শিক্ষক দিবস চলে গেল। কত কত সুন্দর স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে। বর্ণিল জীবন। ছোটবেলায় পাঠ্য ছিল ‘স্যান্ডস অব ডি’ কবিতা। ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় এই কবিতা আবৃত্তি করে হলাম প্রথম। কী ফুর্তি। পরদিন রফিক স্যার পড়াতে এসে বললেন, শুধু কবিতা আবৃত্তি করলে হবে? গানও জানতে হয়। তারপর গান ধরলেন ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ভুল, একেলা আমি’। আব্বু–আম্মু ছুটে এলেন এমন বেসুরো গলায় গান গায় কে জানতে। পরে বকা খেলাম আমি। পড়া বাদ দিয়ে গানের প্রসঙ্গ নির্ঘাত আমি এনেছি। মানে নামকরা ফাঁকিবাজ ছিলাম তো।
আমাদের সুইমিং টিচারকে আমরা কাকু ডাকতাম। সাঁতার শিখিয়েছেন তিনি ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাপদ্ধতি ছিল ভয়ের। বিশাল পুলের মধ্যে ফেলে দিতেন, পানি খেয়ে সাঁতার শেখা। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসে পানির ওপর পা ছপাত ছপাত করে আমাকে সাঁতার কাটতে দেখে ট্রিনা জিজ্ঞেস করেছিল এ কেমন সাঁতার? বলেছিলাম ফ্রি–স্টাইল সাঁতার ট্রিনা।
তপন স্যার ছিলেম অঙ্কের শিক্ষক। সাইকেল চালিয়ে পড়াতে আসতেন। একদিন সাইকেলের চাবি ফেলে গিয়েছিলেন আমাদের পড়ানো শেষ করে বাসায় যাওয়ার আগে, চাবি নিতে এসে দেখেন আমি দাদাকে অভিনয় করে দেখাচ্ছি, এক চামচ ভাজা চিড়া মুখে দিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে কীভাবে একটু আগেই স্যার বলছিলেন লিসা এই যে ক্লাস এইটে সেকেন্ড গ্রেডে বৃত্তি পেলা, সারা দিন খেল, পুরোপুরি চেষ্টা কর না, জানত না করে যে পেতে চায়, দুঃখ তার পিছে ধায়। স্যার পেছন থেকে বললেন, ভালো ভালো, খুব ভালো, সিনেমায় বেশ নাম করবে ভবিষ্যতে। ভয় পেয়ে অতঃপর চিড়া নিচে ফেলে পিঁপড়াকে দাওয়াত দিয়ে মার কাছে ভবিষ্যৎ ঝরঝরা জাতীয় কথাগুলা শুনে হজম করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। তো দিন কয়েক পরে দেখলাম স্যার পড়াতে আসছেন, কেন যেন হেঁটে। বুঝলাম প্রতিশোধ নেওয়ার এই সুযোগ। সাইকেল নিয়ে আমি তখন বাইরে, স্যার হেঁটে কাছাকাছি এসে ডাকবেন, আমিও দিই স্পিড বাড়িয়ে, স্যার হন্তদন্ত হয়ে কাছে আসেন বাসায় ফিরে পড়তে বসতে বলবেন, কাছাকাছি এলেই আমি স্পিড বাড়াই। সেদিন আর পড়াতে আসেননি স্যার, কিছুক্ষণ পিছে দৌড়ে।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
স্কুলে বাংলা প্রশ্নের উত্তর নিজে নিজে লিখতাম, মুখস্থ করতে চাইতাম না। নম্বর ভালো পাওয়াতে এবং রফিকুল স্যারের আশকারাতে আমি মোটামুটি নিজেকে তখন সাহিত্যিক ভেবে নিয়েছি। কলেজে উঠে শামিম স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে পাঠানো হলো আমাকে। দ্বিতীয় দিন পড়তে গেলাম, কোনো প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে যাইনি। বানিয়ে লিখলাম। এমন ধমক খেয়েছি, এইচএসসি পাস করা পর্যন্ত আর কখনো চেষ্টা করিনি বানানো কোনো উত্তর লিখতে। পাসের পরপর একদিন শুনলাম আফরিন আপার আম্মার কাছে স্যার নাকি গল্প করেছেন, লিসা একটা জিনিয়াস। কেমন দুঃখজনক ঘটনা, এই কথা সামনে বলা তো দূরের কথা, কোনোদিন একটা হাসিও দেননি আমাকে দেখে তিনি।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম, সে সময়ে বোনের বিয়ে হলো। তাদের বাসায় আমি ঘন ঘন যাই, অতি আদরে বাঁদর ছোট বোন। বোনের হাবি আমাকে দেখলেই খুশিমনে জিজ্ঞেস করেন ব্লাড সাপ্লাই, নার্ভ সাপ্লাই। এত বোরিং একটা বিষয়ে কোনো মানুষ যে কোনো ছেলেমেয়েকে উৎসাহ নিয়ে পড়াতে পারেন, সেটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। যথারীতি কিচ্ছু পারি না। বোনকে একদিন বললাম উনি নিউরোলজিস্ট। ফাস্ট ইয়ারের আমাকে এত প্রশ্ন ক্যান করে? আপু বলল, তুইতো আমাকেও কোনোদিন মেডিকেলের কিছু বুঝিয়ে বলতে বলিসনি। বলে দিলাম তোমরা এ রকম করলে আর আসব না তোমার বাসায় কিন্তু। পিজির (বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষক দুলাভাই খালি হাসতেন। আরে তিনি কি করে বুঝবেন আমি হইলাম ক্লাসে বসা সেই ছাত্রি যে স্যার যাই জিজ্ঞেস করেন, আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। স্যার একদিন বলেই ফেললেন, কিরে ভাই আমি কি টেগরু নাকি, যার দিকেই তাকাই সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে?
