জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন: প্রবাস থেকে কিছু দেখা, কিছু ভাবনা

কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন আবু সাঈদছবি: সংগৃহীত

গত দুই সপ্তাহ কেমন করে কাটাচ্ছি, বলে বোঝাতে পারব না। আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনায় কাটছে প্রতিটা মুহূর্ত। জানছি বাংলাদেশে চলমান ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে, সরকার শক্তি প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে। কিন্তু এমনটা কি হবার দরকার ছিল?

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। কোটা আন্দোলন প্রথম বড় আকারে হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে বছরের শুরু থেকেই পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কোটায় নিয়োগ ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, শূন্য পদে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা।

তবে ছোট আকারে শুরু এ আন্দোলনকে সরকার প্রথম আমলে নেয় সে বছরের এপ্রিলে। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, ‘যখন কেউই কোটা চায় না, তখন কোনো কোটাই থাকবে না, কোটা পদ্ধতি বাতিল।’ সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সব ধরনের কোটাপদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এই বাতিলের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। শুনানির পর এ বছরের ৫ জুন কোটা পুনরায় বহাল করেন হাইকোর্ট। তবে সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে বলে জানান হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ আদেশের পর থেকেই শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আবার আন্দোলনে নামেন। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১ জুলাই থেকে আন্দোলন বড় আকার ধারন করতে শুরু করে।

এ আন্দোলনের একপর্যায়ে সংঘর্ষে ২১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের নিহত হওয়ার ভিডিও আমরা সবাই দেখেছি, চোখের পানি ফেলেছি। তার চোখের অবিশ্বাস আমাদেরও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। তখনো উত্তেজনা প্রশমনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বন্ধ রাখা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পরে খুলেও দেওয়া হয়েছে। নানা ঘটনার চলতে থাকে। এরইমধ্য কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রদান করেছেন। রায়ে বলা হয়, ৯৩ শতাংশ মেধা ও ৭ শতাংশ কোটায় নিয়োগ হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে বিএনপি, জামায়াত-শিবির সহিংসতা চালিয়েছে। তবে দেশের বাইরে থেকে যা মনে হচ্ছে, তা হলো, সরকার কারও কথা শুনতে চায় না, কোনো ধরনের সংলাপ করতে চায় না। সরকার নিজেদের ধরাছোঁয়ার ওপরে মনে করছে।

২০০৮ সালে তরুণদের ব্যাপক সমর্থনে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের ২০২৪ সালে এসে হয়তো আর তরুণদের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। জনগনের পালস বোঝার সক্ষমতা আর নেই সরকারের। আর জবাবদিহিতা? সে তো বলাই বাহুল্য।

জামায়াত-শিবির, বিএনপিকে দোষ চাপিয়ে বুলি আওড়ানো সরকার সাধারণ ছাত্রসমাজ, সাধারণ জনগণকেই ভুলে গেছে। বিদেশে আমরা যারা থাকি তাদের জন্য উড়াল সড়ক, পাতাল সড়ক, মেট্রোরেল কোনো কিছুর জন্যই দেশ আমাদের টানে না। দেশ আমাদেরকে টানে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, আমাদের গ্রামবাংলার পরিবেশ, খাবার। আমরা অহংকার করে এসব স্থাপনার কথা বলি না। আমরা অহংকার করে আমাদের মানুষের ভালোবাসার কথা বলি।

মানুষের জন্য মানুষের টানের কথা বলি। আমরা যখন এসব স্থাপনার কথা বলি, তখন বিদেশের জনগণ ঘুরেও তাকায় না। কিন্তু যখন বলি মা-বাবার সঙ্গে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি, তখন বিস্ময়ে তাদের মুখ বন্ধ হয় না। যখন বলি এত কষ্টের টাকা দেশের আত্মীয়-স্বজনের জন্য পাঠাই, তখন তাদের বিস্ময় ভরা চোখ দেখার মতো হয়ে থাকে। সেই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদেরই আপনারা নির্বিচারে গুলি করছেন? কোনো ধরনের অনুশোচনা দেখাচ্ছেন না আবার নির্লিপ্তভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে বলছেন। বাগানের ফুল ছিড়তে ব্যস্ত সরকার হয়তো ভুলে গেছেন বসন্ত এসে গেছে।

লেখক: মো. মোসাদ্দেকুর রহমান, পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো, কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, এবিনো শিক্ষাবোর্ড, জাপান