মামণি, তুমি বলেছিলে আকাশের তারা হয়ে জ্বলবে
শুক্রবার মা দিবস পড়েছে এ বছর। কেন যে শনিবার ছুটির দিনে এল না দিনটা। বাচ্চা দুটাকে তড়িঘড়ি করে রেডি করে স্কুলে পাঠাতে হয়েছে। আমাদের অফিসে আমার মতো যত মা আছেন, সবাই কেমন যেন আলাদা রকম খুশি এ দিনে। সবাই গল্প করছে ছোট ছোট কত রকম গিফট বানিয়ে এনেছে বা আনবে তার বাচ্চাটা, এই যেমন ছোট্ট ছবির ফ্রেম তার সঙ্গে কবে স্কুলে তোলা মায়ের সঙ্গে একটা ছবি সাজিয়ে গিফট, হাতের ব্যান্ড, পাথরে এলোমেলো রং করা শোপিস। সবার ডেস্ক ভর্তি এসব উপহারে।
স্বাস্থ্যসচেতন মায়েরা আজকে বাচ্চার দেওয়া প্যানকেক খেয়ে কী খুশি হয়ে গল্প করে। রীতিমতো আনন্দ–উৎসব চলে অফিসে এদিন। আমাকে আজকে যেতে হবে দুই ঘণ্টা দূরে নতুন অফিসে ওরিয়েন্টশনে। যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম আমাদের, নতুন জায়গায় অফিস খুলতেই হয়েছে কোম্পানিকে। দায়িত্ব বাড়ছে আমাদের।
নিক এমনিতে খুব হাসিখুশি মিশুক একটা ছেলে। বউ–বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে। শুধু মা দিবস এলেই সারা দিন ওর মুখ গম্ভীর। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু বিরক্তিকর মন্তব্যও ওকে করতে শুনেছি, সামান্য রং করা পাথর নিয়ে তোমাদের এত ঢং করার কী আছে? অফিস থেকে নিক আর আমাকে পাঠাচ্ছে পাম স্প্রিং বলে একটা জায়গায় নতুন অফিসে। নিক নিজেই এসে বলল, চলো একসঙ্গে যাই। হতাশ হয়ে বলেই ফেললাম আমি, দেখো নিক, আমার আজকে ভীষণ খুশির একটা দিন। পাম স্প্রিং থেকে ফেরার পথে আমার বাচ্চাদের স্কুল থেকে বাসার ফেরার সময় হয়ে যাবে। গাড়ি থেকে ফোনে অনেক কথা বলব আমি ওদের সঙ্গে। আমার সঙ্গে যেতে চাইছ চলো। কিন্তু মা দিবস নিয়ে কোনো উল্টোপাল্টা কথা বলে আমার মেজাজ খারাপ করবে না। নিক বলল, আচ্ছা। তুমি এত রাগ করো জানলে আগেও বলতাম না, চলো।
শুরু হলো দুই ঘণ্টার যাত্রা। শুরুটা মন্দ ছিল না, ঘণ্টাখানেক টানা ড্রাইভ করে চললাম আমরা, তারপর কফি ব্রেক নেব চিন্তা করে ফ্রি ওয়ে থেকে সারফেস স্ট্রিটে এক্সিট নিলাম। এক্সিট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম রাস্তার ডান দিকেই স্ট্রারবাকস, কফির দোকান। এটা ফেলে চলে গেলে ঘুরে আসতে আসতে ১৫ মিনিট সময় নষ্ট হবে চিন্তা করে নিলাম মোড় একটু জোরেই, চাকা ছুরির মতো ধারালো কার্বে লেগে মুহূর্তে বসে গেল। হাওয়া শেষ। হতভম্ব হয়ে নিকের দিকে তাকালাম। নিক শান্ত হয়ে বসে আছে। বলল, সাহায্যকারী ডাকছি, চাকা বদলে স্পেয়ার চাকা লাগাবে। তুমি যাও, কফি নিয়ে এস ততক্ষণে। মোটামুটি দেড় ঘণ্টা সময় নষ্ট হলো চাকা বদলাতে। স্পেয়ার চাকা নিয়ে খুব ধীরগতিতে আমরা পাম স্প্রিংয়ের পথে রওনা হলাম। ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি, কাজ শেষ করে বিকেল নাগাদ ঘরে ফিরে বাচ্চাদের সঙ্গে মা দিবস পালন করা আমার হবে না। কার ওপর অভিমান করে জানি না কষ্ট পাচ্ছি ভীষণ। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না। চোখ মুছতে মুছতে গাড়ি চালাচ্ছি।
নিক ব্যাপারটা চুপ করে দেখল মিনিট খানেক। তারপর বলল, রু (রূপসা আমার নাম), স্যানডিয়াগো শহর থেকে আরও অনেক লোক যাচ্ছে পাম স্প্রিংয়ে। ওরা সবাই ফিরবে বিকেলের আগে। তুমি কারও সঙ্গে চলে এসো। তোমার গাড়ি আমি নিয়ে আসব। সমস্যা নেই। আমার বউ–বাচ্চাদের সঙ্গে আনন্দে মা দিবস পালন করবে। ওর ফুল, ওদের নৈশভোজ সব আমি আগে থেকে ব্যবস্থা করে এসেছি। শুধু ওদের আনন্দ দেখলে আমার কষ্ট হয় খুব, একজনের কথা খুব মনে পড়ে। তাই এই দিনে আমি একটু পরে যাই বাসায়। বললাম, নিক, তোমার কি মনে হয় না তুমি একটু নিষ্ঠুর প্রকৃতির? কিন্তু আমার মন বলছে, যে ছেলে নিজের বউয়ের মা দিবস পালনের সব আয়োজন করে এসেছে, আমাকে সময়মতো বাসার পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছে, সে আর যা–ই হোক, নিষ্ঠুর কোনো ছেলে নয়। আর এত বছর একসঙ্গে কাজ করি, কখনো কাউকে কঠিনভাবে কিছু সে বলেছে, এমনটা শুনিনি। তাহলে?
