মান
রীমার বাসায় আজ আড্ডা। আমরা চার নারী মিলে আড্ডা দেব আর খানাপিনা করব। আমরা এক সপ্তাহ পরপর এ ধরনের আড্ডার আয়োজন করি। না হলে কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। দেশে এত আত্মীয়স্বজন ছিল যে তাদের খবর নেওয়ার সময় পেতাম না। টরন্টো থেকেও ফোন করে সবার খবরাখবর নেওয়া যায়; কিন্তু কথায় বলে, চোখের দূর, মনেরও দূর। তাই বিদেশের শিকড় যত শক্ত হচ্ছে, দেশের আত্মীয় বন্ধুরাও কেমন হারিয়ে যচ্ছে। এটা হয়তো সবার ক্ষেত্রে হয় না, কিন্তু আবার হয়ও। কাজেই এখানে অল্প যে কয়েকজনকে চিনি, তাদেরকেই আঁকড়ে বাঁচি, তাদের থাকা-না থাকা, তাদের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, তাদের ভালোবাসা-ঘৃণা খুব মূল্যবান। তাই অস্তিত্বের খাতিরে এই আড্ডাগুলো খুব নিয়মিত হয়।
বিদেশে সাধারণত সপ্তাহান্তে শনি বা রোববারে সবাই দাওয়াত দেয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজের শেষে দুই দিনের ছুটিতে সবাই আনন্দ করে। সামারে দেখা যায়, প্রতি শনি বা রোববার কিছু না কিছু দাওয়াত, পিকনিক লেগেই আছে। দেশের মানুষের সঙ্গে কথা হলে দেশকে ভুলে থাকা যায়; মনে হয়, দেশেই তো আছি। কাজেই প্রবাসীরা এই আয়জনে অনেক সময় ব্যয় করে। কিন্তু আজ বুধবার। খুব একটা অদ্ভুত কারণে আমি, রীমা, বর্ণা আর সালেহা বৃহস্পতিবার ফ্রি থাকি। তাই গেট টুগেদারের জন্য বুধবার সন্ধ্যা আমাদের পছন্দের সময়। কাজ শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা চারজন অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে পরদিন একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাই। খুব ছোট আর ঘরোয়া আড্ডা বলে আয়োজনের বাড়াবাড়ি তেমন থাকে না।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সন্ধ্যা। বৃষ্টি হলেও শীত তেমন নেই। টরন্টোতে আবহাওয়া চমৎকার। তাই দেশ থেকে আনা নীল–সবুজ কম্বিনেশনের একটা সালোয়ার–কামিজ পড়েছি। বৃষ্টির দিনে নীল–সবুজ ভালো লাগে দেখতে।
উবার ডেকেছি। আমি হাইরাইজ একটা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ২৪ তালায় থাকি। লক্ষ করেছি, খুব তাড়াহুড়োর সময় লিফট সব সময় দেরি করে। হয়তোবা ঠিক সময়েই আসে, কিন্তু আমার তাড়া থাকে বলে মনে হয় দেরি হচ্ছে। এসব এড়াতে লিফট ধরে লবিতে এসেই উবার ডেকেছি। উবার ড্রাইভারের গাড়ি নীল রঙের হোন্ডা সিভিক আর ড্রাইভারের নাম আহামাদ। বাংলাদেশে এই নাম আছে, কিন্তু আমরা বলি আহমেদ। সাধারণত আরবীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরা আহামাদ বলে থাকে। আরো অনেক নামের ক্ষেত্রেই এ রকম দেখছি। যেমন আমরা বলি, বেনজির আর ওরা বলে বেনাজির।
উবারে ‘ওয়েট টাইম’ চার্জ করে। সবার সময়েরই দাম আছে—বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। অনেক সময় উবার ডেকে দরজায় তালা দিয়ে লিফট ধরে নামতে নামতেই ১০ মিনিট চলে যায়। বিদেশে প্রতিটা ডলার হিসাব করে খরচ করতে হয়। ফোনের অ্যাপে দেখাচ্ছে, গাড়ি আর তিন মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। তাই আমি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সকাল থেকে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্টে ভেতরে থাকার সময় বুঝতে পারিনি; কিন্তু এখন দেখছি বেশ ঝমঝম করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। শীতপ্রধান দেশ বলে এখানকার বাসাগুলোর দেয়াল এমনভাবে তৈরি যে বাইরের শব্দ খুব একটা ভেতরে আসে না। এ কারণে ঘরের ভেতরে থাকলে বাইরে যে এত বৃষ্টি, সেটা বোঝা যায় না। ছাতা মেলে ধরলাম মাথার ওপর।
একটা নীল হোন্ডা সিভিক এসে থামল। নীল রঙের গাড়ি অনেক বেশি নেই। তারপরও গাড়ির নম্বর চেক করে গাড়ির দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ড্রাইভার বলে উঠল,
‘দিজ ইজ আহামাদ। ইজ দিজ সামিনা?’
