জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে একজন বন্ধু
বন্ধুত্ব মানে প্রাণের মধ্যে পারস্পরিক একটি বিশেষ সম্পর্ক। আত্মার মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন হলো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব কোনো বয়স মেনে হয় না। তবে বন্ধুত্বের মধ্যে যে জিনিসটা অবশ্যই থাকা চাই, তা হলো বিশ্বাস এবং অঢেল ভালোবাসা। আত্মার সঙ্গে আত্মার টান থাকতেই হবে। ব্যক্তির মানসিক উন্নয়নের প্রতিনিধিত্বকারী পিতামাতার বন্ধনের পরেই হলো বন্ধুত্ব। শৈশবের শেষ এবং পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বন্ধুত্ব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অন্যদিকে বন্ধু মানে জীবনের সবুজতম সম্পর্ক। বন্ধু মানে দুটি দেহের একটি প্রাণ। আরও সহজ করে বলতে গেলে আত্মার কাছাকাছি যে বাস করে, সেই বন্ধু। ছোট-বড় সবাই একে অপরের বন্ধু হতে পারে। বন্ধু মানে সব সময় কিংবা অসময়ের সঙ্গী। কিশোর থেকে বৃদ্ধ, সবাই বন্ধুত্বের কদর করেন। বলা হয়ে থাকে, যদি বন্ধু হও, হাতটা বাড়াও। বন্ধুত্বের সেই হৃদয়ের আহ্বানে মিলেছে সব বন্ধুর হাত। সত্যিকারার্থেই বন্ধুত্ব এক অদ্ভুত সম্পর্কের নাম। রক্তের হয়তো কোনো লেনদেন থাকে না এ ক্ষেত্রে, তবু সে সম্পর্কের চেয়েও বেশি আবেগের হয়ে ওঠে বন্ধুত্ব।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের বন্ধুত্বটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জারে। ভার্চ্যুয়াল জগতে আমরা নানা ধরনের বন্ধু তৈরি করে থাকি কিন্তু তার স্থায়িত্ব হয় এক দিন, দুদিন বা কয়েক মাস। এমন বন্ধুত্বে থাকে না কোনো বিশ্বাস বা আস্থার জায়গা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে জীবনে সৎ বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে সফলতার পথ দেখাতে পারে ভালো বন্ধুরা। তবে বন্ধুত্ব হোক ভালোবাসার প্রতীক এবং তা যেন শুধু দিবসে সীমাবদ্ধ না থাকে।
এখন আমি কীভাবে নির্ধারণ করব কে রিয়েল বা প্রকৃত বন্ধু?
প্রযুক্তির এই যুগে ভাবছি থার্মোমিটারের মতো ভালোবাসা মাপার একটি অনুভূতি মিটার তৈরি করব। কারণ, এ ধরনের প্রযুক্তি শুরু হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। কী মনে হয় যদি আমি বলি আমাদের শরীরের যেকোনো একটি অংশে একটি সিম কার্ড বসানো হবে এবং সব ধরনের খবর সেখানে আসবে? টেলিফোন বা কোনো ডিভাইস দরকার হবে না? শুধু তাই নয়, চোখের পর্দায় পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে তা দেখতে পারবো? চোখের পলক ফেলবো আর নতুন খবর দেখবো যা আজ রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে আমরা করে থাকি?
