আইসল্যান্ড: ল্যান্ড অব ফায়ার অ্যান্ড আইস

সপরিবার লেখক
ছবি: লেখক

ব্লু লেগুনের উষ্ণ পানিতে নামার আগের হাঁটাপথ পাড়ি দেওয়ার সময় যখন ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে ঝাপটা দিচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল এখান থেকে তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়া ভালো। এ ঠান্ডা উপেক্ষা করে হেঁটে গেলেই নরম–গরম পানিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া যায়। সকালে লন্ডন থেকে তিন ঘণ্টার ফ্লাইটে আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকাভিক বিমানবন্দরে নামার পরই টার্মিনালে বড় করে লেখা ‘Warm welcome is not in our nature’ বিলবোর্ডের মর্মার্থ এবার বুঝা গেল। জুনের শেষে ইউরোপে সামার শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আইসল্যান্ডের শীত যাওয়ার যেন কোনো তাড়া নেই।

সকাল নয়টায় রিকাভিক বিমানবন্দরে পৌঁছার পর এন্টারপ্রাইজে আমাদের ভাড়া করা গাড়ি নিতে গেলাম। দুই মেয়েসহ আমরা চারজন ও আরেক বন্ধুর পরিবার, সব মিলিয়ে ছয়জন।

লিডসের জিয়া ভাই, কারিশমা আপু ও আসাজরা গত বছর আইসল্যান্ড ঘুরে গিয়েছেন। তাঁদের অনেক পরামর্শের মধ্যে একটা ছিল ফোর হুইল ড্রাইভ কার রেন্ট করা। আইসল্যান্ডের অনেক স্পটে খুব কাছের কার পার্কে শুধু ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। তাতে হাঁটা কম এবং সময়ও অনেক বাঁচে। না হলে দূরের কার পার্কে গাড়ি রেখে ঠান্ডার মধ্যে অনেক পথ হাঁটতে হয়। আমাদের ছয়জনের জন্য ল্যান্ড রোভারের সেভেন সিটার ফোর হুইল ড্রাইভ বুক করেছেন আরিফ ভাই। ইংল্যান্ডে একই গাড়ি চালানোয় নতুন গাড়িতে অভ্যস্ত হওয়ার ঝামেলা নেই।

এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি ভুল করে ল্যান্ড রোভারের ফাইভ সিটার আমাদের জন্য রেখেছে। অনেকবার স্যরি বলে আমাদের ভলভোর সেভেন সিটার নিতে বলছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের ফেবারিট কার। তাদের ভুলের জন্য বারবার ক্ষমা চেয়ে আমাদের গাড়িতে ইন্টারনেট, শিশুর বোস্টার সিটের জন্য আর বাড়তি চার্জ করেনি।

ব্লু লেগুন স্পা
ছবি: লেখক

সাড়ে তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড। প্রতিবছর প্রায় ১৭ লাখ ট্যুরিস্ট আর্কটিক সার্কেলের এই দ্বীপদেশ ভিজিট করে। বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে ভালো সময় জুন থেকে আগস্ট, কম ঠান্ডার সঙ্গে সূর্যাস্তের সময় রাত সাড়ে ১১টায়। সারা দিন দিনের আলো থাকে। আগস্টের পর থেকে দিন ছোট হতে থাকে। ডিসেম্বরে মাত্র তিন ঘণ্টা দিনের আলো থাকে।

রিকাভিক এয়ারপোর্টের কাছেই এই ব্লু লেগুন। আগ্নেয়গিরির লাভা ও রক সল্ট মিলিয়ে ওপেন এয়ার এক বিরাট স্পা। এর পানিতে গা ভিজিয়ে না গেলে আইসল্যান্ড ট্রিপ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এয়ার বিএনবির কটেজে আমাদের চেকইন বেলা দুইটায়। তাই বিমানবন্দর থেকে গাড়ি নিয়েই ব্লু লেগুনে চলে এসেছি আমরা।

