অস্ট্রেলিয়ার গল্প: ৫—বঙ্গজ অস্ট্রেলিয়ানদের দ্বিতীয় প্রজন্ম
কোনো বঙ্গজ অস্ট্রেলিয়ানকে সওয়াল করেন, ‘সবকিছু ছেড়েছুড়ে কেন এই পরবাসে এলেন?’
অধিকাংশই উত্তর দেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে! দেশে নিরাপত্তা নেই, পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা নেই।’
সন্তানাদির ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতেই ওনারা এই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গেড়েছেন।
বরিশালে আমার স্কুলজীবনে এক বন্ধু ছিল, নাম রফিক। ওর রসবোধ ছিল ব্যাপক। জীবনটাই ওর এক রসিকতা। রফিকের একবার মনে ধরল আমেরিকা যাবে! মেধাবী ছিল কিন্তু পড়ালেখায় তেমন মন ছিল না আমার বন্ধুর। কী আছে জীবনে। তাই টোয়েফল পরীক্ষা দিয়েটিয়ে একাকার। অ্যাপ্লিকেশন করে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি থেকে আমন্ত্রণ মানে i20 জোগাড় করল। যথারীতি ঢাকায় আমেরিকার দূতাবাসে ইন্টারভিউ হবে। ইন্টারভিউ মানে পুলসিরাতের রাস্তা। ওপারেই আমেরিকা।
স্যুট–কোট পরে রফিক সাহেব চললেন ঢাকা শহরের দিকে। মনোবল বৃদ্ধির নিয়তে আমিও চললুম সাথে। পথে পথে রাস্তাঘাটে ইংরেজিতে কথা কই, রফিকের প্র্যাকটিসের জন্য।
তো ইন্টারভিউতে ভিসা আফিসার সুধালেন, ‘Why do you want to go to America?’
এ আবার কেমন ধারা প্রশ্ন! আমেরিকা যাওয়ার কারণ লেখাপড়া। ভিসা অ্যাপ্লিকেশনে সহজ ইংরেজিতে সে তো লেখাই রয়েছে! তা–ও আবার জিজ্ঞেস করে।
তাই সরল রসিকতায় রফিক বলল, ‘Country has no future, Sir’
একটু বিষম খেলো ভিসা আফিসার, ‘What! How about study? I see you enrolled to the uni?’
রসিক রফিকের রসিকতা থামে না, ‘All are excuses Sir. Main reason is food and future. Country has no food, no future.’
রফিকের এই উচ্চমার্গের রসিকতা ভিসা অফিসার ধরতে পারল না। আমরাই ধরতে পারিনি, ভিসা অফিসার তো কোনো স্যার। বলা বাহুল্য, রফিকের ভিসা হয়নি সেই চেষ্টায়।
রফিকের রসিকতা নেহাত রসিকতা ছিল না। অনেকেই ভবিষ্যতের, বিশেষ করে পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এই কঠিন হিজরত করেন।
ছাত্রাবস্থায় হিজরতের কথা আলাদা। কচি বয়স, তাই হারানোর কিছু নেই। শুধু বাবা–মা, ভাই–বোন, স্বামী বা স্ত্রী বা প্রেমিক–প্রেমিকার বিরহ–বেদনা—এই সব সমস্যা। পাউরুটি টোস্ট করে খেয়ে ঈদের দিন ডিউটিতে যাওয়ায় মায়ের কান্না। মা হয়তো ফোনে বলেন, ‘চলে আয় বাবা। আমি তোকে ছাড়া আর কিছু চাইনে!’ দীর্ঘদিনের অদেখায় প্রেমিক বা প্রেমিকার অন্যত্র বিবাহ হয়ে যায়—এই সব দুঃখ–বেদনা।
সময়ে সেই ক্ষত সেরে যায়। ফিরে আর যাওয়া হয় না।
এত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে আবার জীবনসংগ্রামও চলমান। পেটের দায় বড় দায়।
নতুন পরিবেশ, নতুন কালচার, কত কত নতুন দেশের মানুষ। সবকিছুর ওপরে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা, ইউনিভার্সিটির খরচাপাতি। যেখানে যে কাজ পাওয়া যায় করে যাও। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস সেরে দৌড় লাগাও কাজে। পিৎজা ডেলিভারি, ক্লিনার, বার টেন্ডার, ওয়েটার, সেলস ম্যান—যে কাজ পাওয়া যায়, তাই সই। কোনো বাছবিচার নেই। সারা দিন ইউনি আর সারা রাত কাজ। তথাস্তু। দিনে তিন ঘণ্টা ঘুম, কুছ পরোয়া নেহি। সারা উইকএন্ড ঘুমিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যাবে। আর কোনোরকমে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পেয়ে গেলে তো সোনায় সোহাগা। চালাও ট্যাক্সি নয়তো উবার। ডবল ইনকাম।
ছাত্রজীবন শেষ হয়। শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। চাকরির জন্য যুদ্ধ। জীবনের জন্য যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জিতে মর্টগেজ নিয়ে একটা বাড়ি করেন। সংসার শুরু করেন। সন্তানসন্ততি হয়।
শুরু হয় আরেক যুদ্ধ!
