শিক্ষকের ভালোবাসা: এক নীরব বিপ্লব

ছোটবেলার মতো এখন কেউ আমাকে বলে না, কী করতে হবে। আমি নিজে যা ভালো মনে করি, তা–ই করি। কেউ আমাকে অনুপ্রেরণা দেবে, এটা আমার কাম্যও নয়; বরং আমি নিজেই অনুপ্রাণিত হই এবং ভালো কিছু দেখলে বা জানলে ভালো কিছু করতে চাই। আমি যদি নিজেকে ভালো না বাসি, তবে অন্য কেউ বলবে না কোনো দিন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। কারণ, এমন একটি কথা বলতে দরকার সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। এসব গুণ অর্জন করতে হয় নিজের মধ্যে। যার হৃদয়ে আছে ভালোবাসা, সে জানে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ভালোবাসার।

আমি দেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে বেশ লিখেছি। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। কখনো কঠোর, কখনো নরমভাবে সমালোচনাও করেছি। শিক্ষার অবনতির পেছনে বিভিন্ন কারণ জড়িত, যার মধ্যে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং তাঁদের দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগ, তাঁদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বাবা-মায়ের সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান সরকার তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে শিক্ষার মান উন্নত করা যায়।

পরিবর্তন আনতে সময়, ভালো পরিকল্পনা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। প্রতিটি ভালো কাজ কোনো না কোনোভাবে শুরু হয়। কখনো তা সঠিক সময়ে হয়, কখনো দেরিতে আবার কখনো কিছুটা আগে। যেকোনো কিছুর শুরু হলে তার শেষও হয় কোনো এক পর্যায়ে।

কিছু বছর আগের কথা। হঠাৎ আমার স্কুলজীবনের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের আর্থিক দুরবস্থা দূর করতে দূর পরবাস থেকে সমাজ, দেশ ও বিদেশে সাড়া দিয়েছিলাম। হয়তো এমনই ছিল নিয়তির খেলা। গোপাল স্যারের অসিলায় শিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, যা মিরাকল হয়ে আমাকেও বদলে দিয়েছে। গোপাল স্যার কাউকে বলেননি তাঁর কষ্টের কথা। আমাকেও কেউ কখনো জোর করেননি স্যারের জন্য কিছু করতে বা স্যারকে নিয়ে ভাবতে। বিবেক যখন তাড়া দিয়েছিল, তখন সাড়া দিয়েছিল অন্তর। আর অন্তর ছিল সুন্দর, তাই সবাই মিলে স্যারের জন্য কিছু করতে পেরেছিলাম। ৪০ বছর একটানা শিক্ষকতা করেছেন, জীবনে বিয়ে করেননি। এরপর অবসরে। ভাঙাচোরা একটা কুঁড়ে। কারও কাছে হাত পাতেননি। কখনো মাথা নত করেননি। কাউকে পরোয়া করে কথা বলেননি। প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীদের সহযোগিতায় স্যারকে একটি বাড়ি করে দেব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। স্যারকে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তা আমি জানি। আমাদের ছিল ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার কাছে স্যার নতি স্বীকার করেছিলেন।

আমরা মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন গঙ্গারামপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রীরা স্যারের জন্য যা করেছিলাম, তার সামাজিক, নৈতিক ও আদর্শিক মূল্য ছিল অপরিসীম। স্যারের জন্য হৃদয় দিয়ে কিছু করার মধ্যে নিহিত ছিল একটি চিন্তা, একটি বিশ্বাস, একটি মূল্যবোধ, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি দর্শন ও একটি সংস্কৃতি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু শিক্ষক অসহায় জীবন যাপন করছেন। আমাদের দৃষ্টান্তমূলক কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো অসহায় শিক্ষকের শিক্ষার্থীরা যদি তাঁদের প্রিয় শিক্ষকের পাশে দাঁড়ান, তাঁর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলেন, তাহলেই আমাদের চিন্তা পুষ্টি লাভ করবে, আমাদের বিশ্বাস সুদৃঢ় ভিত্তি পাবে, সমাজে মূল্যবোধ বিকশিত হবে, মানুষের মধ্যে উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের দর্শন বাস্তব রূপ লাভ করবে। এর ফলে আমাদের প্রয়াস একটি সংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করবে।