এখানে গাড়ি রাস্তার ডানে চলে। আরিফ ভাই পিএইচডি করেছেন ডেনমার্কে, তাই তিনি রাস্তার দুই দিকে গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। আমি তাই পাশের সিটে বসে রাস্তার দুই পাশের ল্যান্ডস্কেপ দেখছি। হতাশ হতে হলো, কারণ রাস্তার দুই পাশে লাভার কালো ছাই, তার ওপর সবুজ মস। বেশিক্ষণ অবশ্য তা দেখতে হলো না। মিনিট তিরিশের ড্রাইভেই আমরা ব্লু লেগুন পৌঁছে গেলাম।

ব্লু লেগুনের পানি বিভিন্ন মিনারেলের কারণে ভারী। খুব সহজে ভেসে থাকা যায়। পানিতে নামার আগে শাওয়ার নিতে হয়। সবাই কেরিস্ট ওয়াচ দিয়ে দেয়, যা দিয়ে পানি থেকে রেস্টুরেন্টের উইনডোতে গিয়ে ড্রিংক নেওয়া যায়। শেষে বের হওয়ার সময় পে করতে হয়। নীল উষ্ণ পানিতে আরাম করে অনেকক্ষণ থাকা যায়।

ইসরা খুব এনজয় করছে, আমাকে নিয়ে পুরো স্পা ঘুরে এসেছে। পানিতে থাকার সময় একটুও ঠান্ডা লাগে না। অনেক ট্যুরিস্ট থাকলেও পানি থেকে ওঠা মিস্টের কারণে একটু দূরের কিছুও দেখা যায় না আর লেগুনটা ছোট ছোট বাঁক দিয়ে এমনভাবে তৈরি করা যে খুব ক্রাউডেড মনে হয় না।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পানিতে কাটিয়ে আমরা পাশের লাভা রেস্টুরেন্টে আমাদের দুপুরের খাবার সারলাম। লেগুনের মাঝখানে এ রেস্টুরেন্ট, কাচের দেয়াল থেকে নীল পানির স্পার ধোঁয়া ধোঁয়া ভিউ দেখা যায়। খাবার শেষে সেলফসে আমাদের কটেজে ফিরলাম। ফার্মের মাঝখানে চারটি কটেজের একটিতে আমাদের ডেরা আগামী চার দিনের জন্য।

২.

আমাদের কটেজের লিভিংরুম যেন এক বিশাল লাইব্রেরি। আইসল্যান্ডবাসীর বই প্রীতির কথা আগে শুনেছিলাম। এবার আমাদের কটেজে তাঁর চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। পুরো লিভিংরুমে বই আর বই। এই না হলে কি আইসল্যান্ডের ১০ শতাংশ মানুষের জীবনকালে নিজের লেখা একটি প্রকাশিত বই রয়েছে! হ্যাঁ, তারা খুব ক্রিয়েটিভ জাতি।

দেশ হিসেবে আইসল্যান্ড খুব বড় নয়, বাংলাদেশের এক–তৃতীয়াংশ। প্রায় এক হাজার বছর আগে নরওয়ে থেকে ভাইকিংরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। আইসল্যান্ড পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশ। পৃথিবীর প্রথম সংসদ ছিল এই দেশে। ডেনমার্কের রাজাকে প্রধান মানলেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ চালাত এবং পরবর্তী সময়ে ডেনমার্কের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। নরওয়ের প্রাচীন ভাষা থেকে আইসল্যান্ডিক ভাষার উৎপত্তি, তবে ফ্রেঞ্চদের মতো ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। ভাষার ব্যাপারে ফ্রেঞ্চরা খুবই রক্ষণশীল এবং গ্লোবাল ভাষা হিসেবে ইংরেজির আধিপত্য এখনো মেনে নিতে পারে না। কিন্তু আইসল্যান্ডবাসী খুব সহজে ইংরেজিতে কথা বলে।