অনেকে আবার দেশে ঘর–সংসার, বাড়ি–গাড়ি, চাকরি–বাকরি গুছিয়ে তারপর নতুন জীবনের উদ্দেশে হিজরত করেন। শুধু সন্তানসন্ততির ভবিষ্যতের কথা ভেবে। দেশে উচ্চ পদের চাকরি, ভালো মাইনে, টয়োটা করোলা গাড়ি, কষ্টে জমানো টাকায় কেনা ফ্ল্যাট। সবকিছু বেচে দিয়ে চলে আসেন পরবাসে। শুরু হয় নতুন সংগ্রাম।
অনেকেই প্রথমে ভালো চাকরি পান না।
দেশে গণ্যমান্য ডিরেক্টরের পদ ছেড়ে হয়তো এখানে এসে উবার চালান, নয়তো মুদির দোকানে কাজ নেন।
সে সংগ্রামের কালে কত কিছু নতুন করে শিখতে হয়! নতুন দেশ, নতুন ভাষা। খটোমটো অসি ইংরেজি আর বিদঘুটে উচ্চারণে গু‘ডে মাইট (Good Day Mate)। গাড়ি চালনা শেখা, এ মুল্লুকে তো সস্তায় ড্রাইভার পাওয়া যাবে না।
ডিরেক্টর সাহেব সে সময়টাতে নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করেন। ভাবেন, কোন শনির দোষে এই পরবাসের মরীচিকার পিছে ছুটে ছিলেন! অবসরে আবার দেশে ফিরে যাওয়ার ছক কাটেন। এই করে দাঁতে দাঁত চেপে দিন কাটে। তারপর হয়তো ধীরে ধীরে কাঙ্ক্ষিত চাকরি–বাকরি পেয়ে যান। নয়তো উবার চালিয়েই বাকি জীবন পার করে দেন। বাড়ি কেনেন। গিন্নিও হয়তো ভালো চাকরি করেন। সংসারে আবার সচ্ছলতা আসে।
এই ডিরেক্টর সাহেবেরও দেশে ফিরে যাওয়া হয় না। কোনো না কোনো পিছুটান থাকেই।
এরই মধ্যে সন্তানেরা হয়তো স্কুলে চ্যাম্পিয়ন। ছেলে স্কুলের সেরা ছাত্র। কন্যার হয়তো ATAR স্কোর ৯৯। সামনের বছর মেডিকেলে ভর্তি হবে। ডিরেক্টর সাহেব গর্বিত হন। মনে হয় ওনার সব ত্যাগ সার্থক হয়েছে। ছেলে–মেয়ে দুটো মানুষের মতো মানুষ হচ্ছে। স্কুল–কলেজে দুনিয়ার সেরা সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে। এদের জন্যই তো সব সুখ বিসর্জন দিয়ে এই পরবাসে পড়ে থাকা।
দেশের বাইরে থাকলে শুনেছি দেশের জন্য ভালোবাসা বেড়ে যায়। বাঙালি আরও বেশি বাঙালি হয়ে যায়। ঘটনা মনে হয় আসলেই তা–ই। বঙ্গের জন্য মন টানে। প্রেমিকার বাড়ির কাকটাকে মনে হয় ময়ূর। বঙ্গের ধুলা–ময়লাকে লাগে সোনার কনার সমান। মোটের ওপর সবাই দেশকে নিঃসন্দেহে মিস করে।
প্রথম প্রজন্মের বঙ্গজ অস্ট্রেলিয়ানদের কাহিনি মোটামুটি একই রকমের।
সবার গল্পই মিলে যায়। কারও একটু কম, কারও বেশি।
বঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নিরাশা নেই আমার।
বঙ্গের অসীম সম্ভাবনা চিন্তায় আমি পুলকিত হই। তাহলে আমি দেশ কেন ছাড়লুম? আমার পায়ের নিচে শর্ষে ছিল যে। গ্রামীণফোনের আরামের চাকরি ছেড়ে যখন তল্পিতল্পা গুছিয়ে পারস্যের পথে চললুম, তখনই জানতুম এ অগস্ত্য যাত্রা। পারস্য থেকে এই দেশ ওই দেশ সেই দেশ করে গোটা কুড়ি দেশ ঘুরেফিরে যখন অস্ট্রেলিয়ার তীরে পৌঁছালাম, তত দিনে বঙ্গ আমাদের জন্য ইতিহাস হয়ে গেছে।
দেশের স্মৃতি অনেক ফিকে হয়ে গেছে। তরতাজা ছিল দুবাই আর ওমানের স্মৃতি। সারা জীবন বড় বড় শহরে থেকে অভ্যাস আমার সহধর্মিণী বললেন, ‘এ কোন গণ্ড গ্রামে এনে ফেললে আমায়? এ তো মথুরার জঙ্গলে বনবাস।’ বললুম, ‘এই গণ্ড গ্রাম মথুরার জঙ্গলই আমাদের ভবিষ্যৎ।’
এত বছর পর এই শহরে থেকে বেগমকে যদি অন্য কোনো শহরে হিজরত করার কথা বলি, আমি নিশ্চিত, উনি রাজি হবেন না। এই সাধের গোল্ড কোস্টের আশার দ্বীপ ছেড়ে আর কোথায় যাবেন?
এই হলো আমাদের গল্প। এবার আসল গল্পে ফিরে আসি।
প্রথম প্রজন্মের কাহিনি তো বললুম। আসল গল্প তো দ্বিতীয় প্রজন্মকে নিয়ে। যাদের জন্য এত কিছু ত্যাগ করে এখানে আসা, সেই দ্বিতীয় প্রজন্ম কেমন আছে?
এরা তো বঙ্গ মিস করে না।
ছোটবেলায় আমগাছ আর লিচুগাছে উঠে আম–জাম পেড়ে খাওয়ার মজা এরা কি পাবে?
বাবা–মায়ের হাত ধরে নববর্ষের সকালে রমনার বটমূলে যাওয়ার অনুভুতি এদের কাছে অচেনা।
সূর্যোদয়ের পূর্বে নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া এরা দেখেনি কখনো।
পাঁচ টাকা হাতে নিয়ে বৈশাখী মেলায় নাগরদোলায় চড়ে বাঁশি কিনে বাজাতে বাজাতে ঘরে ফেরা হয়নি এদের।
তারপর আরও আছে! গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়া। শুক্কুরবারে আত্মীয়স্বজনের বাসায় দাওয়াত খেয়ে জম্পেশ আড্ডা। ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ঠেলে নিউমার্কেট আর গাউছিয়ায় ঈদের কাপড় (এখন অবশ্য মার্কেট অনেক হয়েছে) কিনতে যাওয়া। কংক্রিটের জঙ্গল থেকে হাঁপ ছাড়তে জান হাতে নিয়ে সেই সুদূর কক্সবাজার সমুদ্র দেখতে যাওয়া। আরও কত কী?
এই প্রজন্ম কি সেই অনুভূতিগুলো কখনো বুঝতে পারবে? এরা বঙ্গজ অসি হবে কিন্তু বাঙালি কি হবে কোনো দিন?
