আমার দেখা সেন্ট মার্টিন

লেখক ডান থেকে প্রথম

আজ থেকে ৩৮ বছর আগের কথা। আমি তখন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষাসফরে যেতে হয়। সচরাচর শিক্ষাসফরগুলো কক্সবাজারকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সেই হিসেবে নভেম্বর মাসের কোনো একসময় আমাদের শিক্ষাসফরে যাওয়ার দিন–তারিখ ঠিক হয়।

আমাদের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ড. মেহের ই খুদা স্যারের তত্ত্বাবধানে আমাদের শিক্ষাসফরের বিভিন্ন কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা প্রথমে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রওনা দেব চট্টগ্রামের উদ্দেশে, সেখান থেকে বাসে কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে পরদিন আমরা যাব মহেশখালী দ্বীপে। তারপর একদিন কক্সবাজার থেকে রওনা দেব সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশে। সেখানে এক রাত থেকে পরদিন কক্সবাজারে ফিরে আসব। তারপর আরও দুই দিন কক্সবাজারে অবস্থানের পর আমরা ঢাকায় ফিরব। এভাবেই সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন ড. আজিজুন নাহার আপা এবং নাজমুল হুদা স্যার। আমরা প্রায় ৪০-৫০ জনের একটি দল রওনা দিয়েছিলাম কক্সবাজারের দিকে।

সময় অনুযায়ী আমরা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছিলাম। সব ছাত্রছাত্রী মহা–আনন্দে হইচই করতে করতে কখন যে চট্টগ্রামে পৌঁছেছিলাম, বলতে পারব না। যা–ই হোক, মেহের–ই–খুদা স্যারকে আমরা সবাই প্রচণ্ড ভয় পেতাম, শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু শিক্ষাসফরের সময় স্যার আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। তাই আমাদের আনন্দের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। যা–ই হোক, আমরা সবাই নাশতা সেরে আবার বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম।

লেখক ডান থেকে দ্বিতীয়

সফরসূচি অনুযায়ী আমরা নির্দিষ্ট দিনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের উদ্দেশে টেকনাফের পথে রওনা দিয়েছিলাম। টেকনাফে পৌঁছে আমরা সবাই দুপুরের খাবার সেরে নিই। তারপর আমাদের সবার একটা ছোট্ট জাহাজে করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দিকে যাত্রা করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা কয়েক বন্ধু একটু দেরি করে জাহাজে পৌঁছানোর কারণে আমাদের ছয়-সাতজনকে স্যার সঙ্গে নিতে পারলেন না। জাহাজে স্থানসংকুলান না হওয়ায় আমাদের জন্য একটি আলাদা ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেহের ই খুদা স্যার আমাদের দেখভাল করার জন্য নাজমুল হুদা স্যারকে আমাদের সঙ্গে ট্রলারে রওনা দিতে বলেছিলেন। যদিও নাজমুল হুদা স্যার খুব একটা খুশি হতে পারেননি। আমরা যখন নাফ নদী দিয়ে যাত্রা করি, তখন বেশ ভালোই লাগছিল। তেমন কোনো ঢেউ ছিল না, নদীর দুই তীরের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা বঙ্গোপসাগরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা যখন বঙ্গোপসাগরে পৌঁছলাম, তখন দেখলাম সাগরের অন্য এক রূপ। সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখে নাজমুল হুদা স্যার বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের বন্ধু কফিল তখন স্যারকে সুন্দর করে বুঝিয়ে শান্ত করলাম। আর আমরা ছয়-সাতজন ছাত্র তখন কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমাদের মধ্যে মিন্টু ছিল একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। হঠাৎ মিন্টু উচ্চস্বরে গান ধরল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সব কালজয়ী জাগরণের গান একে একে গেয়ে চলল। ভয় তাড়াতে আমরাও সবাই ওর সঙ্গে গলা মেলালাম। এভাবেই গান গাইতে গাইতে আমরা সেন্ট মার্টিনে পৌঁছে গেলাম।

