তাহলে কি বিশ্ব অর্থনীতিতেও হার মানল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে?
বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামঞ্চে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। কখনো যুক্তরাষ্ট্র, কখনো চীন, আবার কখনো ইউরোপ—এই ত্রিমুখী টানাপোড়েনে বারবার প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের অর্থনীতির একচ্ছত্র অধিপতি? সাম্প্রতিককালে চীনের উত্থান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও আমেরিকার ডলার, প্রযুক্তি, বিনিয়োগ নীতি এবং ভূরাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে অন্যান্য সব অর্থনীতি এখনো অনেকটাই পরাধীন। এই বাস্তবতা আমাদের সামনে এক গভীর প্রশ্ন তোলে—বিশ্ব অর্থনীতিতেও কি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই জয়ী?
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যা বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়েছে।
নতুন শুল্কনীতির প্রধান দিকনির্দেশনা নিম্নরূপ—
• সর্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্ক: অধিকাংশ দেশের আমদানি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে।
• নির্দিষ্ট দেশের জন্য উচ্চতর শুল্ক: যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি বেশি, তাদের ক্ষেত্রে শুল্কহার ১১ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে, যা ৯ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
এই শুল্কনীতির ফলে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে—
• চীনের প্রতিক্রিয়া: চীন এই শুল্ক বৃদ্ধিকে ‘অযৌক্তিক’ বলে অভিহিত করে এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, যা বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
• বাজারে অস্থিরতা: শুল্ক ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে পতন ঘটে। বিশেষ করে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
• অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ২০২৫ সালে মার্কিন জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট কমতে পারে।
শুল্কনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন মতামত প্রদান করেছেন—
• মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি: শুল্ক বৃদ্ধির ফলে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, যা ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে।
• বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা: প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
• বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা: শুল্কনীতির কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করছেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এই নীতির ফলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, বাজার স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ভবিষ্যতে এই শুল্কনীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক—
১. সায়েন্স-বেজড বিজনেস বনাম ক্যাসিনো ব্যবসা
ট্রেড মার্কেটের সায়েন্স-বেজড ব্যবসা হওয়ার দাবি, বাস্তবিক অর্থে, অনেকাংশেই মিথ্যা। বাজারের অধিকাংশ বাণিজ্য আসলে সঠিক অর্থনৈতিক মূল্যায়ন বা বাস্তব পণ্য-পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং শেয়ারবাজারের অবস্থান নির্ধারণ হয় গুজব, মৌলিক ঝুঁকি, বড় অর্থনৈতিক সংকেত, বাজারের মনস্তত্ত্ব—এসব দ্বারা। অনেক সময় শেয়ারবাজারে স্টকের দাম ওঠানামা করে শুধু বিনিয়োগকারীদের মনস্তত্ত্বের কারণে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ জন্যই অনেকেই একে ‘ক্যাসিনো ব্যবসা’ হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে গাণিতিক বা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পরিবর্তে অনুমান এবং ভাগ্যই প্রধান ভূমিকা নেয়।
২. অর্থনীতির জন্য হাস্যকর বিষয়
এটি অর্থনীতির জন্য হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায় যখন একটি পণ্যের মূল্য, যা অনেক সময় কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, অস্থিরভাবে ওঠানামা করে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়, বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং কিছু কোম্পানির শেয়ার শুধু শেয়ার বাঁচানোর জন্য ক্যাসিনো স্টাইল ব্যবসা শুরু করে। এতে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর সম্ভাবনা থাকে, যা একেবারে একটি জুয়াখেলার মতো হয়ে পড়ে।
৩. ট্রেড মার্কেট কি ব্যবসা?