আজ আমাদের গোল্ডেন সার্কেল ট্যুরের দিন। রিকাভিকে শুরু হয়ে আবার রিকাভিকে শেষ হওয়া ৩৫৫ কিলোমিটারের রিং রোডের দুই পাশে অনেক জলপ্রপাত, গেইজার, ক্রেড (পুরোনা আগ্নেয়গিরি লাভা নিঃসরণ শেষে সৃস্ট লেক বা কূপ) প্রাকৃতিক হট স্প্রিং। গাড়ি ভাড়া করে নিজে ম্যাপ ধরে ধরে পছন্দের স্থান দেখা যায় অথবা রিকাভিক থেকে বাসে ডে ট্রিপ করা যায়। বাসে ট্যুর গাইড সারা দিনে চার–পাঁচটি আকর্ষণীয় স্থান দেখাবে। তবে ইউরোপীয় বা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে গাড়ি ভাড়া করে এ ট্রিপ করা ভালো। একজন বা দুজনের জন্য বাস সাশ্রয়ী হলেও আমাদের মতো ছয়জনের জন্য এ ট্রিপের যা খরচ আসত, তার অর্ধেক খরচে ৪০০ ইউরোতে আমরা চার দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া নিতে পেরেছি। অবশ্যই অনেক আগে গাড়ি ভাড়া করতে হয় ভালো রেট পেতে হলে।

সেলফসে সকালে নাশতা করে কটেজ থেকে বের হতে হতে সকাল ১০টা। আজ আমার ড্রাইভিংয়ের দায়িত্ব। গাড়িতে ওঠার আগে ফটোশুট করতে গিয়ে স্বর্ণা ওর মুঠোফোন বাসার বারান্দায় ফেলে এসেছে। কিছুক্ষণ গাড়িতে খোঁজাখুঁজির পর আইফোনের লোকেশন যখন আমাদের কটেজ দেখাচ্ছিল, তখন আর সন্দেহ থাকল না। মুঠোফোনটি ঠিক বারান্দায়ই পাওয়া গেল। এ জনমানবহীন প্রান্তে কে ফোন নিতে আসবে? আর আইসল্যান্ড খুব শান্তির এক দেশ। পুলিশ থাকলেও সঙ্গে কোনো বন্দুক থাকে না। তাদের কোনো সেনা, নৌ বা বিমানবাহিনী নেই! একসময় ইউরোপের ত্রাস ভাইকিংদের এক দেশ হয়েও আইসল্যান্ড যেন এখন শান্তির দূত। ভাবা যায়? সময় কত কিছু বদলে দেয়! ন্যাটোর সদস্য হিসেবে তারা অবশ্য জানে, তাদের কেউ আক্রমণ করার আগে সাত–পাঁচ ভাববে।

আইসল্যান্ডের মেইন হাইওয়ে
ছবি: লেখক

কেরিড ক্রেটার

মুঠোফোন নিয়ে আমরা রিং রোড জয়েন করে প্রথমেই গেলাম কেরিড ক্রেটারে। এটি হাজার বছরের পুরোনো আগ্নেয়গিরি। অগ্ন্যুৎপাতে সব লাভা শেষ হওয়ার পর এটা নিজের মধ্যে ভেঙে পড়ার ফলে এখন সবুজ পানির লেকে পরিণত হয়েছে। আকাশ মেঘলা হলেও বৃষ্টি নেই। নিচে নামার সিঁড়ি দিয়ে পানি ছুঁইয়ে আসা যায়, তবে সুইমিং করা যাবে না। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আবার রিং রোডে উঠে পড়লাম। এবার যাব গুলফসের জলপ্রপাত দেখতে।

