আমি তখন স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সদ্য দেশ থেকে এসেছি। সুইডিশ ভাষা, সমাজ, রীতিনীতি—কিছুই জানা নেই। দেশ খেকে প্রথম বিদেশে আসা, সবকিছুই নতুন, ঝকঝকে প্রশস্ত রাস্তা, উঁচু উঁচু ইমারত আর নিয়ন আলোর মধ্যে আনকোরা নতুনদের যা হয়, আমারও সেই অবস্থা। প্রথম দিন ট্রেন ও বাসে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় পৌঁছে দিশাহারা হয়ে গেলাম। চারদিকে অজানা–অচেনা ছাত্রছাত্রীরা জটলা করছে, কথা বলছে। কথা বলছে সুইডিশ ভাষায়, যেটা আমার জানা নেই। দেশ ছেড়ে আসার আগে সুইডেনের দুজনকে চিনতাম, গানের আবা গ্রুপ আর টেনিসের বিয়নবরি। তারা কেউ আমার পাশে নেই। আশপাশের সবই স্মার্ট অপরিচিত মুখ।
খুঁজে পেতে রেজিস্ট্রি অফিস ও আমার ক্লাসরুম বের করলাম।
ক্লাসরুমে বিরাট লম্বা ও চওড়া টেবিল, টেবিলের দুদিকেই সুদৃশ্য চেয়ার পাতা, সাত থেকে আটজন ছাত্রছাত্রী বসে, সবাই বিদেশি কিন্তু বাংলাদেশের কেউ নেই। টেবিলের মাথায় রঙিন গাউন ও ধবধবে সাদা শার্ট পরা ৩০ থেকে ৩২ বছর বয়সীএক নারী বসে। চমৎকার গড়ন, হাসি হাসি মুখ। দড়জা অবধি এগিয়ে এসে একটি খালি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন বসার জন্য। তিনিই আমার স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মার্গারেটা ওলসন। আমাদের মূল সাবজেক্ট শুরু হয়নি। মূল সাবজেক্ট পুরোটাই সুইডিশ ভাষায়। লেকচার, বইপত্র, প্রশ্ন–উত্তর—সবই সুইডিশ, তাই মূলে যাওয়ার আগে সুইডিশ ভাষাটা শিখতে হবে।
চেয়ারে বসেই মার্গারেটা হাতে পেনসিল নিয়ে নিজের দিকে তাক করে সুইডিশ ভাষায় নিজের নাম বললেন, তারপর পেনসিলটি আমার দিকে তাক করে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না, শুধু মার্গারেটা নামটাই কানে এল। তিনবার একইভাবে জিজ্ঞাসা করলেন। মার্গারেটার চোখের দিকে তাকালাম। ভর্ৎসনা নেই, হাসি হাসি মুখ। মনে হচ্ছে, আমার ভ্যাবাচেকা চেহারা নিয়ে খেলা করছেন। পাশে বসা কলম্বিয়ান মেয়েটি হেসে ফেলল। বলল, তোমার নাম জিজ্ঞাসা করছেন। থতমত খেয়ে ইংরেজিতে নিজের নাম বললাম। মার্গারেটা জানালেন, ক্লাসে সুইডিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা যাবে না, তাহলেই তোমরা সুইডিশটা দ্রুত ধরতে পারবে। সুইডিশ অক্ষর আর ইংরেজি অক্ষরে কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে গ্রামার আর তিনটি অতিরিক্ত অক্ষরে। ওই তিন অতিরিক্ত অক্ষরের উচ্চারণ আমার জীবন ঝালাপালা করে দিয়েছিল।
প্রথম দিন ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে সুইডিশ গ্রামার ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভাবলাম, এভাবে হবে না। মার্গারেটা যে হোমটাস্ক দিয়েছেন, তার জন্য এক্সট্রা ক্লাসের দরকার। দেশটা নতুন, ভাষাটাও নতুন। কোনোটাই বোধগম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও স্টকহোমের ভেতর ভাষা শিক্ষার অনেকগুলো ইনস্টিটিউট আছে, তারই একটির সন্ধ্যাকালীন কোর্সে অতিরিক্ত ক্লাস করার জন্য ভর্তি হয়ে গেলাম। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়, বিকেলে ইনস্টিটিউট। পড়তে পড়তে রাত দুইটা–তিনটা বেজে যেত। এভাবেই গেল দিন, রাত, মাস। তারপর এল প্রথম টার্মের পরীক্ষা। পরীক্ষা ভালো হলো না, মার্গারেটা খুশি হলেন না।
একদিন ক্লাস শেষে মার্গারেটা তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে বললেন, ক্লাসের অন্যরা অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে, তোমাকেও করতে হবে। কোন কোন জায়গায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছ, ওই জায়গায় বারবার ফোকাস করতে হবে। কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে একটি সুইডিশ দৈনিক পত্রিকার পাতা দেখিয়ে বললেন, অবসর সময়ে এই পাতা পড়বে আর এই বই মনোযোগ দিয়ে পড়ো। কথা বলার সময় মার্গারেটার মুখে হাসি দেখা গেল না, কেমন যেন মিষ্টি গম্ভীর। র্যাক থেকে একটা বই নিয়ে হাতে তুলে দিলেন। বইটি হাতে নিয়ে দেখলাম, বিখ্যাত সুইডিশ শিশুসাহিত্যিক আস্ট্রিদ লিন্দগ্রেনের ‘পিপ্পিলংস্ট্রুম’। অবসর সময়ে ‘পিপ্পিলংস্ট্রুম’ পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে গেলাম। এর মধ্যে পড়ে ফেললাম বুলারবির ‘ছেলেমেয়েরা’, লুন্নেবেরিয়ার ‘এমিল’। বইগুলো আকাশের একটি জানালা খুলে দিল। বইগুলোর ছোট ছোট চরিত্র যেন ফেলে আসা দেশটির বনজঙ্গল, রাস্তাঘাট, পুকুর ও নদীতে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ভাষা শিক্ষার পর মূল সাবজেক্ট শুরু হলে মার্গারেটার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তখন আমরা নতুন বিল্ডিংয়ে চলে গিয়েছি। নতুন ক্লাসে নতুন শিক্ষক, অনেক ছাত্রছাত্রী, পড়াশোনার চাপ আরও বেশি। এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ আড়াই বছর। মার্গারেটার সঙ্গে দেখা হয়নি, তবে মার্গারেটা ও ‘পিপ্পিলংস্ট্রুম’ আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। মার্গারেটাকে বইগুলোও ফেরত দেওয়া হয়নি। মার্গারেটা আমার জীবন বদলে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।