‘রিকশাগার্ল’ টিমকে ধন্যবাদ, জীবনযুদ্ধে সাহস জোগানোর জন্য

রিকশা গার্ল সিনেমার সেট থেকে তোলা
সংগৃহীত

ছুটির দিনে কিংস কলেজে গিয়েছিলাম কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে। ফেরার সময় হোয়াইটচ্যাপেল গিয়ে টের পেলাম লন্ডন–বাংলা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসেছে অমিতাভ রেজার ‘রিকশাগার্ল’। দেখে ফেললাম। এটা কোনো রিভিউ নয়, একজন সাধারণ চলচ্চিত্র দর্শকের অনুভূতির সমষ্টিমাত্র।

আমরা যারা প্রবাসী, সীমিত সময়ের জন্য বিদেশে আসি জীবনের যুদ্ধে একটু এগিয়ে যেতে তাদের জন্য এ চলচ্চিত্রে একটি দৃশ্যকল্প আছে। সেটা পরিচালক মূল চরিত্র নাঈমা কীভাবে জীবনযুদ্ধে ঢাকায় এসেই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা বাসায় আবদ্ধ হয়ে যায়, তার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। সে যে আবদ্ধ হয়ে গেছে এবং সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়াটা জরুরি, তা বুঝতে পারে ব্যালকনিতে আটকে পড়া একটা পাখির মুক্ত হওয়ার নিদারুণ চেষ্টা দেখে! পাখিটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেই দেখে, তার হাত পাখির কাছাকাছি যাওয়ার মতো লম্বাও নয়! মানে, চাইলেও সব সময় সাহায্য করা যায় না! মানুষের জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে এমন রূপক লাগে প্রতিনিয়ত। গল্পের সেই রূপকে সাড়া দিয়ে নাঈমা মুক্তির পথ পেয়েছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের অবস্থা হয় পাখিটির মতো, আটকে পড়া জীবন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়!

আমি আগে এক ভাইয়ের সঙ্গে থাকতাম পূর্ব লন্ডনে। তাঁর চলচ্চিত্র দেখার স্বাদ এবং আমার স্বাদ পুরোই আলাদা। আমি বিখ্যাত মানুষের জীবন নিয়ে করা চলচ্চিত্র দেখতে খুবই পছন্দ করি। তাঁকে কয়েকটা নাম বলে যখন বলেছিলাম, তারা সবাই ছিল এক একজন সুপারহিরো, তখন উনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, দেশের বাইরে আমরা যারা নিজেদের থাকার জায়গা বা খাবার এর মেনু সংকুচিত করে প্রতিনিয়ত রেমিট্যান্স পাঠাই, সেই আমরা সবাই সুপারহিরো! সেদিন হেসেছিলাম, কিন্তু আজ বুঝি আমরা সুপারহিরো না হলেও অন্তত হিরো। তেমনই এক হিরোর (নাঈমা) সংগ্রাম নিয়েই ‘রিকশাগার্ল’।

এ চলচ্চিত্রে গল্পটি ছিল জীবন্ত। কেউ যে হুট করে হিরো হয় না, সেটাই দেখানো হয়েছে। সেই পর্যন্ত যেতে পারিপার্শ্বিক অবস্থার যে বড় ভূমিকা থাকে, তা যথেষ্ট মুনশিয়ানার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে। আমার যা ভালো লেগেছে, তা হলো কাহিনি একটি পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়ে গেছে। দুটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রথমত, গল্পে নাঈমা একসময় পুরোদস্তুর রিকশা চালায়। কিন্তু শুরুর দিকে তার বাবা, যে একজন রিকশাচালক, অসুস্থ হলে সে তাকে রিকশাসহ বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু প্যাডেল তখনো মারেনি, বরং রিকশাটি হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে। তখনই প্যাডেল মেরেছে, যখন জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার আগে নয়। দ্বিতীয়ত, নাঈমার সহজাত প্রতিভা ছিল দৃশ্য আঁকাআঁকি করার। নতুন নতুন যখন রিকশা চালায়, তখন সে রাস্তা চেনে না, ফলে সেভাবে ভাড়া পায় না। ফাঁকা সময় পেয়ে সে রাস্তায় চক দিয়ে কী জানি আঁকে। পরে দেখা যায়, সেগুলো ঢাকার ম্যাপ। সহজাত প্রতিভা জীবনযুদ্ধে কাজে লাগে নানাভাবে। সেটা ফুটিয়ে তুলতে এখানে কাল্পনিক দৃশ্যের পরিবর্তে বাস্তবিক ম্যাপ দেখানোটা পরিমিতিবোধের প্রকাশ।

এবার আসি প্রিয় দৃশ্যের কথায়। জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়টা ঠিক কখন? সেটা হঠাৎ করেই আসে না। এর জন্য নীরবে–নিভৃতে প্রস্তুতি নিতে হয়। নাঈমার সেই রকম প্রস্তুতি ছিল। তার নিজের জগৎ ছিল বাবার ভাঙা ঘরের চাল। সেটা তার কল্পিত দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার ক্যানভাস। আবার এই ক্যানভাস বা চালের ফুটো দিয়েই দেখা যায় নিচে ঘরের মধ্যে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে মা-মেয়ের অসহায় আকুতির নির্মম বাস্তবতা। এ দুই রকম পরিস্থিতি মানুষকে জীবনযুদ্ধে নামতে সাহস জোগায়!

পরিশেষে ‘রিকশাগার্ল’ টিমকে ধন্যবাদ আমাদের জীবনযুদ্ধে সাহস জোগানোর জন্য।

লেখক: মো. মাহবুব হাসান, পিএইচডি গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য।