গুলফস জলপ্রপাত

প্রায় ৪০ মিনিটের ড্রাইভে পৌঁছে গেলাম গুলফসে। আইসল্যান্ডিক শব্দ ফসের মানে হচ্ছে জলপ্রপাত বা ঝরনা। এখানে এত জলপ্রপাত আছে যে এর নাম ল্যান্ড অব ওয়াটার ফল হলে মন্দ হতো না। দেশের ১০ শতাংশ হলো হিমবাহ। এসব বরফ গলা পানি গিরিখাত, নদী হয়ে বয়ে গিয়েছে দেশের বিভিন্ন দিকে। গুলফস এমন এক জলপ্রপাত, সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দুই লেভেলে টন টন পানি নিচে নেমে আসছে। পাশে যেতেই মনে হলো যেন বৃষ্টি হচ্ছে। দুই লেভেলে ঘোরাঘুরি শেষে পাশের স্যুভেনির শপে ঢুঁ মারলাম। আমাদের ছোট মেয়ে ইনায়দা খুব আগ্রহ নিয়ে ফ্রিজ ম্যাগনেট জমায়। এখানে ম্যাগনেটের সঙ্গে আইসল্যান্ডের রুলার কেনে খুব খুশি। কারণ, এতে সব দর্শনীয় স্পটের ছবি।

গেইজার দর্শন

আমাদের এ হলিডেতে প্রাকৃতিক অনেক আশ্চর্য খেয়াল দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এ গেইজার আমাদের দুই মেয়ে ইসরা ও ইনায়দার সবচেয়ে প্রিয়। মাটির গভীর থেকে ১০০ ডিগ্রি গরম পানি প্রচণ্ড শক্তিতে আকাশের দিকে ছুটে যায় ৫-১০ মিনিট পরপর। সবচেয়ে বড় গেইজার থেকে পানি অনিয়মিত ওঠে; তাই তেমন ভিড় নেই সেখানে। আমরা স্ট্রটর গেইজারে কিছু সময় কাটালাম। নিয়মিত পানি আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে, গায়ে লাগে গরম পানির ছোঁয়া।

ব্রোরার ফস

এরপরের গন্তব্য আরেকটি জলপ্রপাত। নীল পানি এর বিশেষত্ব। রিং রোড থেকে সাইন দেখে গাড়ি পার্ক করলাম। কোন দিকে হাঁটলে জলপ্রপাত পাওয়া যাবে বুঝতে না পারায় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এখান থেকে দুই কিলোমিটার হাঁটলে ব্রোরার ফসের দেখা মিলবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে শিশু দেখে বললেন, ফসের কাছে আরও একটি কার পার্ক আছে, ৭০০ ক্রোনা পে করতে হবে সারা দিনের জন্য।

আইসল্যান্ডের ক্রোনা কিন্তু বাংলাদেশের টাকার চেয়ে দুর্বল। ৭০০ ক্রোনা মানে প্রায় ৫০০ টাকা। ইউকের তুলনায় এই পার্কিং চার্জ কমই মনে হলো। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে তাই কাছের কার পার্কে গাড়ি রাখলাম। গাড়ি থেকে বের হতেই পানির কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে।

হিমবাহ থেকে নীল পানি ব্রোরার নদী দিয়ে যাওয়ার সময় নীল পানির এক অপরূপ আবহ তৈরি করেছে। নদীর ওপর পায়ে হাঁটা ব্রিজ, যার নিচ দিয়ে কলকল শব্দে নদী বয়ে যাচ্ছে। ট্রাইপড সেট করে অপরূপ এ দৃশ্য বাক্সবন্দী করার চেষ্টা করলাম।

দুপুরে গুলফসের রেস্টুরেন্টে তেমন কোনো ভালো ভেজিটেরিয়ান অপশন ছিল না। স্যান্ডউইচ, কেক তো আর মেইন মিল হতে পারে না। ব্রোরার ফস দেখে তাই রিকাভিকের শালিমার রেস্টুরেন্টে ছুটলাম। আইসল্যান্ড আসার আগেই গুগলে হালাল রেস্টুরেন্ট সার্চ দিতে এই রেস্টুরেন্টের নাম পেয়েছিলাম, সবাই ভালো রিভিউ দিয়েছে। শনিবার রাত বলে রাস্তা খুব ব্যস্ত। শালিমারের পাশের বার থেকে লাইড মিউজিক ভেসে আসছে। এই স্ট্রিটে অনেক রেস্টুরেন্ট ও বার।