মানবজাতি যত জানবে, তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে তত সচেতন হবে। আমাদের শরীরের কাজকর্ম থেকে শুরু করে ব্রেনের বিভিন্ন চিন্তা চেতনা এর সবকিছুই কপি করা যাবে। আমরা যেমন খাবার খাই এবং আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তার সবই শরীর ধাপে ধাপে তার মতো করে তৈরি করে। ঠিক তেমন করে এমন প্রযুক্তি তৈরি করা হবে যা নিজের মতো করে চলবে এবং ভাববে যেমন এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স)। যেহেতু আমরা এ উন্নতির জন্য কাজ করব, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিলাসিতা বাড়তে থাকবে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ কিছুই করবে না, তারা শুধু আনন্দফুর্তিতে মেতে থাকবে। কিছু লোক ক্রিয়েটিভ হবে এবং নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটাবে বিশ্বের মানবকল্যাণের জন্য। দিনে একটি ট্যাবলেট খেলেই যা দরকার শরীর তা পেয়ে যাবে। মানুষের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন হতে থাকবে। মানুষ চলাচল করবে তার নিজের মতো করে, ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যাবে, ফ্লাই করতে চাইলে করবে কোনোরকম ট্রাফিক সমস্যা ছাড়াই। চিন্তাকে কর্মে প্রতিফলিত না করা পর্যন্ত সবাই বলবে এসব শুধুই কল্পনা। তবুও বলে রাখি, সব কিছুই না জানা, না শোনা, না দেখার আগে কিন্তু অজানা ছিল। আমরা কি আগে ব্যাকটেরিয়া দেখেছি? এখন তার চৌদ্দগোষ্ঠী চিনি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
যা–ই হোক, চেনাজানার ভাবনা থেকে বর্তমানে ফিরে এক কাপ কফি পান করতে রান্না ঘরে যেতে হবে। আমার সহধর্মিনী মারিয়া অপেক্ষা করছে। তিনি আমার বন্ধুও বটে, কফি হাউজে আড্ডাখানায় ডাকছেন, যেতে হবে। কারণ, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডামারা সঙ্গে চা-কফি পান করা এতে মজাই আলাদা, এ বাদ দিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তাই বলি, চলো এক কাপ চা বা কফি সঙ্গে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কিছুক্ষণ হয়ে যাক কিছু হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত, কিছু আশা আর কিছু ভালোবাসার প্রত্যাশা। এসো হে বন্ধু এসো মজা করি।
এখন সমস্যা হলো সব বন্ধুর সঙ্গে তো মজা করা সম্ভব নয় তারপর মজার আবার ধরন নানারকম। সেক্ষেত্রে জানতে হবে বন্ধু কী।
বাংলাদেশে থাকতে বন্ধু শব্দটি সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা ছিল। সুইডেনে আসার অনেক দিন পরে বন্ধুর ডেফিনেশন এবং প্রকৃতপক্ষে বন্ধু কী, সে বিষয়ে একটি ভালো ধারণা হয়েছে। এখানে আবার বন্ধু ছাড়াও আরও অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেমন পুলারে (সাথি), কমপিস (দোস্ত), কামরত (সহচর), আর্বেটস কামরত (সহকর্মী) বা বেশতা ভ্যান (সেরা বন্ধু)।
বেশতা ভ্যান মানে রিয়েল ফ্রেন্ড বা সেরা বন্ধু।
আমি এমন একজন বন্ধু হতে বা পেতে চাই যে আমার বন্ধু সব সময়ের জন্য।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর আজ বর্ণনা করব বন্ধু কী? কত প্রকার বন্ধু জীবনে দেখেছি এবং পেয়েছি কি একজন সেরা বন্ধু জীবনে?
ইংরেজি এবং বাংলায় বেশ পরিষ্কার যেমন বিপদের সময় যে কাছে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু। সুইডিশরা বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে দেখে। এদের কাছে শুধু বিপদে নয়, ভালো সময়েও এরা বন্ধুকে কাছে পেতে চায়।
আমি আমার জীবনে দেখেছি পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল পরে বিদেশে এবং কর্মে যেখানেই হোক না কেন, সম্পর্ক নয় অবস্থানের ওপর নির্ভর করে বন্ধুত্বের গভীরতা। বাংলাদেশে যখন থেকেছি নানা ধরনের বন্ধু ছিল। বলতে গেলে বেশিরভাগই দোস্ত বা সাথি যদি তুলনা করি বর্তমানের সঙ্গে। সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বেশীর ভাগই দোস্ত বা সহচর ছিল। কর্মজীবনে সবাই সহকর্মী। ছোটবেলার সেই বাল্যবন্ধু থেকে শুরু করে আজ অবধি যত ধরনের সম্পর্ক আমার জীবনে হয়েছে, তাদের কাউকে আমি ছোট বা বড় করে দেখিনি। কারও