এই পরবাসেও বৈশাখী মেলা হয়, নববর্ষের প্রোগ্রাম হয়, বৈশাখী মেলা হয়। কিন্তু সে যে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।
কিন্তু সেই ঘোলের স্বাদের মায়ায় পড়ে গেলুম একদিন। সে কাহিনি বলি।
বাড়ির কাছে প্যারাডাইস পয়েন্ট পার্ক। সাতসকালে হাঁটতে যাই। নানা কিসিমের মানুষ। সাত সক্কালে কেউ হাঁটছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ করছে ভারত থেকে আমদানিকৃত যোগব্যায়াম। মাঝে মাঝে দেখি এক শেতাঙ্গ ‘হরে কৃষ্ণ’ গ্রুপ। এরা গেরুয়া বসন পরে ঢাকঢোল, কাঁসা বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ হরে রাম গান করতে করতে হাঁটে। মাঝেমাঝেই আসে এই পার্কে। একদিন বসে গল্প করলুম এদের সাথে। এরা হিন্দু নয়, আসলে কোনো ধর্মেই বিশ্বাস নেই। কিন্তু এক ভারতীয় বন্ধুর বাড়িতে হরে কৃষ্ণ নাচগান দেখে ভালো লেগে গেছে। তাই ভারত থেকে গেরুয়া আর বাদ্যযন্ত্র আনিয়ে দল বেঁধে পার্কে পার্কে গান গায়। এতে নাকি এদের মনে প্রশান্তি হয়। এদের এই বিচিত্র আনন্দ দেখে দেখে আরও অনেকেই এই গ্রুপে ঢুকেছে। সব মিলে হাজারখানেক শ্বেতাঙ্গ এই গ্রুপের সদস্য। এই করে করে হয়তো একদিন ‘হরে কৃষ্ণ’ ঢুকে যাবে অস্ট্রেলিয়ান কালচারে। মূলধারায়।
অস্ট্রেলিয়ান কালচার আমাদের বঙ্গের মতো এত প্রাচীন আর সমৃদ্ধ নয়। এক নবীন দেশ। এত দিন এরা ইংরেজদের আন্ধা অনুসরণ করে এসেছে। এখন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে সেই ইংরেজ চরিত্র। মাল্টি কালচার হচ্ছে। এই রূপান্তরের সময়ে এ রকম আরও কত কিছু ঢুকে যাবে অস্ট্রেলিয়ান কালচারে।
ভাবলুম আমাদের বঙ্গজ কালচার এত সমৃদ্ধ! আমাদেরও তো অনেক কিছু দেওয়ার আছে অস্ট্রেলিয়াকে। আমরা কেন দিচ্ছি না? হরে কৃষ্ণের মতো লালন শাহের লালন গীতি কেন ঢুকতে পারে না অস্ট্রেলিয়ান কালচারে? ইংরেজি নববর্ষের ভোরে মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো ঢাকঢোল বাজিয়ে নাচগান হতে পারে না?
আমরা কেন অসীম সুন্দর বঙ্গ সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিই না এই অসি ভূমিতে?
আসলে প্রথম প্রজন্ম অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরবাসে থাকে। এদের ইংরেজি উচ্চারণ সহিহ হয় না। মূলধারার অস্ট্রেলিয়ানদের মতো এরা রাগবী বা অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল খেলার খবর নিয়ে পাগল হয় না। জীবনযাপনও মূলধারা থেকে অনেক আলাদা। তাই প্রথম প্রজন্মের জন্য মূলধারায় পুরোপুরি মিশে যাওয়া একটু দুষ্কর বটে।
আমরা মিশে না গেলে আমাদের সংস্কৃতি ছড়াই কী করে?
সে জন্যই বঙ্গ কালচারের অসাধারণ সৌন্দর্য বাকি অস্ট্রেলিয়ানরা জানতে পারে না। জানলে হয়তো এরাও বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাচতে নাচতে ‘একদিন বাঙালি ছিলাম’ গান গাইত। হয়তো নিজের ঘরে কোরমা–পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, লাউ শাক আর মুড়িঘন্ট রান্না করত। হয়তো ঘরে ঘরে লালনগীতি শুনত। আজ না হোক পঞ্চাশ বছর পরেও হতে পারে!
বঙ্গজ অসিরা অস্ট্রেলিয়ার উন্নতিতে অনেক অবদান রাখে। বঙ্গ জাতি মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি ট্যাক্স দেয়। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কৃষি, গবেষণা সবকিছুতেই কিছু না কিছু অবদান আছে। আর ভবিষ্যতে দ্বিতীয় প্রজন্ম আরও আরও অবদান রাখবে নিশ্চিত! অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতিতে অবদান রাখা কেন বাদ যাবে?
