মরক্কো ভ্রমণের গল্প: শেষ পর্ব

পরিবারের সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

আমরা মারাকাশের (মরক্কো) যে অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছি, তার চুলা কাজ করছে না। রান্নাবান্না হবে কী করে! এ কয় দিন মরক্কোর খাবার খেয়েছি। ভাত–তরকারি না খেলে গলা শুকিয়ে আসে! ফোন দিলাম অ্যাপার্টমেন্টের মালিককে। তিনি বললেন, ‘আমি একজন মিস্ত্রি পাঠাচ্ছি।’ ১০ মিনিটের মধ্যে মিস্ত্রি এসে হাজির। একজন ভদ্রমহিলা। কথা বলে জানলাম, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। গণিতের। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের স্ত্রী তাঁর বান্ধবী। পাশের বিল্ডিংয়েই থাকেন। একটা চাবি দিয়ে আমাকে বললেন, ‘এই চুলার গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। গ্যাস সিলিন্ডার বদলানোর লোক পাওয়া যাবে না। লোকজন ঈদের ছুটিতে। পাশেই আমাদের আরেকটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আপনারা চাইলে ওইটা ব্যবহার করতে পারেন। ওখানকার গ্যাসের চুলা ঠিক আছে।’ তিনি আমাকে ওই অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন। সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট। অতঃপর আমরা ওই অ্যাপার্টমেন্টও ব্যবহার করতে থাকলাম। গরু কিনলে ছাগল ফ্রি, ব্যাপারটা এ রকম।

যা–ই হোক, ভাত–তরকারি খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল। পরদিন বেলা ১১টায় আদিল এসে উপস্থিত। পথে কুড়িয়ে পাওয়া আমাদের মরক্কোর বন্ধু। সে আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল মেনারা গার্ডেন। এটা বারো শতকে রাজাদের তৈরি একটি বড় উদ্যান। চারদিকের জলপাই আর কমলার বাগান। মধ্যখানে বিশাল এক পুকুর। তার এক পাশে নান্দনিক এক স্থাপনা। পুকুরে আছে অসংখ্য মাছ। আমার ছেলে এক দিরহাম দিয়ে একটা ব্রেড কিনে মাছেদের খেতে দিল। অসংখ্য মাছ এসে হাজির হলো আমাদের চোখের সামনে। লেগে গেল উৎসব। আমাদের চোখে আনন্দ। চারদিকে বাতাস বইছে। গরম উড়িয়া নেয় হাওয়া। ভালো লাগছে। ভীষণ, ভীষণ। আদিল ক্লিক ক্লিক ছবি তুলছে। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের মতো। সে আগে মরক্কোর ভলিবল টিমের সদস্য ছিল। খেলে টাকা পেত অনেক। অবশ্য টাকার প্রতি তার খুব মোহ আছে এমনও নয়। তবে চাকরি নেই বলে হতাশা আছে। হঠাৎ একটা কমলাগাছের নিচে দেখা হয়ে গেল এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম থেকে। তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলব কমলা–বাগানে, কিন্তু আমার ফোন কাজ করছে না। ব্যাপার কী! ছেলেকে বললাম, ‘দেখ তো।’

ছেলে মুঠোফোন টিপে বলল, ‘তোমার ফোন ওভার হিট হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কাভার খোলো, বাতাস লাগাও।’ এ রকম সমস্যা এর আগে কখনো আমি ফেস করিনি। ছেলের কথামতো কাজ করায় ফোন ঠিক হয়ে গেল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই। অতঃপর আমরা গেলাম কেএফসি খেতে। এখন কোথাও যেতে বা খেতে আমাদের কোনোই সমস্যা হয় না। আদিল সঙ্গে আছে। আরবি জানা লোক। সে আমাদের হয়ে সব কাজ করে ফেলে। অবাক হলাম তার ভদ্রতাজ্ঞান দেখে। আমি বয়োজ্যেষ্ঠ বলে আমার সামনে সিগারেট খায় না। লুকিয়ে গিয়ে খায়। কোনো টাকাও চায় না। যা দিই, তা-ই নেয় খুশি হয়ে। খাওয়ার পর আদিলকে বললাম, ‘তুমি আমাদের মাদিনা মার্কেটে নামিয়ে দাও। আমরা কেনাকাটা করব। আর আমার ছেলেকে নিয়ে যাও ক্যাম্পে। মরুভূমিতে বাইক চালাবে। উটে চড়বে।’

সে বলল, ‘সমস্যা নেই। তবে আমাদের ফিরতে দেরি হবে। জায়গাটা বেশ দূর।’

‘ওকে। কিন্তু একটা কথা। আমি জানি, মরুভূমিতে বাইক চালানো অনেক রিস্কি।’

‘আপনি ভাববেন না। আমি তো আছি। আর ওখানে আমার এক বন্ধু আছে। ডিসকাউন্টও পাব।’

আমাদের মার্কেটে নামিয়ে আদিল ও আমার ছেলে অনুভব চলে গেল মরুভূমিতে। আমরা শপিং করলাম। খাওয়াদাওয়া করলাম। এখানেও দেখা মিলল আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা থাকেন ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ডে। তাদের আদিলের নম্বর দিয়ে বলেছি, ‘কোনো সমস্যায় পড়লে ওকে ফোন দিয়েন। সাহায্য করবে।’ অতঃপর আমার বউ লেগে গেল জুস খেতে। একটার পর আরেকটা জুস খায়। ফ্রেশ জুস। কখনো অরেঞ্জের, কখনো পেঁপের, কখনো আনারসের।

‘ব্যাপার কী! এত জুস খাচ্ছো!’