রেস্টুরেন্টের মালিক পাঞ্জাবের। ২৩ বছরের পুরোনো রেস্তোরাঁ। ভেতরে কাস্টমার শুধুই আমরা, তবে কিচেন খুব ব্যস্ত। মনে হলো অনেক টেকওয়ে অর্ডার আছে।

বাইরে তুমুল বৃষ্টি, জানালার কাচে জলের আলপনা, পুরোনো কোন পাঞ্জাবি মিউজিক বাজছে মৃদু ভলিউমে। আইসলান্ডে আমাদের আজ দ্বিতীয় রাত। বাইরে বৃষ্টির কারণে আলোর কোনো তীব্রতা নেই। তবে রাত নয়টা বাজলেও সূর্য ডোবার কোনো লক্ষণ নেই। এখানে মাগরিবের সময় হয় রাত সাড়ে ১১টায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে রিকাভিকের পোর্ট আর চার্চ দেখে আমরা কটেজের পথ ধরলাম।

৩.

জিওমেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে টেকটোনিক প্লেট দর্শন ছাড়া আরিফ ভাইয়ের আইসল্যান্ড ভ্রমণ শেষ হতে পারে না। পরের গন্তব্য তাই পিংভিল ন্যাশনাল পার্ক। গাড়িতে যেতে যেতে তিনি টেকটোনিক প্লেট সম্পর্কে ইসরাকে বুঝিয়ে বললেন। সঙ্গে আমরাও অনেক কিছু জানলাম।

পৃথিবীর মহাদেশগুলো সাতটি প্লেটে ভাগ করা। ভাগগুলো মাত্র কিছু জায়গায় দেখা যায়, বেশির ভাগই মাটি বা সাগরের নিচে। এই প্লেটগুলো খুব ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে প্লেটগুলোর কম্পনে ভূমিকম্প হয়। আইসল্যান্ডের পিংভিল ন্যাশনাল পার্ক হচ্ছে ইউরেশীয় ও উত্তর আমেরিকান প্লেটের সংযোগস্থল, এখানে প্লেট দুটির মাঝখানে অনেক গ্যাপ। মাঝ দিয়ে হাঁটার সরু রাস্তা। ভূমিকম্প এখানে মামুলি ব্যাপার। মাসে অনেক সময় কয়েক হাজার ভূমিকম্প হয়!

পার্কে পৌঁছানোর পর দেখি এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। তাই ছাতা মাথায় করে আমরা রওনা হলাম। উঁচু–নিচু পথ বেয়ে পাহাড়ে ওঠা। এ জায়গায় বেশ কিছু গাছ দেখা যাচ্ছে, তা ছাড়া পুরো আইসল্যান্ডে খুব কমই বড় গাছ আছে। আগ্নেয়গিরির লাভার ওপর শুধু সবুজ ঘাস অথবা শ্যাওলা দেখা যায়।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অনেক সিঁড়ি ভেঙে ভাগ হওয়া প্লেটের অন্য প্রান্তে পৌঁছালাম। যেন কয়েক কদম হেঁটে ইউরোপ থেকে আমেরিকায় পৌঁছে গেলাম। পাহাড়ের চূড়ায় স্যুভেনির শপ। আমাদের মতো আরও কয়েকজন পর্যটক সেখানে আছেন। আসলে বেড়াতে এসে আবহাওয়ার কারণে হোটেলরুমে বসে থাকার কোনো মানে নেই। তার চেয়ে তা উপভোগ করাই ভালো। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাসও, ছাতা প্রায় উড়িয়ে নিচ্ছে।

ইউকুল সার্লন লেগুন—আইসল্যান্ডের এ লেগুনের প্রতি আমার বরাবরের আগ্রহ। বিশাল বিশাল বরফের টুকরা নিয়ে লেকটি রাজধানী রিকাভিক থেকে ৬ ঘণ্টার ড্রাইভ। গ্লেসিয়ারের পানির কারণে এটি নীল রঙের এক লেক। লেকটিতে নৌকা নিয়ে ট্রিপ করা যায়, যা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখা নর্থ পোলের মতো মনে হয়।