তখন সেন্ট মার্টিনে তেমন কিছুই ছিল না। আমরা সবাই হাঁটুপানিতে নেমে তীরে উঠলাম। জাহাজ থেকে আমরা যেখানে নামলাম, সেখানে একটি টং দোকান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেই দোকানে শুধু রং–চা বিক্রি হতো। পুরো দ্বীপে এ পাশ থেকে ও পাশ পর্যন্ত একটি বালুর রাস্তা ছিল আর যানবাহনের তো কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা যেখানে নেমেছিলাম, তার অপর প্রান্তে ছিল কোরাল পাথরের সারি আর সারি সারি কেয়াবন।

দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গায় ছিল একটি পুলিশ ফাঁড়ি এবং দক্ষিণ প্রান্তে ছিল বিডিআর ক্যাম্প। পুলিশ ফাঁড়ির আশপাশেই ছিল জেলে পরিবারগুলোর বসবাস। বাংলাদেশ ওয়াপদা একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করেছিল, তবে সেটা ছিল অসমাপ্ত। কোনো রকম বৈদ্যুতিক সুবিধা ছিল না পুরো দ্বীপে। আমরা সবাই প্রথমে পুলিশ ফাঁড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম এবং তাদের আন্তরিক সহযোগিতায় পুলিশ ফাঁড়িতে এবং ওয়াপদার অসমাপ্ত রেস্ট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এত লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা তখনো করা হয়ে ওঠেনি। আমাদের ছাত্রদের মধ্য থেকে ইমরান, লাভলু ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তৎকালীন অনুষ্ঠানঘোষক কায়সার বিভিন্নভাবে স্যারকে সব সময় সর্বাত্মক সহযোগিতা করছিল, যাতে আমাদের সফরটি সুন্দর ও সফল হয়। ওদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিক চেষ্টায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আমাদের পুরো সফরটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়েছিল।
ইতিমধ্যে আমরা দ্বীপের অপর প্রান্তে যেখানে অসংখ্য কোরাল পাথর রয়েছে, সেখান থেকে ঘুরে আসি। স্বচ্ছ পানি ও সারি সারি কোরাল পাথরের সাগরতীর সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করছিল। এভাবেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ইতিমধ্যে জাহাজঘাটের টংদোকানির সহযোগিতায় আমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা হলো। ওই টংদোকানি বিভিন্ন জেলে পরিবারের কাছ থেকে বেশ কিছু মুরগি ও ভাতের চাল জোগাড় করে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। ইতিমধ্যে রাত হয়ে গেল। ভীষণ ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যে যার মতো শিক্ষাসফরের আনন্দ উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ স্যার আমাদের সবাইকে টংদোকানের দিকে আসতে বললেন চা খেতে।