আমরা যখন স্যারের ঘরটি তৈরি করলাম, তখন সেই বাড়ির চাবি আরেকজন আদর্শ শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা সাধন কুমার ভট্টাচার্যের বিধবা স্ত্রী অর্চনা রানী ভট্টাচার্য গোপাল স্যারকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেটাও ছিল আরেকটি মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা। গোপাল স্যার এখন আর সেই বাড়িতে শুয়ে–বসে সময় কাটান না। তিনি কয়েক বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বর্তমানে বাড়িটিতে তাঁর প্রতিবন্ধী ছোট ভাই থাকেন। তিনি ভালো আছেন, এ খবর যখন পাই, তখন মনের মধ্যে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করে। তবে ওই সময় একজন শিক্ষকের প্রতি তাঁর ছাত্র–ছাত্রীদের ভালোবাসা হঠাৎ করে একদিনে গড়ে ওঠেনি। স্যার ৪০ বছর ধরে যে নিষ্ঠা ও সততা, কর্তব্য ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে এসেছেন, সেটি ছিল তাঁর প্রতি তাঁর শিক্ষার্থীদের ভালোবাসার ভিত্তি। বর্তমান যুগে এমন শিক্ষক কোথায় পাব?

প্রায় সাত বছর পর ফিরে এসেছে সেই জুলাই মাস। কয়েক দিন ধরেই স্যারের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ স্যারকে নিয়ে একটি পোস্ট আমার ফেসবুকে ভেসে উঠেছে। সেটা পড়তেই মনে পড়ে গেল সেই ১৯৮২-৮৩ সালের কথা। আমি পড়েছি গঙ্গারামপুর স্কুলে, গোপাল স্যারের কাছে। আবারও ভাবনায় এসে গেল বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের কথা। কেমন শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই, আর সে রকম শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কেমন শিক্ষক প্রয়োজন? গোপাল স্যার ও সাধন স্যারের মতো হৃদয়বান শিক্ষক এখন কোথায়? সে রকম শিক্ষক ছাড়া কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবায়ন কি সম্ভব?

হাজারও প্রশ্নের মধ্যে সেদিন বসে আছি হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট বিমানবন্দরে। ঠিক তেমন একটি সময় হঠাৎ দেখা হলো বাংলাদেশের একটি দলের সঙ্গে। এ দলের সদস্যরা সরকারি সফরে এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। ঘুরবেন কয়েকটি দেশ। সামান্য সময় কথা হলো। শুধু বলেছি, দেশের টাকায় ঘুরছেন, আশা করি ভালো যা কিছু দেখে গেলেন, একটু চেষ্টা করবেন দেশে গিয়ে তা কাজে লাগাতে। এতক্ষণ মুখগুলো হাসিতে ভরা ছিল। যখনই দেশের কথা বললাম, তখনই মুখগুলো চুপসে গেল। তাঁরা দ্রুতই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সরকারি কর্মকর্তারা কেন নিজেদেরকে গুটিয়ে নিলেন, তা আমি জানি না। সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য কী এবং এসব কর্মকর্তা সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন কি না, তা আমার জানা নেই।

তাঁরা যদি সে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই জনগণের ভালোবাসা অর্জন করবেন। সেই ভালোবাসা তাঁরা বুঝতে পারবেন অবসরজীবনে। গোপাল স্যার তাঁর ছাত্র–ছাত্রীদের খুঁজে বেড়াননি। ছাত্র–ছাত্রীরাই তাঁকে খুঁজে বের করেছিলেন। এটি ছিল তাঁর অর্জন। সরকারি কর্মকর্তারাও যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে তাঁরাও মানুষের ভালোবাসা পাবেন।

আর তাঁরা যদি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে গোপাল স্যারের মতো হাজারো গোপাল স্যার তৈরি হবেন। আর হাজারো গোপাল স্যার তৈরি হলে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে শিক্ষার্থীরা। আর জাতি পাবে আদর্শ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। সুতরাং আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা, আদর্শ শিক্ষক ও আদর্শ প্রশাসক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই আমরা বহু ফুলের সমন্বয়ে একটি ফুলের মালা গেঁথে ভালোবাসার সেতু তৈরি করতে পারি।