একবার বিদেশি তো আজীবন বিদেশি
পৃথিবীতে কতটি দেশ আছে? উত্তর হতে পারে ১৯৩টি দেশ থেকে ২৪৬টি দেশ বা তার বেশি হতে পারে। যাহোক, সবচেয়ে গৃহীত উত্তর জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশের সংখ্যা ১৯৫। এ ছাড়া রয়েছে অনেক দেশ, যারা সংগ্রাম করে চলেছে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য। মানবজাতি হাজারো বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ ছাড়া।
তাই একটি দেশে বিভিন্ন দেশের লোক আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আজ বলব একটি ছোট্ট শহরের কথা, যে শহর স্টকহোম সিটি থেকে মাত্র ১৫ মিনিট দূরে এবং খুবই ছোট্ট একটি শহর। অথচ সারা বিশ্বের লোকের বাস সেখানে। শুধু ১৯৫টি দেশের নয়, তারও বেশি দেশের মানুষের ছোঁয়া রয়েছে এই শহরে। শহরের নাম রিনকেবি।
আজ গিয়েছিলাম সেখানে আমার গাড়ি ওয়াশ করাতে। সারা জীবন মেশিন দিয়ে গাড়ি ওয়াশ করি। হঠাৎ এক বন্ধু বলল, রিনকেবিতে গাড়ি ওয়াশ করে ভেতরে ও বাইরে মাত্র ৩০০ ক্রোনারে, যা মেশিনে ওয়াশ করলে ১ হাজার ৫০০ ক্রোনার, সঙ্গে গাড়ি রেখে আসতে হবে এবং পরের দিন আনতে হবে। এখানে বুকিং ছাড়াই চলে গেলাম। ঢুকতেই তারা আমার গাড়ি নিয়ে গেল এবং চারজনে মিলে ধোয়া-মোছার কাজ শুরু করল। চারজনের মধ্যে রয়েছে আফগান, মেক্সিকান, আফ্রিকান ও উজবেক। বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়লাম!
এত বছর স্টকহোমে আছি, অথচ দেখা বা জানা হয়নি চক্ষু মেলিয়া। কী জাদু রয়েছে এই রিনকেবিতে, যে সব দেশের লোকের বসবাস এখানে! এখানে খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে সবকিছু তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং ঘরবাড়ির অবস্থাও খুব আধুনিক নয়। বিভিন্ন দেশের দোকানপাট এখানে অবস্থিত, যেমন বাংলাদেশি শাকসবজি বা হিমায়িত মাছ এখানে পাওয়া যায়।
এখানে সবাই একসঙ্গে বসবাস করে চলেছে কোনো রকম সমস্যা ছাড়া। এখানকার সবাই রিনকেবি সুইডিশ ভাষায় কথা বলে। ১০০ শতাংশ সুইডিশ অ্যাকসেন্ট নয়। বিদেশি মিশ্রণ এর জন্য দায়ী। স্কুলবাস এসে হাজির, হঠাৎ নজরে পড়ে গেল এক মজার দৃশ্য! ছেলেরা আগে বাসে উঠল, পরে মেয়েরা এবং শুধু কি তাই মেয়েরা বাসের পেছনে গিয়ে বসল।
আমি তো অবাক! জিজ্ঞেস করতেই তারা বলে এখানে স্পেশাল স্কুল রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় কারণে আলাদাভাবে শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এখানে প্রত্যেকেই যার যার ধর্ম ও সংস্কৃতি শক্ত করে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে, যার কারণে অতি কাছে বসবাস করা সত্ত্বেও একে অপরের থেকে দূরে বসবাস করছে মনের রাজ্যে।
ছোট্ট একটি শহর রিনকেবি, যেখানে দুই শতাধিক দেশের লোকের বাস সত্ত্বেও মনে হলো দুই শটি ভিন্ন ভিন্ন দেশ। নানা কারণে এসব লোক তাঁদের নিজেদের স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন সুইডেনে। মনে হচ্ছে সবাই অর্থের কারণে এখানে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁরা এখানে না করছেন ভোগ তাঁদের নিজেদের দেশের সবকিছু, না সুইডেনের। তবে অর্থনৈতিকভাবে সব সুযোগ–সুবিধা আছে তাদের। টাকাপয়সা রোজগার করতে করতে হঠাৎ জীবনের সময় শেষ হয়ে যাবে। অর্থের বড়লোক হতে পারে তারা, জানি না মনের বড়লোক কতখানি এঁরা! সব দেখে মনে হলো—আশা আছে, ভাষা নেই, সুখ আছে, শান্তি নেই— ওয়ান্স আ ফরেনার অলওয়েজ আ ফরেনার।
দেখেছি এমনটি লন্ডনের মতো শহরে, দেখেছি নিউইয়র্ক, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালি, প্যারিস, স্পেনসহ আরও অনেক শহরে। আমার ভাবনা থেকে একটি কথাই বলতে ইচ্ছে হয় জীবনের মূল্য কী? কিসের জন্য বেঁচে থাকা? কেনইবা সব ছেড়ে এই দূর পরবাসে নির্জনতায় ঘর বাঁধা?
আমাদের নিশ্বাস নিতে, বিশ্বাস, দর্শন, স্পন্দন পেতে, যদি অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো সংগ্রাম করতে হতো, তাহলে কী হতো আমাদের জীবনের? হতো কি সামর্থ্য তখন এমনটি করে বেঁচে থাকার? সামান্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংগ্রামে ভালোবাসার স্বদেশ বিসর্জন দিয়ে আজ এত দূরে, বহু দূরে! স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ মানবজাতির জন্মে এবং মৃত্যুতে নেই কোনো ভেদাভেদ, তবে কেন মাঝখানের সময়ের মধ্যে এত ব্যবধান? আর কবেইবা হবে এর সমাধান!
২০২৩ সালের শেষের দিকে যদি লক্ষ করি, কী দেখছি? দেখছি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ, দেখছি হাহাকার, শুনছি না খেতে পাওয়া মানুষের আর্তনাদ, দেখছি দুর্নীতি, দেখছি নোংরা রাজনীতি, দেখছি ধনী–গরিবের ব্যবধান, দেখছি নতুন এক এল সালভাদর সুইডেনে। প্রতিদিন ধর্মগ্রন্থ পোড়ানো থেকে শুরু করে দিনদুপুরে মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করার খবর। দেখছি বন্যাপ্লাবন, দেখছি ভূমিকম্প, দেখছি অগ্নিদগ্ধ, পুড়ছে প্রকৃতি, মরছে মানুষ। মনে হচ্ছে সব থাকতেও কেউ নেই, কিছু নেই। দেহ আছে মন নেই, মানুষ আছে মনুষ্যত্ব নেই। নিজ দেশে বাক্স্বাধীনতা নেই, ভিনদেশে একবার বিদেশি তো আজীবন বিদেশি।