আমি উত্তরে ‘ইয়েস’ বলে দরজা খুলে পেছনের সিটে বসলাম। গাড়ির ভেতর এসি চলছে। বাইরে বৃষ্টি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। কিংস্টন রোড ধরে আমরা যাচ্ছি। বাইরে ঘন অন্ধকার আর বৃষ্টি পড়ছে বিরামহীন। মাঝেমধ্যে হালকা বিদ্যুৎ–ঝলকও আছে। ড্রাইভারের কথা শুনে মনে হলো, আরব অঞ্চলের মানুষ। সাধারণত মিডল ইস্ট থেকে যারা কানাডায় আসে, তারা সঙ্গে অনেক টাকা নিয়ে আসে। এসেই একটা রেস্টুরেন্ট বা পেট্রলপাম্পের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু এখন অর্থনীতি মন্দা, তাই অনেকেই উবার ট্যাক্সি চালায় বা উবার ডেলিভারি করে। এই কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, নিজের পছন্দমতো সময় বেছে নেওয়া যায়।
ঘড়িতে আটটা ত্রিশ মিনিট। এর মধ্যেই হয়তো সবাই এসে গেছে। আমার দেরি হয়ে গেল আজ। রীমার রান্না খুব ভালো। গত পটলাকে সে আস্ত ইলিশ রান্না করেছিল। রান্না বলছি কারণ, সে নাকি পুরা রান্নাটা প্রেসার কুকারে করেছিল, ওভেনে বেক করেনি। ভেতরের কাঁটা একদম গলে গিয়েছিল। আর স্বাদেও অতুলনীয়। আমরা রীমাকে একটা রেস্টুরেন্ট খুলতে বলি সব সময়। দেশের সব ভালো মাছগুলো মনে হয় রপ্তানি হয়ে বিদেশে চলে আসে। দেশে ইলিশ কেনাটা রীতিমতো অসাধ্যসাধন ছিল। বার্মার ইলিশ, চাঁদপুরের ইলিশ, পদ্মার ইলিশ। বিভিন্ন ইলিশে বিভিন্ন স্বাদ। কিন্তু এখানে সব ইলিশেরই একটা মাঝারি স্বাদ।
খুব হইহল্লা আর ছবি তোলা হবে আজ। আমি খুব যত্ন করে আমাদের এই আড্ডা-পটলাকের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করি। আমার দেশের বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন সে কারণে আমার টরন্টোর বন্ধুদের চেনে। আমি পৌঁছানোর অধীর অপেক্ষায়। ড্রাইভার আহামাদ গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রাখা মোবাইলে নেভিগেশন করে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ সেই নেভিগেশন মোবাইলে একটা ফোন এল। কানাডায় উবার ড্রাইভাররা যাত্রী নিয়ে চালানোর সময় ফোন ধরতে পারে না। কিন্তু আহামাদ ইংরেজি ভাষায় আমাকে বলল,
‘এক্সকিউজ মি ম্যাম, ক্যান আই পিক আপ দ্য ফোন? ইট ইজ মাই ম্যানেজার ফ্রম ওয়ার্ক।’
‘প্লিজ, গো এহেড।’ আমি খুব ভদ্রতার সঙ্গে বললাম।
ফোন স্পিকারে দেওয়া। যিনি ফোন করেছেন, তিনি পরিষ্কার বাংলায়, কিন্তু সিলেটি টানে কথা বলতে শুরু করলেন।
‘সালামু আলাইকুম বাই, খেমন আছুইন?’