ওয়েদার অ্যাপ দেখে বৃষ্টিবিহীন দিনে সেখানে যাওয়ার প্ল্যান করলেও সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি আবহাওয়ার গতি–প্রকৃতি সব বদলে গেছে, ওয়েদার অ্যাপ যেন কবি শ্রীজাতের মতো বলছে... ‘সমুদ্রে কেউ যাচ্ছে না আজ, সতর্ক রেডিও।’ সারা দিনই বৃষ্টির পূর্বাভাস। কিন্তু আজই আইসল্যান্ডে আমাদের শেষ দিন। যা আছে কপালে বলে নাশতা করে আমরা উঠে পড়লাম গাড়িতে।

সেলফস থেকে কিছু দূর পেরোতেই এক অপরূপ সবুজ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে মাইলের পর মাইল রাস্তা। দূরে একের পর এক পাহাড়ি ঝরনা। পথেই পড়ল বিখ্যাত স্কগাফস ও সেইলালেন ফস। এ দুই ঝরনা শাহরুখ খান ও কাজলের গেরুয়া গানের লোকেশন হিসেবে উপমহাদেশের দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

ঝরনা দুটি অনেক সময় নিয়ে দেখলাম। সেইলালেন ঝরনায় আবার পানির পেছনেও যাওয়া যায়। দুটি ঝরনাতেই পানির একদম কাছে যাওয়া যায়। শাহরুখ কাজলকে কপি করে ছবি তুলতে গিয়ে আমরা দুজনেই কাকভেজা।

এখান থেকে ইউকুলসার্লন লেগুন আরও চার ঘণ্টার ড্রাইভ। আরিফ ভাই এবার ড্রাইভিং সিটে আর আমি গাড়ির হিটারে আমার জ্যাকেট সক্স শুকাতে ব্যস্ত থাকলাম। ইউকুলসার্লন লেগুনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তিনটা। বৃষ্টির সঙ্গে কনকনে শীত। লেগুনে বিশাল বিশাল বরফের চাঁই। সেই কবে দূরের নীল উঁচু পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। লেগুনে বোট ট্রিপের ব্যবস্থা থাকলেও এই কনকনে শীতে যেতে ইচ্ছে হলো না। পাশেই এক পাহাড় থেকে পুরো লেগুন দেখা যায়। যদিও আজ বৃষ্টির জন্য ভিজিবিলিটি অনেক কম।  

ফিরতি পথে ব্ল্যাকবিচের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কারোরই নামার উৎসাহ নেই। আসলে আজ অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে। ফেরার পথে আবারও স্কগাফস ও সেইলালেনে কিছু প্যাটেল শট নেওয়ার জন্য থামলাম। এখন পরিষ্কার আকাশ।

পরের দিন সকাল নয়টায় আমাদের ফিরতি ফ্লাইট। প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময় আইসল্যান্ড। পাহাড়, সমুদ্র, ঝরনা আর প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির চিহ্ন আগ্নেয়গিরি। ব্লু লেগুনের উষ্ণ পানি আমাদের প্রথম দিন যে অভ্যর্থনা জানিয়ে ছিল, তা যেন রিকাভিকের আলোঝলমল স্ট্রিট, স্কগাফস কিংবা ইউকুলসার্লনের নীল গ্লেসিয়ার লেগুন পর্যন্ত বজায় ছিল। এখানকার জিওথারমাল পানির হিলিং পাওয়ার আছে বলে যে মতবাদ আছে, তা সত্যি কি না জানি না; তবে প্রকৃতির  খুব কাছে থেকে বেশ কিছু প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখে মনে এক অপূর্ব প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরছি, এটা বলতে পারি। আর নর্দান লাইট বা অরোরা দেখতে কোনো এক শীতে আবার হয়তো ফিরে আসব এই ল্যান্ড অব ফায়ার অ্যান্ড আইসে।