প্রথম প্রজন্মের জন্য এ একটু কঠিন হলেও মূলধারায় মিশে বঙ্গ সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের জন্য অনেক সহজ। এরা ছোটবেলা থেকে এখানেই বড় হচ্ছে। এদের সব স্মৃতি এই দেশকে ঘিরে। এরা একদিন এই দেশের নেতৃত্ব দেবে। এরাই ঋষি সুনাকের মতো প্রধানমন্ত্রী হবে। বড় বড় কোম্পানির সিইও হবে এরা। দেশের নীতিনির্ধারণী সব সংস্থার উঁচু পদে থাকবে। যুগান্তকারী কিছু একটা আবিষ্কার করবে এরাই।
বঙ্গজ মস্তিষ্কের স্বভাবতই আইকিউ বেশি। সুযোগ পেলে মেধার জোরে বাকি দুনিয়া থেকে দুই ধাপ এগিয়ে থাকে বঙ্গজাত। তাই একদিন এরাই হবে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারা।
কিন্তু আমাদের তো সেই সংস্কৃতি দ্বিতীয় প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।
এদের আমরা রবি ঠাকুর শোনাই না। বেহুলা লখিন্দরের কাহিনি এরা জানেই না। এ জন্মে কোনো দিন লোকগীতি, জারিসারি শুনেছে কি না, সন্দেহ। ধর্মের শিক্ষাই বা কতটুকু দিই।
এরা শর্ষে দিয়ে ইলিশ খেতে দিলে বলে, নো, থ্যাংকস! তেহারি–বিরিয়ানি পোলাও বাদ দিয়ে বার্গার–স্যান্ডউইচ চায়।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo. com
দ্বিতীয় প্রজন্মকে তাই বঙ্গ সংস্কৃতি শেখাতে হবে। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের পরতে পরতে যে রস লুকিয়ে আছে, সে ওদের দেখাতে হবে।
পরবাসী বঙ্গজ প্রত্যেকের মধ্যে আগুন আছে! প্রত্যেক পরবাসীর জীবন একেকটা মহাযুদ্ধের মহাকাব্য!
এক কঠিন জীবন। এতে পদে পদে সংগ্রাম ছিল। সেই সুদূর বাঙাল মুলুক থেকে এখানে এসে থিতু হওয়ার পথে অনেক চড়াই–উতরাই পার হতে হয়েছে। অনেক প্রতিকূলতা। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। বরং উচ্চ কণ্ঠে গেয়েছেন, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’। এত বাধাবিঘ্ন, বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন নিজের ভেতরে আগুনের জোরে।
আগুন হলো সেই শক্তি!
কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে সেই আগুনটা দেখি না। এরা তো যুদ্ধ সংগ্রাম দেখেনি। প্রতিকূলতা দেখেনি। এদের তেমন কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। এদের কাছে জীবন মানে ঘটনাবিহীন সাদামাটা দিন–রাত, স্কুল, হোমওয়ার্ক, এক্সাম, আইপ্যাড আর ইউটিউব, টিকটক। কিছু উত্তেজনা ভিডিও গেমে। বাকি সব একঘেয়ে।
তাই সুযোগ পেলেই প্রত্যেক পরবাসীকে বলি, আপনার মহাযুদ্ধের কাহিনি আপনার সন্তানকে বলুন। সেই মহাযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করুন। আপনার সন্তানকেও গর্বিত হতে শেখান। আরও বলুন বাকি দুনিয়ার কথা। যেখানে দুবেলা দুই মুঠো ভাত জোগাড় করতে শিশুদের কী সংগ্রাম করতে হয়। স্কুলে যাওয়া হয় না কত শিশুর। বলুন, তারা কত ভাগ্যবান।
বারবার বলুন।
ওদের ভেতরের আগুনটা আছে, আপনার সন্তান তো! সেই আগুনটা উসকে দিন।
তাহলে অজিল্যান্ডে বেঁচে থাকবে বঙ্গ সংস্কৃতি! আরও হাজার বছর! সমাপ্ত