পশ্চিমা মিত্রদের স্বীকৃতি পেল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এরপর কী
যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও পর্তুগাল আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর আগে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম একই ধরনের ঘোষণা দেয়। ফলে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে এখন ১৫০টির বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির ইতিহাসে এই মুহূর্ত নিছক প্রতীকী নয়; বরং গভীর রাজনৈতিক, আইনগত ও নৈতিক তাৎপর্য বহন করছে।
স্বীকৃতির এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে গাজায় চলমান ধ্বংসযজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক ক্ষোভ। একদিকে শিশুসহ হাজারো মানুষের মৃত্যু ও লক্ষাধিক মানুষের বাস্তুচ্যুতি, অন্যদিকে জাতিসংঘ কমিশনের কঠোর প্রতিবেদন যেখানে ইসরায়েলকে সরাসরি ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইসরায়েল তা অস্বীকার করলেও এই অভিযোগ আন্তর্জাতিক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো, যারা এত দিন আলোচনাকেন্দ্রিক সমাধানের অপেক্ষায় ছিল, তারা অবশেষে বুঝতে পেরেছে যে নির্মম বাস্তবতা ও মানবিকতা এড়িয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও ফিলিস্তিন: আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশন রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক শর্ত নির্ধারণ করে—
১. স্থায়ী জনসংখ্যা
২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড
৩. কার্যকর সরকার
৪. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার সক্ষমতা।
ফিলিস্তিন এ চারটির সব কটিই কোনো না কোনোভাবে পূরণ করে। স্থায়ী জনসংখ্যা রয়েছে, ভূখণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত (যদিও দখলকৃত ও বিতর্কিত), সরকার হিসেবে রয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে পিএলও দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিনিধিত্ব করছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থায় ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকার করার যুক্তি আর টেকে না।
‘দূর পরবাস’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
এই স্বীকৃতির পরিণতি শুধু প্রতীকী নয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক, দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, এমনকি বাণিজ্য নীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, যে দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিল, তারা যদি পশ্চিম তীরের অবৈধ ইসরায়েলি বসতি থেকে পণ্য আমদানি চালিয়ে যায়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের শামিল হবে। অর্থাৎ স্বীকৃতি কার্যত ইসরায়েলের দখল নীতি ও বসতি স্থাপন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে নতুন চাপ তৈরি করবে। এ ছাড়া স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই নতুন ভারসাম্য খুঁজতে হবে। এতে ইসরায়েলের জন্য কূটনৈতিক পরিবেশ আরও প্রতিকূল হয়ে উঠবে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিন এখনো কেবল ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’। পূর্ণ সদস্যপদ পেতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ব্যবহার করে সেই পথ আটকে রেখেছে। তবে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র যখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত আন্তর্জাতিক মঞ্চে একা হয়ে গেছে। চীন ও রাশিয়া আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে এখন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র স্থায়ী সদস্য, যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রত্বের বিরোধিতা করছে। এই অবস্থান ওয়াশিংটনের জন্য ক্রমেই অস্বস্তিকর ও নৈতিকভাবে দুর্বল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিমা স্বীকৃতিকে ‘সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ডানপন্থী জোট সরকারের জন্য এটি প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্ব কূটনীতিতে ইসরায়েল ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, সামরিক ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক ক্ষোভ নেতানিয়াহুর কূটনৈতিক ক্ষমতা দুর্বল করে তুলেছে। তাঁর বক্তৃতা কঠোর হলেও তা এখন অনেকাংশে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই স্বীকৃতি কি অবিলম্বে ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা এনে দেবে? সম্ভবত নয়, তবে এর কৌশলগত তাৎপর্য অপরিসীম।
১. কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি: ইসরায়েলের ওপর নতুন আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হবে, যা তাদের আলোচনার টেবিলে ফেরাতে পারে।
২. দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পুনর্জাগরণ: দীর্ঘদিন ধরে মৃতপ্রায় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নতুন করে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে।
৩. যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বিপাকে পড়া: ওয়াশিংটন যদি একা থেকে যায়, তবে তার বৈশ্বিক প্রভাব ক্ষয় হতে পারে।
৪. ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা: পশ্চিমা মিত্র হারালে ইসরায়েলকে চীন–রাশিয়ার সঙ্গে পাল্টা প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘে ভোট থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ জনমত—সবখানেই ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ। পশ্চিমা দেশগুলো যখন ধীরে ধীরে স্বীকৃতি দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। মানবিক সহায়তা, আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় কূটনীতি ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্রত্বের পক্ষে সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া এখন জরুরি। এতে শুধু ফিলিস্তিন নয়, বাংলাদেশের নৈতিক মর্যাদা ও কূটনৈতিক শক্তিও বৃদ্ধি পাবে।
পশ্চিমা স্বীকৃতির এই স্রোত আন্তর্জাতিক কূটনীতির নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি শুধু মানবিক সংবেদনশীলতার প্রতিক্রিয়া নয়; বরং দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক অচলাবস্থা ভাঙার সূচনা। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এখনো পূর্ণ স্বাধীনতার পথে অনেক দূরে, কিন্তু এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে এক বড় পদক্ষেপ। তবে আব্রাহাম চুক্তির কারণে অনেক আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখায় ফিলিস্তিনি সংগ্রাম দুর্বল রয়েছে। পাশাপাশি পশ্চিম তীরের ফাতাহ ও গাজার হামাসের বিভাজন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করবে। পশ্চিমা স্বীকৃতি ফাতাহকে শক্তিশালী করলেও হামাস–ফাতাহ দ্বন্দ্ব মিটলে তবেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে।