জীবনের রং–১

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দিন দিন পুকুরটা ছোট হয়ে আসছে। পাড়গুলোও ভেঙে পড়ছে। পাড়ে থাকা দুটি গাছ ঝড়ে পড়ে গেছে। শিমুলগাছটাও কিছুটা হেলে আছে। এত বড় গাছ! যদি পড়ে, তাহলে রেহাই নেই। পুকুরপাড়ের ছোট গর্ত থেকে একটি মাছরাঙা বেরিয়ে এল। পড়ে থাকা গাছের একটা ডালে মাছরাঙাটি বসল। মাঝবয়সী দিলু মিয়া মাছরাঙার দিকে তাকিয়ে আছে। এক নজরে মাছরাঙার নড়াচড়া দেখছে দিলু মিয়া। পুকুরের কথা আর মাথায় নেই। পুকুর ছোট হয়ে যাচ্ছে নাকি বড় হয়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে আর কিছুই ভাবছেন না তিনি। হঠাৎ দেখে মাছরাঙা উধাও।
‘হায় হায় পাখিটা গেল কই।’

মনে মনে বলে আর এদিক-সেদিক তাকায়। কিছুটা সময় পড়ে দেখে মাছরাঙা আগের জায়গাতেই বসে আছে। দিলু মিয়া চমকে যায়।

‘এটা কী হলো! একটু আগে দেখলাম পাখিটা এখানেই বসে আছে। এরপর দেখি নেই। এখন দেখি একই জায়গায় বসে আছে। তার মানে কী পাখিটা এখানেই ছিল! আমার দৃষ্টিশক্তি কি কমে যাচ্ছে, নাকি স্মৃতিশক্তি...!’
দিলু মিয়া মাছরাঙা পাখিটি নিয়ে চিন্তিত।

‘পাখিটি আমার সঙ্গে ছলনা করছে না তো। না, তা হবে কেন। আমি যে এখানে আছি, সেটা তো আর পাখিটি জানে না।’

দিলু মিয়া পাখিটির দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে তাঁর মেয়ে দিয়ামণি এসে বলল,
‘বাবা কী করছ?’
‘আরে দিয়া মা আমার, তুই এসেছিস, ভালো করেছিস। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে একটু হেল্প কর তো।’

দিয়ামণি বাবার কথার কিছু না বুঝলেও আস্তে করে বলে,
‘ঠিক আছে, বাবা। আমাকে কী করতে হবে বলো?’
‘আচ্ছা দেখ তো, এখানে যে পাখিটা বসে আছে...!’
‘কই পাখি?’
‘এখানে তো ছিল। এই যে জামগাছটা পড়ে আছে। এর ডালেই তো ছিল।’
‘বাবা, তোমার না মাথাটা গেছে। এখানে তো কোনো পাখিই নেই।’

দিলু মিয়া ভাবে, ‘সত্যিই কি কোনো পাখি নেই!’
আসলে দিলু মিয়া যখন মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়, ঠিক সেই সময় মাছরাঙা উড়াল দেয়। দিলু মিয়া কোনো কিছু ভুল দেখেনি, যা দেখেছে সবই সঠিক দেখেছে। মাছরাঙা এসেও ছিল। মাঝে মাছরাঙা একটি মাছ ধরতে গিয়েছিল। সে সময়টাতে দিলু মিয়া মাছরাঙা পাখিটিকে দেখেনি। মাছরাঙা আবার ডালে বসেছিল।

দিলু মিয়ার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে রিয়ামণি, উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মেজ মেয়ে দিয়ামণি, নবম শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট মেয়ের নাম খুশিমণি। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া ছাত্রী।

খুশিমণির জন্মের আগে দিলু মিয়ার আশা ছিল, একটা ছেলেসন্তানের, যদিও তার মেয়ে হওয়াতে কোনো কষ্ট নেই। সে জানে, ওপরওয়ালা যা করেন, ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু তার মনে অনেক কষ্ট। তার কারণ, খুশিমণির জন্মের পর দিলুর স্ত্রী দিলারা বেগম শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। দিলারাকে দিলু খুব বেশি ভালোবাসত। বিয়ের আগে তাকে পাওয়ার জন্য কত কিছু করেছে সে।

