শিক্ষক মঞ্জুর আলম বেগ: বেঁচে আছেন হৃদয়ে

শিল্পকলা একাডেমিতে বিপিএস আয়োজিত আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে মঞ্জুর আলম বেগ স্যারছবি: লেখকের পাঠানো

মঞ্জুর আলম বেগ (১ অক্টোবর ১৯৩১-২৬ জুলাই ১৯৯৮) ‘বেগ স্যার’ নামেই তিনি বাংলাদেশে আলোকচিত্রাঙ্গনে আলোকচিত্রামোদীদের প্রাণপুরুষ। ফটোগ্রাফিতে আমৃত্যু অবদানের জন্য ২০০৭ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। বেগ স্যার সেরা ১১ জন ফটোগ্রাফারের একজন এবং তিনি ১১টি গ্রন্থের প্রণেতা।

শিক্ষক প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, ‘আমি আমার জীবনে অসাধারণ শিক্ষকদের পেয়েছিলাম। পৃথিবীতে বড় মাপের মানুষ মানেই এক শিক্ষক। অন্যের হৃদয়ে বেঁচে থাকাই হচ্ছে বেঁচে থাকা। শিক্ষকেরা আমরা অন্যের হৃদয়ে বেঁচে আছি।’ তেমনি আমিও আমার জীবনে অসাধারণ শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়েছি। বড় মাপের বিশাল হৃদয়ের অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন এম এ বেগ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, ‘আমরা অন্যের হদয়ে বেঁচে থাকি। বেগ স্যারও বেঁচে আছেন হৃদয়ে।’

ফটোগ্রাফি চর্চার একপর্যায়ে মনে হলো অনেক কিছুই জানি না, কী এক শূন্যতা গ্রাস করে আমাকে। বেগার্টে গিয়ে বেগ স্যারকে বললাম, স্যার ডিপ্লোমা করতে ইচ্ছুক। স্যার বললেন, বেসিক করতে হবে, তারপর তো ডিপ্লোমা। স্যার, বেসিক জানি তো। আপনি বেসিকের কিছুটা জানেন, কিছুটা জানেন না। বেসিকের জ্ঞান পরিপূর্ণ হতে হবে। বেসিক কোর্স শেষে ডিপ্লোমার পুরো ফি একসঙ্গে দিয়ে ক্লাস শুরু করলাম। প্রতি সপ্তাহে বেগার্টে যাই, কখনো কখনো সপ্তাহে দুবারও যাই। আবার একই দিনে দুবার। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার সিনিয়র ফটোগ্রাফারদের ট্রানজিট পয়েন্ট ছিল বেগার্ট। তাঁদের সঙ্গে বেগার্টে দেখা হলে স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। পরিচয় বিনিময়ের পর তাঁদের ছবি দেখার সৌভাগ্য হতো। একেকজনের মনকাড়া বিস্ময়কর সেসব ছবি দেখে মনের ভেতর শূন্যতার চর জেগে উঠত। দুপুর হলে স্যার বলতেন, চলেন ভাত খেয়ে আসি। এলিফেন্ট রোডের গলির ভেতর এক রেস্টুরেন্ট দোতলায়। স্যারের এ আবিষ্কারে আমি বিস্মিত। ডিপ্লোমা ক্লাসের কোর্স শেষ হলে একটি প্রোফাইল জমা দিতে হবে। প্রায় ছয় মাস পর একটি প্রোফাইল জমা দিলাম। প্রোফাইলটি দেখা শেষ হলে স্যার হঠাৎ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সার্টিফিকেটের প্যাকেট টেনে নিয়ে বললেন, আপনার কোর্স তো শেষ। এখনই সার্টিফিকেট নিয়ে যান। আগামী সপ্তাহ থেকে আপনাকে আর আসতে হবে না। বললাম, স্যার আমি তো এক বছরের কোর্স ফি অগ্রিম দিয়েছি। আমি নিয়মিত ক্লাসে আসব এক বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত। হাসি দিয়ে বললেন, আচ্ছা ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকবেন, কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না।