বিপদে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করিনি বা কারও সুখের সময় শুধু তার সঙ্গে থাকিনি। তারপরও সেরা বন্ধু কতজন পেয়েছি, তা নিয়ে পড়েছি ভাবনায়! তারপরও আমি মনে করি, একজন ভালোবন্ধু মানে যাকে বিশ্বাস করা যায়। যার সঙ্গে মনের কথা প্রাণ খুলে বলা যায়। যার সঙ্গে কথা বলতে কোনো জটিলতা দেখা দেয় না। যার সঙ্গে কথা বলতে বা মিশতে সারাক্ষণ ভাবনায় পড়তে হয় না। যে কষ্ট দেয় না বা ছোট করে দেখে না। যে অর্থ বা সাফল্যের কারণে ঘোরাঘুরি করে না। যে ভালোবাসতে কৃপণতা করে না। যে বকা দিতে দ্বিধাবোধ করে না, যদি সে মনে করে বকা দেওয়ার মতো কাজ করেছি। যে পরশ্রীকাতর হয় না বা হিংসা করে না। এসব গুণে গুণান্বিত কতজন বন্ধু আমাদের জীবনে আছে, তা আমি জানি না। তবে আমি যদি আমাকে নিয়ে ভাবি, পড়ি কি আমি এসব গুণের মধ্যে! আমার গুণাগুণের দায়ভার ছেড়ে দিলাম তাদের কাছে, যাদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা।
একটি জিনিস না বললেই নয়, তা হলো অনেক বন্ধু আছে তারা সত্যিকার অর্থে বলতে হয় ‘গুঁড ফর নাথিং’, তবে সমাজে চলতে হলে এদের বাদ দিয়ে চলা যাবে না। আমার একটি বদনাম আছে, তা হলো আমি নাকি খুব সহজেই বন্ধুদের বড় করে তুলে ধরি। কথাটি সত্যি, কারণ, আমি মনে করি, তারা আমার বন্ধু তা–ই। ধারণার সঙ্গে কর্মের অমিলের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধু আর বন্ধু থাকে না। স্বার্থের টানে প্রিয়জন যখন দূরে সরে চলে যায়, তখনই কিন্তু সেই প্রিয়জন হয় অপ্রিয়।
আমার কর্মজীবনের একটি সময়ে আমি একটি জিনিস শিখেছিলাম। সেটি হলো বন্ধুত্ব গড়া থেকে কীভাবে একজন শত্রু এলিমিনেট করতে হবে। একজন শত্রুকে যদি ভালোবাসা এবং বিশ্বস্ততা দিয়ে জয় করতে পারি, তাহলে সে ভালো বন্ধু না হলেও শত্রু থাকবে না। একজন বেইমান বন্ধুর চেয়ে একজন সত্যিকারে শত্রু অনেক শ্রেয়। তবে আমি আজ কিছু বাংলাদেশের বন্ধুদের কথা তুলে ধরব, যাদের আমি মনে করি, তারা আমার ওপরের যে দিকগুলো তুলে ধরেছি, তার মধ্যে পড়ে। আমি দূরপরবাসে থেকে নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত। যদিও বেশিরভাগ কাজ সমাজের অবহেলিত মানুষদের নিয়ে। তারা হয়তো ধরে নিতে পারে, আমি তাদের বন্ধু; কারণ, বিপদে আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিই। কিন্তু আমি তো শুধু বিপদের বন্ধু হতে চাই না। বিপদের বন্ধুত্বে রয়েছে এক্সপেকটেশন। আমি বন্ধু হতে চাই শুধু দুঃখে নয়, বন্ধু হতে চাই সুখের বন্ধনে ভালোবাসার সমন্বয়েও। নাম না বলি, তবে সত্যি আমি অনেক সুন্দর মনের বন্ধুদের পেয়েছি, তারা শুধু নিতে নয়, দিতে শিখেছে। তারা প্রমাণ করে চলেছে তাদের মহানুভবতার। তারা তাদের নৈতিক মূল্যবোধ এবং মানবতাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে। কারণ, আমার বিশ্বাস তারা বন্ধুত্বের বন্ধনকে ভালোবাসা দিয়ে বেঁধেছে। যে বন্ধুত্বে ভালোবাসার ছোঁয়া জড়িত, সে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। সেরা বন্ধুর দরকার নেই, ভালো বন্ধু হতে ও পেতে চাই। আমি নিজেকে আপ্লুত মনে করি এই ভেবে যে দূরে থাকি তবুও পেয়েছি অনেক ভালো বন্ধু। আসবে সামনে বন্ধু দিন, ভালোবাসার দিন। এসো বন্ধু কাছে এসো, ধরো শক্ত করে ধরো, যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যাও এবং প্রযুক্তির মাপকাঠি যাকে ওপরে বলেছি ‘অনুভূতি মিটার’ সেটা দিয়ে যেন মাপা না লাগে। আমরা যেন একে অপরকে শুধু অনুভবে, হৃদয়ের বন্ধনে চিনতে এবং বুঝতে পারি। যদিও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমাদের বন্ধুত্বটা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ফেসবুক, টুইটার বা মেসেঞ্জারে। ভার্চ্যুয়াল জগতে আমরা নানা ধরনের বন্ধু তৈরি করে থাকি কিন্তু তার স্থায়িত্ব হয় এক দিন, দুদিন বা কয়েক মাস। এমন বন্ধুত্বে থাকে না কোনো বিশ্বাস বা আস্থার জায়গা। তবে সবকিছুর ওপরে জীবনে সৎ বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে সফলতার পথ দেখাতে পারে ভালো বন্ধুরা।
বন্ধুত্ব হোক ভালোবাসার প্রতীক এবং প্রযুক্তির যুগেও বন্ধু যেন মানবতার বন্ধনে বন্ধু হয়ে থাকে এ আশা করি।