আমরা যে যার মতো করে চা খেয়ে স্যারের আশপাশেই ঘুরঘুর করছিলাম, যাতে স্যারের সঙ্গে একটু গল্প করতে পারি। এর মধ্যেই দ্বীপজুড়ে নেমে এসেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে দূরে কিছু মোমবাতি ও হারিকেনের টিমটিমে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছিল। এই অবস্থায় স্যার শুরু করলেন ভূতের গল্প। ভয়ংকর সেসব ভুতের গল্প শুনতে শুনতে দ্বীপের এই অন্ধকার রাতে আমাদের মনের মধ্যেও একটু ভয়ের সঞ্চার হলো, কিন্তু আমরা কেউ তা প্রকাশ করলাম না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর মুরগির মাংস ও ভাত খেয়ে আমরা রাতের খাবারপর্ব শেষ করলাম। সেই মুরগির মাংসের স্বাদ অনেক দিন ভুলিনি। এত মজা করে আমরা সবাই খেলাম, যার গল্প আমরা অনেক দিন ধরে করেছি। তখন রাত দশটা কি এগারোটা হবে, আমরা সবাই ধীরে ধীরে ফিরে আসছিলাম আমাদের থাকার জায়গায়। যার যেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সবাই ধীরে ধীরে সেখানে চলে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে যাদের ওয়াপদার রেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, তারা সবাই সেখানে ফিরে গিয়েছিলাম। কিছু মোমবাতি জোগাড় করে একটু আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা মেঝেতে চাদর বিছিয়ে, একটি ঘরে স্যার ও আমরা কয়েকজন ছাত্র এবং অন্য একটি ঘরে ম্যাডাম ও ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারপর রেস্ট হাউসের মাঠে কিছুক্ষণ গল্প করে আমরা সবাই ঘুমাতে চলে গিয়েছিলাম। অনেক ক্লান্ত থাকায় আমরা সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ করে মাঝরাতে আমাদের সবার প্রিয় বন্ধু শুভ্র ‘আমায় নিয়ে গেল, নিয়ে গেল’, বলে চিৎকার করে জানালার দিকে ছুটে যাচ্ছিল। আমি ওর পাশেই শুয়েছিলাম। ওর ওই অবস্থা দেখে আমি ওকে কোমড়ে জড়িয়ে ধরে বসিয়ে দিলাম। ওর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাইও ধর ধর বলে চিৎকার করে উঠেছিল। আমি তাড়াতাড়ি শুভ্রকে শুইয়ে দিলাম। তারপর পুরো রুমে এক অসাধারণ নীরবতা নেমে এল, নিশ্বাসেরও শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল, স্যারের ভূতের গল্পের প্রভাব সবার মনেই পড়েছিল। যা–ই হোক, আমি শক্ত করে শুভ্রর হাত ধরে ওকে ঘুমাতে বলে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন আমরা কয়েকজন খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পুরো দ্বীপটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অসম্ভব সুন্দর ও নিরিবিলি পরিবেশ, সেই সঙ্গে সারি সারা কেয়াবনের পাশ দিয়ে হেঁটে কোরাল পাথরের সারিতে এসে থামলাম। পুরোটা পথ আসার সময় বালির ওপর অসংখ্য দাগ দেখে স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জেনেছিলাম যে গভীর রাতে পুরো দ্বীপে সাপ চলাফেরা করে। সেগুলো ছিল সাপেরই চলাচলের চিহ্ন। দ্বীপে থাকাকালে আমরা সবাই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, এমনটাই মনে হচ্ছিল। সে এক অসাধারণ অনুভূতি, অসংখ্য কোরাল পাথর থাকায় সমুদ্রের ঢেউগুলো অনেক দূরে এসেই ভেঙে পড়ছিল। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম তাদের মাছ ধরার গল্প, বিরূপ আবহাওয়ার সঙ্গে সংগ্রাম করার অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা। একটা জিনিস আমাকে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করেছে, তা হলো, তাদের চাহিদা অনেক কম, কিন্তু সুখ অপরিসীম।

দুপুরে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্পে দাওয়াত খেয়ে পুলিশ ও বিডিআর ক্যাম্পের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিকেলের দিকে আমরা টেকনাফের পথে সেন্ট মার্টিন ত্যাগ করলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম দ্বীপে বসবাস করার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা এবং সবার সঙ্গে সীমাহীন বন্ধুত্বের এক অপার বন্ধন।
পরিশেষে এটাই বলব যে আমার দেখা সেন্ট মার্টিনে ছিল না কোনো দোকানপাট, ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না কোনো হোটেল। সারাটা দ্বীপে ছিল একটি বালুর রাস্তা, সারি সারি কেয়াবন ও নারকেলগাছের সারি, গোটা কয়েক জেলে পরিবার আর অসম্ভব নীরবতা। তাই তো আজকের সেন্ট মার্টিনের সঙ্গে আমার দেখা সেন্ট মার্টিনকে মেলাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলে ভেসে ওঠে আমার দেখা সেন্ট মার্টিনের সেই সব অমলিন দৃশ্য।

  • লেখক: ড. সোহেল আহমদ, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়া