‘বালা আছি বাই, আফনের খবর খইন।’
‘আফনের ভাবি কাইল আফনেরে ডিনারে ইনভাইটেশন দিতে কইছুইন। সন্ধ্যা ৭টায় আইবাইন।
‘আইচ্ছা বাই, দেখা হইব। পোয়ার জন্মদিন খিতা?’
‘না না, জন্মদিন না। এম্নেতেই। খতদিন দেহা নাই আফনের লগে।’
‘আইচ্ছা বাই। খোদা হাফেজ।’
এসব কথার পর ফোনটা কেটে আমার উদ্দেশে আহামাদ বলল,
‘থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম ফর লেটিং মি পিক আপ দ্য ফোন। মাই ম্যানেজার ওয়াজ টকিং এবাউট মাই নেক্সট অ্যাসাইনমেন্ট।’
আমি উত্তরে অনেক কষ্টে বললাম,
‘ইটস ওকে।’
আমার ‘ওকে’ শব্দটা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ, ইটস নট ওকে। আমি ভাষাহীন। এতক্ষণ আমি তাকে আরবীয় ভেবেছি। তার নাম, তার ইংলিশ এক্সসেন্ট আরবীয়দের মতো। অথচ সে বাংলাদেশি এবং সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আমার দেশের একজন মানুষ আমাকে অন্য দেশের মানুষ মনে করে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। আমিও যে বাঙালি বিষয়টি অন্ধকারে আহামাদ বুঝতে পারেনি। তাই সে নিশ্চিন্তে মনের মতো গল্প বলে গেল আর আমি চুপ করে শুনলাম আর বললাম, ‘ইটস ওকে।’ লজ্জা লাগছে আমার। হয়তো অল্প আলোতে আর খুব বৃষ্টি থাকার কারণে আহামাদ আমার পরনের সালোয়ার–কামিজ লক্ষ করেনি! আমার নামটাও কি পড়েনি নাকি!
এদিকে রীমার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। বৃষ্টি আরও বেড়েছে। গাড়ির উইনশিল্ডে যতটুকু রাস্তা দেখা যাচ্ছে, পুরোটাই ঝাপসা। ছাতা নিয়ে নামতে হবে। ব্যাগ খুলে ছাতা আছে কি না, দেখার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল। রীমার ফোন। সম্ভবত আমার দেরি দেখে ফোন করছে। এখন আমি ফোন ধরে বাংলায় কথা বলা শুরু করলে আহামাদ অবশ্যই লজ্জা পাবে।
কারণ, তার ফোনালাপের পর তার নিজের মিথ্যাচার তাকে অবশ্যই বিব্রত করবে। আবার আমি ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করলে রীমা অবাক হবে। কী করব, চিন্তা করছি। রীমার ফোন কেটে গেল। আমি ফোন সাইলেন্ট করে দিলাম।
রেড সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সপ্তাহের মাঝের দিন বলেই হোক আর বৃষ্টির কারণেই হোক, রাস্তা ফাঁকা। সিগন্যাল ছেড়ে বাঁয়ে মোড় নিলেই রীমার বাসা। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায় রীমার বাসার গাড়ি বারান্দার আলো মিশে প্রতিফলনে সবকিছু অস্পস্ট ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। আমি ছাতা নিয়ে দ্রুত নামলাম। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, আমার পরনের সালয়ার-কামিজ যেন এই অস্পষ্ট আলোয় আহামাদ লক্ষ না করে। নামার সময়ে খুব জোর দিয়ে বললাম,
‘থ্যাঙ্ক ইউ আহামাদ, ইট ওয়াজ আ নাইস রাইড।’