একদিন দিলারা স্কুলে যাচ্ছে সহপাঠীদের সঙ্গে। দিলু রাস্তার সামনে গোলাপ ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিলু দিলারাকে ভালোবাসে, এটা দিলারার সহপাঠীরাও জানে। দিলুর হাতে ফুল দেখে সহপাঠীরা হাসাহাসি করে। তখন দিলারা নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বান্ধবীদের হাসি দেখে দিলারা খুব বেশি রেগে যায়। দিলু মিয়া রাস্তার মাঝে এসে দিলারাকে আটকায়। দিলারা তখন চোখ বড় বড় করে বলে,
‘কী চাই?’
‘এটা তোমার জন্য।’

‘সামনে থেকে সরে যান বলছি।’
‘এই গোলাপটা নিয়ে নাও, তারপর যাব।’
বান্ধবীদের একজন বলল,
‘দিলু ভাই, আপনাকে দিলারা পছন্দ করে না, এটা জেনেও আপনি ওকে ফুল দিতে এসেছেন।’
‘তাতে কী। আমি তো ওকে পছন্দ করি। আমার পছন্দের মানুষকে কী একটা ফুল দিতে পারি না?’
আরেক বান্ধবী বলল, ‘এই দেখ, সময় নেই। তোরা যাবে কিনা বল, আমি চলে যাচ্ছি।’
অমনি দিলারা বলল, ‘চল সবাই, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।’
‘প্লিজ, ফুলটা নিয়ে যাও।’

দিলুর কথা শুনে দিলারা ফুলটি নিয়ে ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুলে চলে যায়। দিলু মিয়া মন খারাপ করে পেছন থেকে দিলারার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে।

আরেক দিন, বর্ষাকালের কথা। দিলারা ছোট বোন আমেনার সঙ্গে বন্যার পানিতে ছোট নৌকা নিয়ে বের হয়। বিলের মধ্যে যেতে থাকে দিলারা। দিলারা নিজেই নৌকা বাইতে পারে। এই দৃশ্য দিলু মিয়া দেখে, সেও আরেকটা নৌকা নিয়ে দিলারার কাছে যায়। দিলারার ছোট বোন বলে,
‘দিলু ভাই, আফনে এহানে।’

‘হ, আমি আসছি তোমাদের হেল্প করতে।’
‘তাইলে আমরারে কয়ডা শাপলা তোইল্লা দেন।’

দিলু মিয়া আমেনার কথা শুনে শাপলা তুলে দিচ্ছে। আর মাঝেমধ্যে দিলারাকে দেখছে। মেয়েটি কত সুন্দর। কত সুন্দর মুখ দিলারার। সূর্যের আলো এসে দিলারার মুখে পড়ছে। দিলারার ওড়না বুকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে পেটের মাঝবরাবর বাঁধা ছিল। দিলুকে দেখে ওড়না খুলে একেবারে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তবু ওড়নার ফাঁক দিয়ে দিলারার মুখটা চুপিসারে দেখছে দিলু মিয়া। অন্য সময়ে দিলারা মন খারাপ করত দিলুকে দেখে। আজকের বিষয়টা অন্য রকম।

আমেনা বলে উঠল, ‘কী বেপার দিলু ভাই, আপার দিকে বারবার চাইয়া কী দেহেন। বিষয়ডা কী?’
দিলু হেসে দিল। দিলারা হকচকিয়ে বলল, ‘আমেনা দুষ্টুমি করবে না বলে দিচ্ছি। চল বাড়িতে যাইতে অইবো।’

আমেনা বলল, ‘না, আমি যামু না। আমার ওই... যে বড় শাপলাডা দেখা যায়, ঐডা লাগব।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, আমি তুলে দিচ্ছি।’

দিলু মিয়া শাপলা তুলে আনে। আমেনাকে দিতে গিয়ে দেখে দিলারার পায়ের কাছে একটা সাপ। আমেনা দেখে চিৎকার দেয়, ‘আপু, সাপ।’ দিলারা সাপ দেখে সরতে গিয়ে পানিতে পড়ে যায়। বিলের মধ্যে পানির গভীরতা খুব বেশি। দিলারা সাঁতার জানা মেয়ে। আমেনা কান্না করছে। দিলু অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে,
‘এটা কী হলো!’

দিলারা পানিতে সাঁতার কাটছে। নৌকার কাছে চলে এসেছে। নৌকাতে উঠতে চেষ্টা করছে। কিন্তু উঠতে পারছে না। আমেনা দিলারার হাত ধরে টান দিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজও হচ্ছে না। দিলু চলে আসে কাছে। দিলু দিলারার হাত শক্ত করে ধরে একটানে নৌকার ওপরে তোলে। দিলারা এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে। দেখছে সাপটা আছে কি না।
দিলু বলে, ‘আরে, সাপ তো অনেক আগেই চলে গেছে।’
দিলারা বলে, ‘আপনাকে কে বলছে এখানে আসতে?’
‘কেন, তুমি না বললে বিকেলে নৌকা দৌড়াবে। আমি যেন আসি।’
আমেনা বলে, ‘ও, এই কথা।’

‘এই তুই চুপ কর। এই যে, দিলু ভাই আপনি আর আমার কাছে আসবেন না বলে দিচ্ছি।’
‘আহারে দুনিয়া, তোর ভেতরে এমন পাষাণ মানুষও আছে। যারে হাত ধইরা টাইনা তুলে জীবন বাঁচাইলাম, হে কই আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব, ধন্যবাদ জানাইব, সেটা না করে হে দেখি উল্টা ধমক দেয়।’

দিলারা নৌকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। দিলু মিয়া পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘আমারে মরণ ছাড়া তোমার কাছ থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
আমেনা হাসছে। দিলারা আর পেছনে তাকাল না। বিষয়টা দিলারার মা জানতে পারে। দিলারাকে অনেক বকাঝকা করে। আমেনাকে একটা থাপ্পড় মারে। আমেনা কাঁদছে। দিলারা চুপ করে ঘরে বসে আছে। মা বলে,
‘অত বড় ডাঙ্গর মাইয়া নৌকা নিয়ে বিলের মাঝে যাইতো পারে। হে বড় অইছে না। বাপ মরা মাইয়া। আমার জীবনডারে মাটি করে দিচ্ছে।’

খুব বেশি শব্দ করে এসব কথা বলছে দিলারার মা। আশপাশে কয়েকজন নারী ছুটে আসে। এর মধ্যে একজন বলে,
‘হ রে বোইন, ঠিকই কইছত। আমি দেইখ্যা আইছি, হেরা বাড়ির দিলুর সঙ্গে তোর মাইয়া রংডং করতাছে। বিলের মইধ্যে পানিতে ডলাডলি। ছি ছি ছি...’
এই কথা শুনে দিলারার মা বিলাপ শুরু করে দিছে।

‘অহন আমার কী অইবো গো..। ও খোদা, খোদা গো..। এই বাপ মরা মাইয়ার তো আর বিয়া অইবো না গো...। ও নডি বেডিরে লইয়া অহন আমি কই যাইয়াম গো...। খোদা, তুমি আমারে উঠাইয়া লইয়া যাও গো...।’

দিলারার মা এমনই। কোনো কিছু হলে বিলাপ করা শুরু করত।
দিলারা দশম শ্রেণিতে উঠেছে। দিলু মিয়া বিষয়টা শুনে দিলারার জন্য একটা স্বর্ণের হার কিনে আনে। স্কুলে যাওয়ার পথে দিলারাকে দিতে গেলে দিলারা হাতজোড় করে বলে,
‘প্লিজ দিলু ভাই, আমি আপনাকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, আপনি আর আমার কাছে আসবেন না। আপনার জন্য আমার অনেক কথা শুনতে হয়।’
‘আমি কি সত্যি তোমাকে বিরক্ত করি, দিলারা।’

দিলারা চুপ। দিলু মিয়া বলল,
‘আচ্ছা এটা পড়ে দেখা যাবে। হারটা নাও।’
‘না, আমি নিতে পারব না।’
‘প্লিজ, এটা নাও।’
‘আমি কেন নেব এই হার?’
‘তুমি ক্লাস টেনে উঠেছ বলে এই হার তোমাকে উপহার দিলাম।’
‘আপনি আমার কে, আমি আপনার উপহার নেব?’
‘তুমি জানো না, আমি তোমার কে?’
‘না।’
'আচ্ছা বাদ দাও এসব কথা। এখন হারটা নাও।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দিলারা দেখে দিলুর চোখে জল টলমল করছে। রাগে হয়তো কিছু একটা করে বসতে পারে। তাই কোনো কথা না বলে হারটা নিয়ে চলে যায়। দিলু মিয়ার মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে দিলারার দিকে তাকিয়ে রইল।

তারপর খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে দিলারাকে তার মা অনেক বকাঝকা করে। সেটা শুধু দিলু মিয়ার জন্য। দিলারার যেন আর সমস্যা না হয়, যার জন্য  দিলু মিয়া এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সে চায় না, ওর জন্য দিলারা কষ্ট পাক। ঢাকাতে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে সে। কিন্তু দিলারার কথা বেশ মনে পড়ে। তাই সে কয়েক মাস চাকরি করার পর আবার গ্রামে ফিরে আসে।

আগের মতো করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দিলু মিয়া। দিলারা একা একা হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ দূর থেকে দিলু মিয়াকে দেখতে পায়। দিলারা অবাক হয়।
‘এত দিন পরে সে কোথায় থেকে এল।’
এমনটা ভাবতে ভাবতে হাঁটছে সে। দিলুর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আজ আর দিলু কিছু বলছে না। দিলারা একটু সামনে গিয়ে, আবার পেছনে ফিরে আসে। দিলুর ভেতরটা নড়েচড়ে ওঠে। সে এটাই চাইছিল।

দিলারা বলে, ‘কেমন আছেন?’
জীবনে এই প্রথম দিলারা নিজে থেকে দিলুর সঙ্গে কথা বলছে। দিলুর যে কী ভালো লাগছে। ভেতরে প্রশান্তির বাতাস বইছে। কেন জানি সে কথা বলতে পারছে না। হঠাৎ কেন তার এমন লাগছে, সে বুঝতে পারছে না।

‘কী কথা বলবেন না আমার সঙ্গে?’
দিলু ওপরে দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইচ্ছা করছে দিলারাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সেটা কী সম্ভব!
‘আপনাকে আমি অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি।’
‘কেন কেন... খুঁজেছ?’
‘আপনার হারটা ফেরত দেওয়ার জন্য।’

হার ফেরতের কথা শুনে দিলুর মুখটা মলিন হয়ে যায়। ‘তাহলে কি সে আমাকে পছন্দ করে না। ভালোবাসে না। কিন্তু কেন সে আমাকে অপছন্দ করে?’
‘আগামীকাল ঠিক এ টাইমে এখানে থাকবেন হারটা নেওয়ার জন্য।’
বলেই দিলারা হাঁটা শুরু করে। দিলারাকে ডাক দেয় দিলু। বলে,
‘আমি কি কিছুটা সময় তোমার সঙ্গে হাঁটতে পারি, দিলারা?’
‘না।’
‘না কেন? হাঁটলে সমস্যা কোথায়?’
‘সমস্যা আছে।’
‘কিন্তু আমার যে কিছু কথা বলার ছিল তোমার সঙ্গে।’
‘তাহলে এখানেই বলুন।’
‘আমি যে হারটা তোমাকে দিয়েছি, সেটা কি একবারও পরোনি।’
‘না।’
‘তাহলে নিলে কেন?’
‘কারণ সেদিন আপনি অনেক বেশি রেগে ছিলেন। যদি হারটা না নিই, তাহলে আপনি হয়তো অন্য কিছু করতে চাইতেন। এককথায়, ভয়ে হারটা নিয়েছিলাম।’
‘আমি যে তোমাকে ভালোবাসি, সে কি তুমি বোঝো না?’
‘না।’

‘তোমার জন্য যে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি, সেটা তুমি বুঝতে পার না।’
‘না।’

‘তোমাকে যদি আমি না পাই, তাহলে আমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব।’
দিলারা চুপ।

‘কিছু বল দিলারা। প্লিজ, কিছু বল।’

দিলারা কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। দিলুও সঙ্গে হাঁটছে।
‘দিলারা, তুমি দেখ, পৃথিবীটা কত সুন্দর। কত সুন্দর পৃথিবীর চারপাশ। এসব সৌন্দর্য মলিন হয়ে যেত, যদি পৃথিবীতে ভালোবাসা না থাকত। ভালোবাসা না থাকলে সূর্য আলো হারাতে, পৃথিবী আলেয়ায় ঢেকে যেত। নদীর ঢেউ থেমে যেত।’