মেডিকেলে পড়তে চট্টগ্রামের গ্রাম থেকে আসা রোগী ওয়ার্ডে নিয়ে দেখাতে হতো। স্টুডেন্ট পরিচয় দিলে স্যারেরা সুন্দর করে দেখে দিতেন রোগী। ফাইনালের আগের রাতে নাছোড় বান্দা রোগী হাজির। গেলাম ওয়ার্ডে রোগী নিয়ে। স্যার তেড়ে এলেন, তোমার কালকে পরীক্ষা না? মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম স্যার রোগী…তিনি বকা দিলেন আমি দেখব রোগী তুমি, যাও পড়তে বসো, সাহস কত মেয়ের।
আমেরিকায় এসেই পুত্র এবং পরের বছর কন্যা মাকে পেলাম। ছোট মানুষ দুজনকে নিয়ে ইউএসএমএলই (মেডিকেল লাইসেন্সিং এক্সাম) পরীক্ষা দেব। পড়ব, ভীষণ এক্সপেনসিভ ডে কেয়ার কয়েক মাস এবং এক বছর কয়েক মাসের দুই শিশুর জন্য। বন্ধুর বুদ্ধিতে কমিউনিটি কলেজে টাইপিং আর মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এক্সেলের ক্লাস নিলাম। সেই কাগজ দিয়ে সাবসিডাইজড ভাবে ডে কেয়ারে বাচ্চাদের রেখে আমি পড়ি। ক্লাসে অনিয়মিত। একদিন ইয়াং টিচার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পোটেনশিয়াল আছে কিন্তু এত কম দিন আস কেন? পড় মন দিয়ে, আমি চাকরির ব্যবস্থা করে দেব? তারপর জিজ্ঞেস করল দেশ থেকে কতদূর পড়ে এসেছ? আমি চুপ। বলে মাস্টার্স? গ্র্যাজুয়েট? হাইস্কুল ও পাস না? ওকে বললাম জবাবটা তোমাকে আমি ছয় মাস পরে দিই? বলল দিও, কিন্তু ‘এ’ পেতে হলে আরো নিয়মিত আসতে হবে ফারহানা।
ছয় মাস পর ইউএসএলএলইর স্টেপ টু পাস করলাম, স্কোর ৯২ পার্সেন্টাইল। শিক্ষকের নাম ভুলে গেছি, তাকে নম্বর দেখালাম, বাসায় বসে পড়ার জন্য তোমার ক্লাসে খুব অনিয়মিত ছিলাম। ও হাসল। বলল, গুড লাক ফারহানা।
আমার রেসিডেন্সি প্রোগ্রামে শিক্ষকদের সবাই চাইতেন কীভাবে ভালো চিকিৎসক হতে পারব, হাতে–কলমে শেখাতেন। চেষ্টা তো করতামই, আমরা বাংলাদেশিরা ভীষণ খেটে খাওয়া মানুষ। একদিন এক অ্যাটেন্ডিং মাঝেমধ্যে নিজেকে একটু ক্রেডিট দিত ভালো কাজের, নিজের এত বড় ক্রিটিক হওয়ার দরকার নেই।
জীবন গড়ে দেওয়া সব শিক্ষককে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। সবার অবদানে সামান্য এই মানুষের এ পথ চলা।