হাঁসের আনন্দ-কলরব বিস্তীর্ণ স্তব্ধ মাঠ ছাপিয়ে আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অদ্ভুত উচ্চ স্বরের শোরগোল সৃষ্টি করছে।

ছবি: লেখক

দূর থেকে যতটুকু দেখা গেল, বিলের ওই পাড়ে প্রকৃতিদর্শনে কোনো এক দর্শনার্থী নৌকা নিয়ে নেমেছেন। নিরাপত্তার সুবিধার্থে বিশাল বড় একঝাঁক হাঁস তীক্ষ্ণ উচ্চ শব্দ তুলে বারবার ডানা ঝাঁকুনি দিয়ে কিছুটা আমাদের এই পাড়ের দিকে উড়ে এল। হাঁসের ঝাঁকের এই উড়ন্ত উন্মত্ততা আমার সামনের রৌদ্র-ঝলমল অবারিত নীল আকাশকে প্রায় অস্পষ্ট করে দিল। এই মনোহরণ করা অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য বিমুগ্ধচিত্তে উপভোগ করলাম। স্মৃতিরোমন্থন করতে কিছু ফটো ও ভিডিও করলাম। চলতি পথে আজ হৃদয়ঙ্গম করলাম এ শহরের ‘ডাক লেক’ নামকরণের বিষয়গত বা ভাবগত সার্থকতা।

ছবি: লেখক

প্রতিবছর শীতের শুরুতে এই হাঁসগুলো একে একে দল ভারী করে অবিশ্বাস্যভাবে বড় ঝাঁকে জড়ো হয়ে দক্ষিণে চলে যায়। দক্ষিণমুখী যাত্রার পথে দক্ষিণ সাসকাচোয়ান তাদের একটি প্রিয় থামার জায়গা বা সমাবেশ পয়েন্ট। আর এ দেশ থেকে দেশান্তরে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য প্রতিবছর তারা দল বেঁধে এই একই মাইগ্রেটিং রুট, স্টেজিং এবং স্টপওভার ব্যবহার করে। যার প্রধান কারণ হলো সাসকাচোয়ান কানাডার একটা বিশাল প্রেইরি অঞ্চল এবং যার ওপর গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম পালস সেক্টর। দিগন্তজোড়া মাঠে কৃষকেরা গম, মসুর, মটর, ভুট্টা, ক্যানোলা, বার্লি, তিসি, শর্ষে, ওটসের চাষ করেন।

পরে আমরা প্রিন্স আলবার্ট হয়ে অন্যান্য অঞ্চলসহ ওয়াপিটি ভ্যালি রিজিওনাল পার্ক ঘুরে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলাম। পথে আমরা বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বেশ কিছু জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ টলটলে পানি-জঙ্গলে অনেক রকম হাঁসের ছোট-বড় ঝাঁক দেখেছিলাম। তা ছাড়া রাস্তার পাশের খেতে খামারে ও হাঁসের ঝাঁকের বিচরণ দেখেও আমরা আনন্দ, শিহরণে উল্লসিত হয়েছিলাম।

সেদিন বাইরে +২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার আবহাওয়াও ছিল একদম মনের মতো করে প্রকৃতির অজানাতে হারিয়ে যাওয়া। মাথার ওপর নীল আকাশের উন্মুক্ত বিশালতায়, রংবেরঙের বনভূমির একান্ত সান্নিধ্যে, মৃদুমন্দ ঝিরঝির বাতাসে বয়ে চলা বিলের স্বচ্ছ টলটল পানি এবং হাঁসের ঝাঁকের কলরবে মুখর নৈসর্গিক রূপের মাধুর্যে বিমোহিত আমরা দুজনে সেদিন ঘরে ফিরেছিলাম এক অনাবিল ফুরফুরে মনমেজাজে।