সুইডেনের গণতন্ত্র কি বাংলাদেশের নতুন উদাহরণ হতে পারে?
সুইডেন জনসংখ্যায় ক্ষুদ্র, যদিও আয়তনে এটি বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ বড়। মাত্র এক কোটি মানুষের দেশ, তবু দেশটির সংসদে রয়েছে আটটি রাজনৈতিক দল, যেগুলো কার্যকরভাবে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মাত্র ৫-৬টি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম দৃশ্যমান, আর বাকি দলগুলোর কার্যক্রম কম চোখে পড়ে। তারা হয়তো ফেসবুকে ‘সংসদ’ তৈরি করে সেখানে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক চালাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব জীবনের ক্ষমতার বলয়ে তাদের অবস্থান নেই। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে যেকোনো দিন হয়তো কেউ এসে এই ‘ফেসবুক সংসদ’ও বন্ধ করে দেবে—এমনটা আর নতুন কিছু নয়।
সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড—সব কটিই জনসংখ্যার দিক থেকে ছোট ছোট দেশ। তবু সেখানে একাধিক রাজনৈতিক দল সক্রিয় এবং তাদের মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এটাই আমাকে চমকে দেয়, কারণ বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ কার্যত অনুপস্থিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক দুর্নীতি, অনৈতিকতা, ভণ্ডামি, গুন্ডামি এবং স্বৈরতন্ত্র আমাকে গভীরভাবে হতাশ করে। আমি বিশ্বাস করি, সুইডেনের মতো দেশের গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসরণ করলে বাংলাদেশে দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এমনকি অল্প সময়ের মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে।
সুইডেনের গণতান্ত্রিক কাঠামোটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো:
১. সংসদ (রিক্সড্যাগ)
সুইডেনের সংসদকে রিক্সড্যাগ (Riksdag) বলা হয়, যেখানে ৩৪৯ জন সদস্য থাকেন। সংসদ সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন এবং তাঁদের দায়িত্ব হলো সরকারকে নজরদারি করা এবং আইন প্রণয়ন করা। প্রতি চার বছর অন্তর সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
২. ভোটপদ্ধতি
সুইডেনে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে, যেখানে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। কোনো দলকে সংসদে প্রবেশ করতে হলে জাতীয়ভাবে কমপক্ষে ৪ শতাংশ ভোট পেতে হয়, অথবা কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ১২ শতাংশ ভোট পেলেই তাঁরা সংসদে প্রবেশ করতে পারেন।
৩. ক্ষমতার বিভাজন
সুইডেনের রাজা রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তাঁর হাতে কার্যত কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। প্রকৃত ক্ষমতা সংসদ এবং সরকারের মধ্যে বিভক্ত। সরকারের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি সংসদের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন ও সরকারের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করেন।
৪. আনুপাতিক ক্ষমতা
বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে তাঁদের সংসদে আসন বরাদ্দ হয়। এতে সব রাজনৈতিক দল তাদের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পায়।
৫. নির্বাচনী পদ্ধতি
সুইডেনে নির্বাচন হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে, যেখানে দলগুলো প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী সংসদে আসন পায়। ভোটাররা তাঁদের পছন্দের দল অথবা নির্দিষ্ট প্রার্থীর জন্য সরাসরি ভোট দিতে পারেন, যা ভোটারদের স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ বাড়ায়। এই শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো সুইডেনকে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশে এ ধরনের একটি কাঠামো প্রয়োগ করা গেলে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে যেতে পারে এবং নতুন এক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সূচনা হতে পারে। কেবল আইন সংস্কার নয়, বরং প্রথমে আমাদের নিজেদের নৈতিকতার সংস্কার করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করতে হবে। প্রশ্ন উঠবে, সংসদ সদস্যরা টাকা দিয়ে টিকিট কিনবেন, নাকি জনগণের সৎ ভোটে নির্বাচিত হবেন? কী করবেন, কেন করবেন, কার জন্য করবেন—এসব প্রশ্নের সঠিক এবং সদুত্তর খুঁজে বের করা জরুরি।
আজ দেশের মানুষ দেখছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলের নিজেদের অভ্যন্তরে সংস্কারের কোনো চেষ্টা নেই। তারা যদি নিজেদের সংস্কার করতে না পারে, তাহলে সংসদে প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধিত্ব আসবে কীভাবে? সংসদ তো কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই পরিবারের লোকেরা দেশ চালাবে। ৫৩ বছর ধরে একই নেতারা তৃণমূল পর্যায়ে শক্তি ধরে রেখেছেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ‘দানবে’ পরিণত হয়েছেন। যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের পরিবর্তন নিশ্চিত করা যায়, দুর্নীতি এবং অপব্যবহার বহুলাংশে কমে আসবে।
সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া, যেখানে এমপি-মন্ত্রীর সন্তানেরা শুধু পারিবারিক পরিচয়ের কারণে মনোনীত হয়, তা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে, যাতে নতুন উদ্যম এবং শক্তি দেশের উন্নয়নে কাজে লাগে। ড. ইউনূস ঠিকই বলছেন, ‘যারা ৫৩ বছরেও কিছু করতে পারেনি, তাদের কাছ থেকে আর কিছু আশা করা যায় না।’ আমাদের তরুণদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে, যারা নতুন চিন্তাধারা নিয়ে কাজ করবে।
তা না হলে যদি দুটি বড় দলের মনোনীত প্রার্থীরাই অতীতের মতো গডফাদারের আশীর্বাদে ক্ষমতায় আসতে থাকে, তবে দেশটি সেই পুরোনো ‘ধর-মারো-খাও’ রাজনীতির বলয়ে আটকে থাকবে। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলগুলো যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিকে মনোনয়ন দেয় এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে পারে, তবে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক দ্রুত হবে। পাশাপাশি বড় দলগুলোর বাইরেও নতুন দল এবং নতুন নেতৃত্বের উত্থান জরুরি। রাজনীতিতে সব ধরনের গডফাদারদের প্রভাব কমাতেই হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এই নিশ্চয়তা পরবর্তী নির্বাচনে আনা অত্যন্ত জরুরি।