চীন-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সহযোগিতা: একটি মেডিকেল সিটির স্বপ্ন

বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ছুটে যান উন্নত চিকিৎসার খোঁজে। রাজধানীর ব্যস্ততম ট্রাভেল এজেন্সিগুলো জানায়, তাদের এক-তৃতীয়াংশ ক্লায়েন্টের ভিসা-ভ্রমণের উদ্দেশ্যই ‘মেডিকেল’। হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা, কিডনির জটিলতা, ক্যানসার, হাড়ের ব্যথা কিংবা বিরল স্নায়ু রোগ—এসব রোগের নাম বললেই মনে পড়ে কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি বা ব্যাংককের কথা। অথচ এসব রোগের চিকিৎসা যদি দেশে হয়, আন্তর্জাতিক মানে, সাশ্রয়ী ব্যয়ে—তাহলে আর কে বাইরে যেতে চান?

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতের চিকিৎসা ভিসা কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশি রোগীরা তাই এখন দিশাহারা। এই সুযোগে চীন যে কৌশলগতভাবে এগিয়ে এসেছে, সেটি নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কূটনীতিতে। কুনমিং শহরে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল খোলার প্রস্তাব, সমান ব্যয়ে চিকিৎসা–সুবিধা, এমনকি বিমানের ভাড়ায় ছাড়—সব মিলিয়ে চীনের এই কৌশল শুধু মানবিক নয়, অনেক বেশি দূরদর্শী।

চীন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের নানান উপায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরেই—রেললাইন, সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিকম নেটওয়ার্ক। এখন সেই তালিকায় যোগ হচ্ছে ‘স্বাস্থ্য খাত’। অথচ এই খাত এত দিন ধরে বড়সড় কোনো বিদেশি বিনিয়োগ থেকে অনেকটাই উপেক্ষিত থেকেছে। তাই বাংলাদেশ সরকার যদি কৌশলগতভাবে আগায়, তাহলে এই উদ্যোগ হতে পারে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় সম্পৃক্ততা অবশ্য একেবারে নতুন কিছু নয়। দেশের ওষুধশিল্প চীনা কাঁচামালের ওপর বহু বছর ধরেই নির্ভরশীল। মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, সার্জিক্যাল টুলস, ভেন্টিলেটর, ডায়াগনস্টিক প্রযুক্তি—এসবের বড় অংশই আসে চীন থেকে। হাজারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনের সরকারি বৃত্তি বা সাশ্রয়ী খরচে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে। কোভিড-১৯ মহামারির সময়ও চীন যেভাবে বাংলাদেশকে টিকা ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম দিয়েছে, তা এক গভীর স্বাস্থ্য-সৌহার্দ্যের নিদর্শন।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, চীন ঢাকায় একটি বড় হাসপাতাল নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যার সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’। এ প্রকল্পের জন্য রাজধানী, চট্টগ্রাম ও উত্তরবঙ্গে জমি চিহ্নিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে চীন উত্তরবঙ্গে ১ হাজার শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করতে চায় উপহার হিসেবে। রোবোটিক ফিজিওথেরাপি যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যেই এসেছে বাংলাদেশে। সব মিলিয়ে চীনের আগ্রহ যে কেবল নিছক প্রকল্প নয়, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ আমরা কোথায় নিয়ে যাব? একটি বা দুটি হাসপাতাল নির্মাণ নিশ্চয়ই ইতিবাচক, কিন্তু আমরা কি এখানেই থেমে যাব? নাকি এটিকে দেশের স্বাস্থ্য খাত পুনর্গঠনের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করব?

সময় এসেছে এখনই একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা নেওয়ার। আমাদের দরকার এমন একটি স্বপ্ন, যা শুধু হাসপাতাল নয়—একটি স্বতন্ত্র, বহুমাত্রিক, ভবিষ্যৎমুখী মেডিকেল সিটি। এমন এক শহর, যার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হবে চিকিৎসা, গবেষণা, মানবিকতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বিত স্পন্দন।

একটি ‘মেডিকেল সিটি’ হতে পারে এই যুগান্তরের প্রতীক। এতে থাকবে ১ হাজার শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, ক্যানসার, কিডনি, নিউরোলজি ও হৃদ্‌রোগের জন্য পৃথক বিশেষায়িত ইউনিট, পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র, আধুনিক ডায়াগনস্টিক ও রিহ্যাবিলিটেশন সুবিধা, আন্তর্জাতিক হোটেল ও গেস্ট হাউজ, শপিং মল, খাবার দোকান, মসজিদ-মন্দির-গির্জা এবং সবুজ খোলা জায়গা।

এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর হেলথ সিটি একটি রোল মডেল হিসেবে আমরা দেখতে পারি। সিঙ্গাপুর তাদের চিকিৎসাব্যবস্থাকে কেবল স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে দেখেনি—তারা এটিকে পর্যটন, গবেষণা, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। নভেনায় অবস্থিত হেলথ সিটি নভেনা হলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এখানে রয়েছে ট্যান টক সেন হসপিটাল, ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস, ন্যাশনাল স্কিন সেন্টার, লি কং চিয়ান স্কুল অব মেডিসিন, আধুনিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, গবেষণা ল্যাব, রোগীদের জন্য বিশেষ হোস্টেল ও হোটেল, খোলা পার্ক এলাকা, এমনকি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য শপিং জোন ও কফিশপও। প্রায় ১০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক ও গবেষক এখানে কাজ করেন এবং এটি একটি ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার এনভায়রনমেন্ট, যেখানে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গবেষণা ও জীবনযাপন একত্রে মিলে যায়।

ঢাকার ভেতরে নয়—এই মেডিকেল সিটি গড়ে উঠতে পারে শহরের উপকণ্ঠে। হতে পারে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ধারে, কিংবা পূর্বাচল, কালিয়াকৈর, কেরানীগঞ্জ অথবা ঢাকার উত্তরের কোনো বিস্তৃত অঞ্চল। মূলত প্রয়োজন দুই থেকে তিন বর্গকিলোমিটার জায়গা, যা বৃহৎ পরিকল্পনার জন্য যথেষ্ট। জলসিঁড়ি প্রকল্প বা পূর্বাচলের জমি অধিগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়, এটি অসম্ভব কিছু নয়।

এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে—কত খরচ হবে? একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল সিটির নির্মাণ ব্যয় হতে পারে ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এটিকে খরচ না ভেবে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। চীনের সরকারি সহায়তা, সফট লোন এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ—এই তিনের সমন্বয়ে অর্থায়ন সম্ভব। যখন প্রতিবছর ১ দশমিক ৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যায়, তখন এই অর্থ দেশেই ধরে রাখা যেতে পারে।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব হবে বহুমাত্রিক। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে, বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই রয়ে যাবে। একটি নতুন খাত হিসেবে স্বাস্থ্য পর্যটনের বিকাশ ঘটবে, যার ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকেও রোগীরা বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হবেন। এর ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে হাজার হাজার মানুষের জন্য—ডাক্তার, নার্স, প্রযুক্তিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে হোটেল, খাবার, যাতায়াত, নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা—সব খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার চিকিৎসা মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে আসবে।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ আছে। উন্নত চিকিৎসক তৈরি, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, সেবার সাশ্রয়যোগ্যতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো গড়া এবং প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহার—এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে এগোতে হবে। চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও উচ্চমান রক্ষা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র অথরিটি বা মেডিকেল সিটি অথরিটি, যারা স্বায়ত্তশাসিতভাবে এই প্রকল্প পরিচালনা করবে।

এই সিটি শুধু হাসপাতাল আর ভবনের সমষ্টি নয়। এটি এমন একটি জায়গা হবে, যেখানে মানুষ শুধু চিকিৎসা নিতে আসবে না—এখানে জন্ম নেবে নতুন গবেষণা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি হবে বাংলাদেশের ‘মেডিকেল ইনোভেশন হাব’, যা শুধু দেশকে নয়, পুরো অঞ্চলকে উপকৃত করবে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি হতে পারে একটি মডেল—কীভাবে কৌশলগত অংশীদারত্ব এবং দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব আনা যায়।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে বিকল্প নেই। ভারতের ভিসানীতির পরিবর্তন যেমন সংকট তৈরি করেছে, তেমনি আমাদের জন্য এটিকে এক সম্ভাবনায় রূপান্তর করার সুযোগও এনে দিয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশৃঙ্খল বাস্তবায়ন কাঠামো এবং জনগণের অংশগ্রহণ। চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়ার দিন যেন একসময় ইতিহাস হয়ে যায়—এমন একটি বাংলাদেশ গড়ার সময় এখনই।

আমরা যদি শুধু একটি হাসপাতাল নিয়ে ভাবি, তাহলে আমরা একটি সুযোগকে সীমিত করে ফেলি। কিন্তু যদি আমরা একটি ভবিষ্যতের নগরী কল্পনা করি—যেখানে চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি ও মানবিকতার মিলন ঘটবে, তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটি নীরব বিপ্লব। এখানে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু উন্নয়নের কথা বলছি না, বলছি এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]