স্বপ্নজল–২

রিদিতা খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে...
জ্বী আমি রাহাত,
মৃদুলা বলল এই ঘরে আসতে...
রিদিতা উঠে দাঁড়াল, খুবই সাধারণ সরল চেহারার একটা ছেলে, বেশ লম্বা, চেয়ার দেখিয়ে  রিদিতা বলল বসুন।
আমি রিদিতা...

জ্বী আমি জানি, কেমন আছেন?
রাহাত বসল চেয়ারে।
রিদিতা বিছানায় বসতে বসতে বলল, কীভাবে জানেন?
আপনার বাবা বলেছেন।
আর কী বলেছেন?
আর কিছু না, শুধু বলেছেন, আপনি স্বপ্ন দেখে ভয় পান, আর মাঝেমধ্যে কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়...

ওহ, তাহলে তো বাবা সব বলেই দিয়েছেন।
নাহ, সব বলেননি।
কোনোটা বাকি রেখেছেন?
সেটা ঠিক বলতে চাচ্ছি না...
কেন?

কিছু জিনিস বাকি থাকা ভালো, এ যে আমি আজ এসে আপনাকে দেখে জানলাম...
মৃদুলা বেশ শব্দ করে ঘরে ঢুকল চা আর মোঘলাই–পরাটা নিয়ে, টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, রাহাত ভাই এখন চা–নাস্তা খান, আর এক ঘণ্টার মধ্যে রাতের খাবার তৈরি হয়ে যাবে, মা ইলিশ পোলাও করছে, সঙ্গে  ইলিশ মাছের ডিম ভুনা, কবুতরের মাংস আর জলপাইয়ের আচার...

ঝড়–বৃষ্টির দিন ভয়াবহ মজার খাবার, মার রান্না খুবই মজা।
রিদিতা মনে মনে বেশ অবাক হচ্ছে, রাহাতকে আজ সে প্রথম দেখল, কিন্তু এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেন!
মনে হচ্ছে  কত দিনের চেনা...
নির্দ্বিধায় তার সব সমস্যা খুলে বলা যায়...
নিশ্চিন্তে এই ছেলের হাত ধরা যায়...

আপা এই নে, তোর চা... এক চামচ চিনি দেওয়া আছে।
তুই খাবি না?
খেয়ে ফেলেছি, বুয়া তো চলে গেছে বিকেলে...
মা সালাদ কেটে দিতে বলেছে, আমি যাই
তোরা গল্প কর...

রাহাত ভাই আপা কিন্তু খুব ভালো গান গাইতে পারে, তবে গাইতে বললে গাইবে না, ইচ্ছে হলে আপন মনে গায়....
বলে হাসি দিয়ে চলে গেল।
রিদিতা চুপচাপ মৃদুলার যাওয়া দেখল...
রাহাত বলল, কেমিস্ট্রি পড়তে কেমন লাগছে?
হুম, ভালো...
আমি সায়েন্স পছন্দ করি।

আপনি কী করেন? পড়াশোনা, না চাকরি...
আমি  মাত্রই মাস্টার্স শেষ করলাম ফিজিক্স এ,
দুই মাস হলো একটা চাকরিতে জয়েন করেছি,
মা চায় বিসিএস দিই, আমার ইচ্ছে করে না।
বাসায় আমি আমার মা আর ছোট একটা ভাই,
বাবা বেশ কয় বছর হলো মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্ট এ ...
আপনি খুব বৃষ্টি পছন্দ করেন, তাই না?

কীভাবে বুঝলেন?
প্রায়ই দেখছি জানালার বাইরে আপনার চোখ ...
খুব মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টি দেখছেন।
আপনি কি সব সময়েই শাড়ি পরেন, নাকি আজকেই
পরলেন?

না, শাড়ি খুবই কম পরা হয়, মা বলল আজ পরতে। হুম, এজন্যই মনে হয় জড়সড় হয়ে আছেন,
কিন্তু আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে এই রংটায়...
মনে হচ্ছে  আকাশ ভেঙে পড়েছে শাড়িতে।
রিদিতা মনে মনে মনে চমকে গেলেও খুব স্বাভাবিকভাবে বলল ধন্যবাদ।
আচ্ছা আজ তাহলে আমি উঠি?