এটা ব্যবসা নয় বরং এর কার্যক্রম অনেকটা একটি গেম বা জুয়া খেলার মতো। শেয়ারবাজারে যে পণ্য বা সেবা সরবরাহ হয় না, সেটি একধরনের ‘কমোডিটি’ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে মূলত মুনাফার জন্য শেয়ার কেনাবেচা করা হয়, কিন্তু কোনো প্রকৃত অর্থনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা হয় না। বাজারে এখন ‘স্পেকুলেশন’—অর্থাৎ ভবিষ্যতের দাম বাড়ানোর জন্য পণ্যের ভলিউম এবং গুজব নিয়েই মানুষ চলছে, আর এর ফলে, এটি ব্যবসার চেয়ে লটারির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৪. বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অভাব
ট্রেড মার্কেটের পরিবর্তন, যা ৩০ শতাংশ বা তার বেশি ওঠানামা করতে পারে এক দিনের মধ্যে, সেটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বাভাবিক। এর কোনো নির্ধারিত অর্থনৈতিক যুক্তি বা ফান্ডামেন্টাল নেই। এটি শর্টটার্ম সাইকলিক চেঞ্জেস এবং ম্যানিপুলেটিভ ফ্যাক্টরস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা ‘সায়েন্স-বেজড বিজনেস’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
৫. অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রভাব
বিশ্বব্যাপী যখন ট্রেড মার্কেটের এই অস্থিরতা বাড়ে, তখন এর প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি বাজারের অংশগ্রহণকারীদের জন্য একধরনের ভীতি তৈরি করে, যার ফলে বহু মানুষ বিনিয়োগ থেকে পুঁজি হারায়।
বিশ্ব এখন একটি নতুন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো প্রয়োজন
১.
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শক্তিশালী পুনর্গঠন: যাতে বড় রাষ্ট্রগুলোর একতরফা সিদ্ধান্ত ঠেকানো যায়।
২.
আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট গঠন: বিমসটেক (BIMSTEC), ব্রিকস (BRICS), আফ্রিকান ইউনিয়ন (African Union) ইত্যাদি জোটগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো।
৩.
বিকল্প মুদ্রা ও ট্রেড রুট: ডলারনির্ভরতা কমানো, জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের পথ খোলা।
৪.
টেকসই উৎপাদন ও বিকেন্দ্রীকরণ: Supply chain-এর বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রতিটি অঞ্চলে উৎপাদনক্ষমতা তৈরি।
* বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের এ মুহূর্তে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এসব পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য।
১.
বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা: বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার একক আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে একটি নতুন কাঠামো প্রতিষ্ঠা জরুরি, যেখানে সব দেশ অংশ নেবে।
২.
ডলারনির্ভরতা কমিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রাবিনিময় ও লেনদেন জোরদার করা: ডলারনির্ভরতা কমিয়ে আঞ্চলিক মুদ্রা ব্যবহার করে ব্যবসা করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ তৈরি করতে হবে।
৩.
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ানো: দেশগুলোর উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।
৪.
স্থানীয় বাজার ও কৃষি অর্থনীতি শক্তিশালী করা: খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির বিকাশে স্থানীয় উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে হবে।
৫.
ভারসাম্যপূর্ণ বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতি গড়ে তোলা: এমন একটি বাণিজ্যনীতি গঠন করতে হবে, যেখানে মানবিক প্রয়োজন এবং ন্যায্যতা অগ্রাধিকার পাবে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ নয়।
এ সময়ে দেশগুলোর জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করবে—
১. জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা: দেশগুলোর উচিত নিজস্ব গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা।
২. আমেরিকার উন্নত শিক্ষা ও গবেষণার মডেল থেকে শেখার মনোভাব: বিদেশি শিক্ষা ও গবেষণার সেরা উদাহরণ থেকে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করা।
৩. বৈশ্বিক বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতার নীতি: প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে, যেখানে বড় দেশগুলোর শক্তির দাপটের পরিবর্তে সব দেশের সুযোগ থাকবে।
৪. বৈশ্বিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষম বাণিজ্য চুক্তি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষম চুক্তি প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে পুনরুদ্ধার করার সুযোগ মেলে।
* বিশ্ব অর্থনীতিতে টেকসই এবং সমৃদ্ধির জন্য কয়েকটি ভুল পদক্ষেপ এড়িয়ে চলা জরুরি—
১. মার্কিন চাপে বা স্বার্থে আত্মসমর্পণমূলক নীতি গ্রহণ: গ্লোবাল পলিটিক্যাল চাপের মুখে এসে আত্মসমর্পণ করা দেশগুলোর জন্য কখনোই শুভকর নয়।
২. একমুখী আমদানিনির্ভরতা: শুধু আমদানির ওপর নির্ভর করে কখনো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পাওয়া সম্ভব নয়; স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়া: দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের বোঝা দেশের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
৪. নিজের উৎপাদনশীলতা উপেক্ষা করে কেবল আমদানিকৃত পণ্যে নির্ভরতা: দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পরিবর্তে শুধু আমদানি করতে থাকলে তা অর্থনৈতিক সংকটে নিয়ে যাবে।
* রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন