প্রবীণের দাপটে নবীনের চাপ
‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে তরুণদের এগিয়ে যেতে বলেছেন। এখনো ‘তরুণ’ শব্দের সংজ্ঞা নিয়েই অনেকে দ্বিধায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। কারণ, কে তরুণ আর কে তরুণ নয়, সেটাই আমরা সঠিকভাবে এখনো জানতে পারিনি। অথচ সেই ১৩২১ বঙ্গাব্দের ১৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ, দেখে না যে বান ডেকেছে, জোয়ারজলে উঠছে প্রবল ঢেউ।’
ভারতে বিজেপি সমর্থকদের কাছে তরুণ নেতা মোদির বয়স ৭২ বছর। এভাবে জো বাইডেনকে তরুণ সাজাতে কাজী নজরুলের অমর বাণী থেকে বলি ‘যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না’, তিনিও তরুণ। জাস্টিন ট্রুডো কানাডার লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে ২০১৫ সালে দেশটির ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তিনিও ৫০ বছরের তরুণ। ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন ৩৬ বছরের তরুণী। তরুণ-তরুণীর সংজ্ঞা যা-ই হোক না কেন, আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে হবে, এ দায়িত্ব আমাদের সবার।
পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যেসব জীবজন্তু সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে মনুষ্য জাতিই একমাত্র প্রাণী, যার শিক্ষার শেষ নেই। কারণ, আমি একটি বিষয় বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে লক্ষ করে আসছি বহু বছর ধরে। আমি থাকি সুইডেনে, প্রতিবছর মে মাসের দিকে সুদূর কানাডা থেকে লাখ লাখ বুনোহাঁস ম্যালারেনে (সুইডেনের বাল্টিক সাগরের উপশাখাগুলো প্রকৃতির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে, যাকে আমরা বলি ম্যালারেন) এসে হাজির হয়, ডিম থেকে শুরু করে বাচ্চা দেওয়া এবং ওড়ার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত হাঁসগুলো সুইডেনেই থাকে। ঠিক অক্টোবর এলেই তারা উড়ে সেই কানাড়ায় ফিরে যায়। কেন তারা সুইডেনে আসে? মূলত এখানে পাখিদের ভয়ভীতি দেখানো নিষেধ, পাখি শিকার করা নিষেধ, সর্বোপরি সুইডিশ জাতি সব সময় সব জীবজন্তুর প্রতি উদারতার পরিচয় দিয়ে থাকে।
আমি অবাক হয়েছি, সাত সমুদ্র আর তেরো নদী পার করে প্রতিবছর নতুন–পুরোনো সবাই মিলে ঠিক সময়ে সুইডেনে আসে, আবার ফিরে যায়। এসব হাঁস কোনো রকম জিপিএস বা প্রশিক্ষণ ছাড়া, যা দক্ষ বিমানচালকদের পক্ষে সম্ভব বহু বছরের প্রশিক্ষণের পর। যেমন মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ, জিপিএসসহ সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার পরই তাঁরা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারে। মানে কী দাঁড়াল? এ ক্ষেত্রে পরিষ্কার যে পশু–পক্ষী শুরু থেকেই যা দরকার তাদের জীবন পরিচালনা করার জন্য, সেটা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। আমরা মানুষ জাতিই একমাত্র প্রাণী, যারা পৃথিবীতে জন্মের পর জেনে এবং শিখে জীবন পরিচালনা করতে পারি। আমাদের শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নেই। ফলে আরও পরিষ্কার যে জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জানা এবং শেখাই আমাদের তরুণত্ব। তার মানে আমাদের মধ্যে সে–ই তরুণ, যে জানতে এবং শিখতে চায়। বয়স শুধু একটি সংখ্যা যার গুরুত্ব প্রকাশ পায় জ্ঞানের ভারত্বের ওপর।
তবে হ্যাঁ, কৈশোরে হৃদয়ে লাগে আগুন, যৌবনে হৃদয়ে অবিরাম ভালোবাসার ফাগুন এবং বার্ধক্যে হয়তো আগুন আগের মতো জ্বলে না, হয়তো ফাগুন শেষ হয়ে যায় কিন্তু বসন্তবাহারে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে। আর এ জন্যই বার্ধক্যে আমাদের ভালোবাসার সেতু তৈরি করতে হবে। তাহলে আসা–যাওয়ার পথটি সুন্দর মধুময় হবে। আমাদের কর্মের ফলাফলই সেই সেতু যে সেতু পার হবে নতুন প্রজন্ম দৃঢ়তার সঙ্গে। আমাদের তৈরি সেতু যেন ভেঙে না যায় বা নতুন প্রজন্ম যেন লজ্জা না পায় সে সেতু পার হতে। আমরা যেন ন্যায়নীতি, নিষ্ঠা এবং মায়া–মমতায় ভরা সেতু তৈরি করে যেতে পারি, সেদিকে যেন আমাদের খেয়াল থাকে। প্রবীণের দাপটে যেন নবীনের ওপর চাপ না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তবেই না হবে জন্মের সার্থকতা এবং তখনই আকাঙ্ক্ষা জাগবে হৃদয়ে বেঁচে থাকার, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই।’
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।