আমার মা আসলেই খুব ভালো রাঁধেন, খেয়ে যান...
এই কথার মানে কি ধরে নেব, তোমার আমাকে পছন্দ হয়েছে?
সরি, অনুমতি ছাড়া তুমি বলে ফেললাম,
তোমাকে আপনি বলতে ইচ্ছে করছে না।
আপনি ড্রয়িং রুমে বসুন, বাবা অপেক্ষা করছেন।
মা খেতে ডাকলে আমি আসব।

রাহাত রিদিতার দিকে তাকিয়ে ছিল, এই কথা শোনার পর মৃদু হেসে বলল  তোমাকে আমি কত খুঁজেছি রিদিতা,
তুমি যদি তা জানতে...
আমাকে খুঁজেছেন কেন?
আমিও তোমার মতো অনেক স্বপ্ন দেখি, আর বৃষ্টি ভালোবাসি...বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাহাত।

অনেকগুলো মোমের আলোতেই রাতের খাবার খাওয়া শুরু হলো, রিদিতা একদমই চুপ ছিল খাওয়ার টেবিলে, কোনো কথা বলেনি রাহাতও। রাতের খাবার খেয়েই রাহাত রফিক সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর কোনো কথা হলো না কারও...

শুধু রোকসানা বলে উঠলেন ছেলেটাকে একটা ছাতা দিলে হতো না, এখনো তো বৃষ্টি পড়ছে...ভিজে যাবে তো।

মৃদুলা বলল মা, এক–দুই দিন বৃষ্টিতে ভিজলে তেমন কিছু হয় না, আর তোমার বড় মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে এমনিতেই তার অনেক বৃষ্টিতে ভিজতে হবে, তার চেয়ে বরং অভ্যাস হোক, বলেই হাসতে লাগল...

রিদিতা ঘরে এসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল তখনো বেশ বৃষ্টি, শাড়ি বদলিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, সকালে উঠতে হবে... সঙ্গে সঙ্গেই তার রাহাতের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল, ইস্ ছেলেটা একদমই ভিজে বাড়িতে ফিরবে ..আচ্ছা চেনা নেই, জানা নেই, মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট কথা বলে কারও জন্য এত মায়া জন্মে! আশ্চর্য।

মৃদুলা ঘরে ঢুকল, আপা এই নে তোর মোমবাতি...ইলেকট্রিসিটি কখন আসবে, কে জানে,
আচ্ছা আপা, এটা কি তোর জীবনের প্রথম ডেট ছিল?
নিজের ঘরেই ডেট করলি তাও আবার মোমের আলোতে...কি কপাল তোর!
মৃদুলা, কাল কিন্তু কলেজে যাবি না, ঝামেলা হতে পারে।
আপা প্রথম ক্লাসটা করে চলে আসব...
না, বলছি তো যাবি না, পরশু যাস।
মানা করছি, শুনিস না কেন।
আচ্ছা যাব না, আমি তোর সঙ্গে ঘুমাই আজ?
হ্যাঁ, আয়....

তোর চুলে বিলি কেটে দেই, যেমনটা ছোটবেলায় দিতাম।
হ্যাঁ দে, রাহাত ভাইকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, তোদের দুজনকে খুবই মানাবে, তোর কেমন লেগেছে আপা?
আমারও ভালো লেগেছে, বাবাকে বলিস
আমি বিয়ে করতে রাজি...তবে অনার্স শেষ করে।
সত্যি বলছিস আপা?
আমার না খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, এখনই যাই, বলে আসি মা–বাবাকে?
না কাল বলিস, এখন ঘুমা...

ভাবতেই ভালো লাগছে, আমি ছাড়াও তোর একজন কেউ হলো। রাহাত ভাইয়ের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে দেব তোকে, তোরা কথা বলিস...

রিদিতা মৃদুলার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
সে দেখা যাবে ক্ষণ, এখন বল তুই তোর কলেজের ম্যাথ টিচারকে চিরকুটটা দিলি কেন, তোর কি উঁনাকে পছন্দ?
মৃদুলা চমকে উঠল... আপা তুই কি মানুষের মনেও ঢুকতে পারিস?
নাহ, পারি না... এমনিতেই বললাম।

মেয়েরা অতিরিক্ত আবেগে অনেক সময় ভুল মানুষ পছন্দ করে বসে, ক্লাস নাইন–টেন থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সময়টা বেশি ভয়ংকর। এরপর কিন্তু ভুল কম হয়...
আশাকরি তুই ভুলের বয়স পাড় করে ফেলেছিস,
ভুল আবেগকে প্রশ্রয় দিবি না...বুঝেছিস?
রিদিতা দেখলো মৃদুলার নিঃশ্বাস ভারী, ঘুমিয়ে গেছে।
রিদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরল, সঙ্গে সঙ্গেই তার রাহাতের কথা মনে পড়ল...