‘আরে, এত সস্তা জুস কই পাবা! মাত্র পাঁচ দিরহাম করে (৬০ টাকা)। তুমিও খাও, তুমিও খাও।’

জুস খাওয়ার পর বউকে বললাম, ‘কাল তো লন্ডন চলে যাব। আরও কোনো শখ থাকলে বলো।’

‘ঘোড়ার গাড়ি তো চড়লাম না।’

‘নিয়ে গেলাম ঘোড়ার গাড়ির কাছে। ১০ মিনিট নিয়ে ঘুরবে। দাম হাঁকল ২০০ দিরহাম। মানে ২ হাজার ৪০০ টাকা। শুনে বউ একটা লাফ দিল, ‘মামার বাড়ির আবদার পাইছে!’

‘১০০ দিরহামে রাজি হয়ে যেতে পারে, মানে ১ হাজার ২০০ টাকা।’

‘রাখো তোমার ১ হাজার ২০০।’

এখন বউ কোনো কথা শুনতেই রাজি নয়। সোজা হাঁটা দিল ট্যাক্সির উদ্দেশে। ট্যাক্সি নিয়ে এলাম সুপারস্টোরে। কিছু খাবারদাবার কিনলাম। আগামীকাল লন্ডন চলে যাব। প্রস্তুতি।

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গোসল করলাম। বউ ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করল। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ফোন করলাম ছেলেকে, ‘কি বাবা, খবর কী?’

‘বাবা, আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি।’

‘বলিস কী।’

‘মরুভূমিতে বাইক চালানো খুব কঠিন। আমার বাইক প্রায় উল্টে গেছিল। কোনোরকমে বেঁচেছি। সমস্যা নেই, আমাদের ইনস্যুরেন্স করা আছে।’

‘আরে বেটা, মরে গেলে ইনস্যুরেন্স দিয়ে কী করুম!

‘তুমি ভেবো না, আমরা একটু পর চলে আসতেছি।’

কথা বলে বুঝলাম ছেলে খুব আনন্দে আছে। সে অ্যাডভেঞ্চার খুব লাইক করে। কিশোর বয়স।

রাত ১১টায় ছেলে ফিরল। অ্যাপার্টমেন্টে। শরীরে একগাদা বালু। ছেলের মা ব্যস্ত হয়ে উঠল তার পরিচ্ছন্নতায়। ছেলে বলল, ‘জানো মা, আজ কত টাকা খরচ করে এসেছি।’

‘কত’

‘১৫০ পাউন্ড ( ২১ হাজার টাকা)।’

‘কি! তুই রোজ রোজ এত টাকা খরচ করতেছিস...।’ তার মা বয়ান দেওয়া শুরু করল। আমি তাকে থামালাম, ‘আরে, মরক্কো কী আর রোজ রোজ আসবে! করুক না একটু...।’

ছেলে মহাখুশি। এসে বিস্তারিত বলতে লাগল। অভিযানের কথা। কোথায় গেল, কী করলো, এসব।

‘তা, আদিল কোথায়?’

‘সে তো আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।’

‘তাকে টাকাপয়সা দিসনি?’

‘না।’

‘ওহ মা। সারা দিন তোকে সঙ্গ দিল, পেট্রল খরচ করল, টাকা দিবি না!’

‘সেও তো আমার সঙ্গে বাইক চালাইছে। ওর টাকা তো আমিই দিছি।’ ছেলে বলে।

‘সমস্যা নেই, আগামীকাল তো আমাদের বিমানবন্দরে নামিয়ে দেবে। তখন কিছু টাকা দিয়ে দেব আদিলকে,’ আমি বলি।

সকাল সাড়ে ছয়টায় আদিল আসে অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের বিমানবন্দরে নামিয়ে দেবে বলে। ওকে প্রথমে কিছু খাবার দিলাম। নাশতা। তারপর আমাদের ব্যবহৃত দুটি ব্যাগ দিয়ে বললাম, ‘চাইলে এগুলো নিতে পারো।’ সে খুশি হয়ে ব্যাগ দুটি নিল। তারপর আমাদের নিয়ে চলল বিমানবন্দরের দিকে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। ব্যাগপত্র নামানোর পর আমি ও আমার ছেলে আদিলকে জড়িয়ে ধরলাম। খুব মায়া অনুভূত হচ্ছে তার জন্য। সে আমাদের রক্তের কেউ নয়, ভাষার কেউ নয়, দেশের কেউ নয়, তারপরও সে কীভাবে যেন আমাদের কেউ হয়ে উঠল। জীবনটা এ রকমই। চলতে পথে কত মানুষ আপন হয়ে যায়। নিজের অজান্তে থেকে যায় হৃদয় গহিনে। অলক্ষে। মমতায়। গোপনে।

পকেটে যত টাকা ছিল সব দিয়ে আদিলকে বললাম, ‘আদিল, যোগাযোগ রেখো। তুমি আর তোমার বউ বেড়াতে এস লন্ডনে।’

‘অবশ্যই। অবশ্যই।’

খেয়াল করি আদিলের চোখও ভেজা। আমাদের মতোই। শেষ...

দূর পরবাসে ভ্রমণ, ভিডিও, ছবি, ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]