বললাম, নিক, তোমাকে আজকে বলতেই হবে মা দিবস এলে এত অদ্ভুত আচরণ কেন করো তুমি। নিক বলল, আচ্ছা শোনো তাহলে। বাচ্চাদের জন্য তোমার কান্না আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে। আমার জন্ম ভিয়েকলামের একটা গ্রামে। আমি আর আমার বোন খুব ছোট থাকতেই যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল দেশটাতে, মায়ের কাছে শুনেছি, একসময় আমাদের নিরাপদে থাকার আর কোনো উপায় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রগামী একটা নৌকায় মা-সহ আমি আর আমার বোনকে তুলে দিয়ে বাবা রয়ে গেলেন ভিয়েতনাম। তখন মা-সহ শিশুদের সরানো হচ্ছিল বিপদের মুখ থেকে। বাবা নাকি বলেছিলেন, প্রথম কোনো সুযোগেই আমেরিকা চলে আসবেন তিনি নিজের পরিবারের কাছে। আমি তখন খুব ছোট। একটা দুঃস্বপ্নময় দীর্ঘ পথ একা দুটি অবুঝ শিশুসহ পাড়ি দিয়ে মা আমাকে আর বোনকে নিয়ে পৌঁছালেন যুক্তরাষ্ট্র। পৌঁছে জানলেন, আমাদের বাবা মারা গেছেন। এ দেশে এসে জানো আমরা ভীষণ গরিব ছিলাম। মা দুটো কাজ করে কী কষ্টে আমাদের জন্য ভালো খাবার বা সুন্দর কাপড় জোগাড় করতেন, সেটা তিনিই জানেন। আর বিয়ে করেননি। রংচটা একই কাপড় দিনের পর দিন পরতেন তিনি। তবু স্বপ্ন দেখাতেন আমাদের মানুষ হওয়ার। যদি তাঁর সামান্য খাবার খেয়ে আমাদের জন্য রেখে দেওয়া দেখে রাগ করতাম, তখন বলতেন, তোরা চাকরি শুরু করলে দামি দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়াবি আমাকে। তখন দেখিস পালিয়ে যাস না। অথচ স্কুলে এইডের সাহায্যে এক বেলা ভালো খাবার আমরা পেতাম।
লোন করে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সুযোগ পেলাম পড়ার। বোন পড়ছিল নার্সিংয়ে। আর মাত্র বছরখানেক বাকি পড়া শেষ হতে আমাদের। এর মাঝে মাত্র দুই দিনের জ্বরে মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আজ কত নামীদামি অফিসে কাজ করি আমি। ইচ্ছা করলে যখন-তখন দামি রেস্তোরাঁ খেতে পারি। কিন্তু আমার মাকে এক বেলা কোথাও খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি আমার। তাই মা দিবসে প্রচণ্ড কষ্টে থাকি আমি। পারি না তোমাদের আনন্দ আয়োজনে শরিক হতে।
আমি কান্না ভুলে গেলাম। কত ভুল বুঝেছি নিককে। নিক গুনগুন করে দেখি গাইছে—
‘মামণি তুমি বলেছিলে
আকাশের তারা হয়ে কবে জ্বলবে
মিতু আর আমি তাই রোজ দেখি
আকাশের তারা হয়ে কবে জ্বলবে।’