দেশে ও বিদেশে আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার সংবাদ দিয়ে বলতেন, ছবি জমা দিন, প্রতিযোগিতার জন্য আমার ছবি সিলেক্ট করে দিতেন। একদিন বললেন, জিপিও যাওয়া তো একটা বিরাট সমস্যা, আপনার প্যাকেটে আমার ছবিও দিয়ে দেবেন। প্রায়ই বলতেন, আপনি নারায়ণগঞ্জে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, আমি আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। আমি সব সময় আপনার সঙ্গে আছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ফটোগ্রাফি সংগঠনগুলো স্যারের অনুপ্রেরণাতেই সৃষ্টি হয়েছে। এখন মনে হয়, স্যার বোধ হয় এভাবেই সংগঠন সৃষ্টির প্রেরণা ও তাঁর সুপ্ত ইচ্ছা আমার মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন।

বেগার্টে ডিপ্লোমা করার সময় বেগ স্যার বললেন, বিপিএসে গিয়ে মেম্বার হবেন। বিপিএস থেকে আসাহি সিম্বুন (জাপানের গণমাধ্যম) আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার ফর্ম নিয়ে ছবি পাঠান। ফর্ম পূরণ করে একাই ছবি পাঠাই জাপানে। ছবিটি প্রদর্শনীর জন্য গৃহীত হয়। ডাকযোগে সুদৃশ্য হার্ড কভারে একটি মনোরম সার্টিফিকেট আসে জাপান থেকে।

লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ফটোগ্রাফি বিষয়ে লেখার জন্য বেগ স্যার আমাকে দীর্ঘ দিন উদ্বুদ্ধ করেছেন। এক ডজন ইংরেজি ম্যাগাজিন দিয়ে বলেছেন লিখুন। লেখা আমার কাছে নিয়ে আসবেন, দেখে দেব। লেখার পর বললেন, নিয়মিত বিপিএসের মাসিক ফটোগ্রাফিতে দিন। আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে ভূমিকা লিখে দিয়ে বললেন, বইটি ভারতেই ছাপতে দিন। স্যারের ‘আধুনিক ফটোগ্রাফি’ বইটির প্রকাশকই (বুকস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রা. লিমিটেড) আমার ‘ফটোগ্রাফি (সহজ ও উচ্চতর)’ বইটি প্রকাশ করে ২০০১ সালে। এরপর স্যার আবার বলেছেন, এনপিআই করুন। বেগ স্যার নিজের ছাত্রদের বিপিএসের বিপিআইয়ে পাঠাতেন। এটা তিনি যে আমার ওপরও প্রয়োগ করবেন, তা ভাবিনি। একদিন বললেন, আপনি বেসিক কোর্সের ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, স্যার ছাত্রেরা তো আপনার কাছ থেকেই শিখবে। বটবৃক্ষের সান্নিধ্যে আসবে এটাই যৌক্তিক। আমি তা-ই মনে করি। তা ছাড়া অপরকে শেখানোর মতো জ্ঞান আমার এখনো হয়নি। স্যার বললেন, হয়েছে আমি জানি, আপনি জানেন না। শুরু করেন, কী করতে হবে পরে বলে দেব। বিপিআই থেকে সিলেবাস নিয়ে যান। নাম তিনিই দিলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট’। পিটার অসীম ডি. কস্টা ও শিহাব চৌধুরী সুমন ছাত্র সংগ্রহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। গোদনাইল থেকে এসেছে কিশোর রিংকু, আরও ছিল পিটারের অনুজ লিটন, সুমনের অনুজ সুজন এবং মোন্তাকিম। দেখেছি এরা সবাই যথেষ্ট মেধাবী, সম্ভাবনাময় ও ফটোগ্রাফি শেখায় অত্যন্ত আন্তরিক। আবার বললেন, আপনি বিপিআইয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিন। আমি বলে দেব। এভাবেই তিনি একজনকে ফটোগ্রাফার সৃষ্টির পর তাঁকে আবার সংগঠক, লেখক ও শিক্ষক হিসেবেও গড়ে তোলেন। তিনি মঞ্জুর আলম বেগ একজন অসাধারণ শিক্ষক, মনের চোখ তৈরি করার নীরব স্রষ্টা, কবি, লেখক ও আলোকচিত্রাচার্য।

নারায়ণগঞ্জ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি গঠনের পর নারায়ণগঞ্জের আলী আহমদ চুনকা পৌর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ ও ১৯৯২–এর অভিষেক অনুষ্ঠান দুটিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এরপর বেগার্টে গেলে বেগ স্যার বললেন, কী খবর আপনার? জি স্যার, কোনো সমস্যা হয়েছে? স্মিত হেসে ‘না, আপনার সংগঠনের নিউজ ঢাকার এক ডজন পত্রিকায় ছাপে। আর আমার বিপিএসের সংবাদ তো দেখি পত্রিকায় নাই। আপনি আগামী বছর বিপিএসের মহাসচিব পদে আসুন। আমিই আপনার জন্য যথেষ্ট।’ বুঝলাম, আমি না বললেও স্যারের সজাগ দৃষ্টি সর্বত্র। এনপিএস প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় ৩০ জন এনপিএস সদস্য ‘বেগার্টে ইনস্টিটিউট’-এ গিয়ে বেসিক কোর্স করেছেন ১৯৯০ সালে। উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় কাসেম জামাল ভাই ও সভাপতি প্রয়াত সুনীল আমিনদাও ছিলেন সেই দলে। যদিও সুনীলদার তখন ফটোগ্রাফি শিখতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের সঙ্গে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন। সংগঠনকে ভালোবেসে ও সবাইকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই ভাতঘুম ত্যাগ করে রোদেলা দুপুরে উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় কাসেম জামাল ও সুনীল আমিন প্রগতির তৈরি ‘সুপরিয়র’ বাসে চড়ে ‘বেগার্টে’ গিয়েছিলেন। সংগঠন সৃষ্টির জন্য বেগ স্যার এনপিএস সদস্যদের কোর্স ফি অর্ধেক করে দিয়েছিলেন। বেগ স্যারকে বললাম, স্যার পিটার ডিপ্লোমা করবে। আরে না-না, ডিপ্লোমা করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ও কঠিন কাজ। ও তো বাচ্চা ছেলে, পারবে না। এসব বাদ দেন। এটা তো এক বছরের কোর্স। দেখছেন না, দশজন ভর্তি হলে আটজনই চলে যায়। অবশেষে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, আচ্ছা নিয়ে আসুন। ১৯৯১ সালে একুশের বিস্মিয় কিশোর পিটার তিন মাসেই ‘ডিপ্লোমা-ইন-ফটোগ্রাফি’ সম্পন্ন করেছে। একেবারেই সামান্য কোর্স ফি দিয়ে। সংগঠন ও তার সদস্য ফটোগ্রাফারদের প্রতি ছিল স্যারের যে প্রগাঢ় মমতা, যা পৃথিবীর তুল্য কেনো বস্তু দিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করা যায় না।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

পোলার আইসক্রিম ফ্যাক্টরির পরিচালক মাসুদ বিপিএস সদস্য। তাঁর আমন্ত্রণে বিপিএস সদস্যরা আইসক্রিম তৈরি দেখতে যাই পোলার আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে। স্যার সহাস্যবদনে বললেন, ফ্রি আইসক্রিম তো খাওয়া যাবে। কী বলেন, চলেন যাই, যদিও আমার ডায়াবেটিস। এভাবেই তিনি বয়সের বেড়াজাল ভেঙে ছোটদের সঙ্গে মিশে হৃদয়ে ঠাঁই করে নেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রশ্ন করেন, ‘জীবনের সৌভাগ্য কী?’ বিভিন্ন উদাহরণ দেওয়ার পর বলেন, ‘অসাধারণ শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়াই জীবনের সৌভাগ্য।’ বেগ স্যার বলেছেন, ‘ফটোগ্রাফার যখন ছবি তোলেন, তিনি কিন্তু পজিটিভটাই দেখেন। ছবিটা কী হবে তা তিনি ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছেন। তাঁর চেতনায় রয়েছে পজিটিভ। দর্শক নেগেটিভ থেকে পজিটিভ দেখে।’ স্যারও ছাত্রদের অন্তর এভাবেই উপলব্ধি করে ছুঁয়ে দেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘যে দেশ ও জাতি জ্ঞানীদের সম্মান দেয় না, সে দেশে জ্ঞানীরা জন্মায় না।’

ক্ষণজন্মা, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী আলোকচিত্রীদের তৃতীয় নয়নের স্রষ্টা, আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ স্যারের প্রতি শিক্ষক দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।