ছেলেটা কি বাসায় ফিরতে পেরেছে, এখনো বৃষ্টি হচ্ছে
রাহাতও তার মতো স্বপ্ন দেখে..., যেই স্বপ্ন দেখে কিছুই করার থাকে না, শুধুই চোখের জল ঝরে...

বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল রিদিতার, সূর্যের কড়া আলো চোখে এসে লাগছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১টা বেজে গেছে, তাড়াতাড়ি উঠে রান্নাঘরের  দিকে গেল রিদিতা...

মা, মৃদুলা কই? রোকসানা বেশ খুশি মনে জিজ্ঞাসা করল, রাহাতকে নাকি তোমার পছন্দ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
কি যে খুশি হয়েছি  মা, তোমার বাবাও খুবই খুশি
খুব ভালো ছেলে...

মৃদুলা কই?
কলেজে গেছে, এখনি আসবে
কেন?
চিৎকার করে উঠল রিদিতা....

আমি মানা করেছিলাম, তোমাকে আর বাবাকেও তো বলেছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে  ঘরে দৌড়িয়ে গিয়ে মৃদুলার মুঠোফোনে ফোন করল রিদিতা
ফোন বন্ধ... তার মাথা ঘুরছে, আজকে শনিবার...

মা, আমাকে ধরো।
রিদিতা বিছানায় মাথা ঘুরে পরে গেল।
রোকসানা দৌড়িয়ে মেয়েকে ধরলেন...
রফিক সাহেব কে ফোন দিলেন
বিকেল ৫টা বাজে...

মৃদুলা এখনো ফেরেনি, বন্ধুবান্ধবরা বলেছে মৃদুলা আজ কলেজেই যায়নি!
এখন থানা, পুলিশ, হাসপাতাল সবখানে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
রিদিতা তার বিছানায়, একটু পর পর মৃদুলা বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে...
বাসার সবার মুখ থমথমে, ঠিক সাড়ে পাঁচটায় রাহাত এল, রফিক সাহেব বিকালে ফোন করেছিলেন তাকে...

রোকসানা রাহাত কে দেখে বলল, বাবা অফিস থেকে এসেছো...খাওয়ার টেবিলে আসো, খাও কিছু

কি যে একটা বিপদ হলো, রিদিতা মানা করেছিল, কেন যে সকালে ভুলে গেলাম...
রিদিতা কোথায় খালাম্মা?
ওর ঘরে
আমি একটু যাই, দেখে আসি
যাও, ওর অবস্থাও ভালো না, সারাক্ষণ কান্না করছে

রিদিতা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে
রাহাত ঘরে ঢুকে বলল, রিদিতা
রিদিতা মাথা তুলে তাকিয়ে বলল, রাহাত আমি মৃদুলাকে বাঁচাতে পারলাম না, বলেই জোরে কান্না শুরু করল...
রিদিতাকে দেখে রাহাতের খুবই কষ্ট লাগল,
কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার
কাল কেমন দেখল, আজ কেমন!
বলল এসব কি বলছ, আটকে গেছে হয়তো কোথাও, ফিরে আসবে...
নাহ, আসবে না

ওকে মেরে ফেলছে ওই স্যার, একটু পর ওর ডেডবডির খবর আসবে
রাহাত এগিয়ে গিয়ে রিদিতার মাথায় হাত রাখল,
এসব বলে না, এমন কিছুই হবে না... আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুমি ঘুমাও। মৃদুলা ফিরে আসবে...
রিদিতা রাহাতের দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল,
যা বললাম তা একটু পরেই শুনতে পাবে,
ঠিক দুই মাস পর আমাদের বিয়ে হবে...
এর ঠিক এক বছর পর আমাদের একটা মেয়ে হবে,
যার নাম আমরা রাখব মৃদুলা,

মৃদুলা এভাবেই ফিরে আসবে।
অবাক চোখে রাহাত তাকিয়ে আছে রিদিতার দিকে
দূর থেকে রোকসানা বেগমের  মৃদুলা বলে চিৎকার শোনা গেল...। শেষ।

শায়লা জাবীন।