দিলারা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘আপনি কি বাংলা সিনেমার আলমগীর–শাবানার ডায়ালগ দিচ্ছেন?’
দিলু দিলারার পথ আটকে বলে, ‘তুমি আমার সঙ্গে মজা করছ।’
‘আমার সময় নেই। পথ ছাড়ুন বলছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘তাহলে বল, কালকে আমার দেওয়া হারটা গলায় পরে আসবে।’
দিলারা কোনো কথা না বলে হেঁটে চলে যাচ্ছে।

দিলু দাঁড়িয়ে পেছন থেকে বলছে, ‘যদি হার গলায় না পরে আস, তাহলে আগামীকালই হবে তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।’

দিলুর ঘরে সৎমা। বড় একটা ভাই দুবাই প্রবাসী। ছোট একটা বোন মাধ্যমিকে পড়ছে। সামনে এসএসসি দেবে। বাবা অসুস্থ। মায়ের সঙ্গে খুব একটা মিল নেই দিলুর। রাতের খাবারের সময় মা বলল,
‘দিলু ঢাকা গেলে। শুনলাম চাকরিও পেয়েছিস। কই, টাকাপয়সা তো কিছুই দিলে না।’
দিলু বলল, ‘কেন, ভাইয়া টাকা দেয় নাই।’

‘তোর ভাই তো বেশি কিছু দেয় না। তোর বোনটার লেখাপড়ার খরচ, তোর বাবার ঔষধের খরচ, সংসারের খরচ সব মিলিয়ে পুরোপুরি হয় না। বাড়ির কাজের লোকটাকে দিতে হয় চার হাজার টাকা।’
‘হাবিবের বেতন না তিন হাজার পাঁচ শ ছিল। পাঁচ শ বাড়ল কীভাবে?’
‘আমি পাঁচ শ বাড়িয়ে দিয়েছি। হাবিবের নাকি চলতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া হাবিবের বউ অসুস্থ।’

‘আচ্ছা মা, আমাদের সংসারে কজন লোক আছে বল তো। আমাদের কি কাজের লোক লাগে।’
‘অবশ্যই লাগে। তোর বাবাকে নিয়ে প্রায়ই মেডিকেল যেতে হয়। হাবিব আছে বলে, কাজগুলো সহজভাবে করা যায়।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে, সকালে কিছু টাকা তোমাকে দেবনে।’
হাবিবকে নিয়ে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করে দিলুর ছোট বোন রেহেনা। দিলু শুনে অনেক রেগে যায়। তারপর রেহেনা বলে,
‘দিলু ভাই, এখন রাগ করা যাবে না। আগে বাবা সুস্থ হোক, তারপর একটা কিছু করা যাবে।’

দিলু মিয়া পকেট থেকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট বের করে রেহেনাকে দেয়।
রেহেনা বলে,
‘আমি টাকা দিয়ে কী করব।’

‘কেন, খরচ করবি। তা ছাড়া লেখাপড়ার অনেক খরচ আছে।’
‘ও নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। নিলু ভাই প্রতি মাসে আমাকে হাত খরচ দেয়।’
‘কত দেয়?’
‘পাঁচ শ টাকা করে দেয়।’

‘এখন থেকে আমিও তোকে পাঁচ শ করে দেব। বান্ধবীদের সঙ্গে খরচ করবে। ভালো এবং সুন্দর একটা ছেলে দেখে প্রেম করবে। দারুণ হবে না।’
‘ভাইয়া, তুমি না...। আচ্ছা বাদ দাও আমার কথা। দিলারা ভাবির কী খবর, এটা বল।’
দিলু রেহেনাকে একটা ধমক দিয়ে বের করে দেয় রুম থেকে। খাটের ওপর শুয়ে দিলারার কথা ভাবছে।

‘কাল ওর সঙ্গে আবার দেখা হবে। আচ্ছা, ও কি হারটা পরে আসবে। আমার কেন জানি মনে হয় দিলারাও আমাকে ভালোবাসে। ওর প্রতিটা না শব্দতে হ্যাঁ লুকায়িত। তা ছাড়া তার চোখে আমি ভালোবাসা দেখেছি।’

নিজে নিজে দিলু একটা প্রশ্ন তৈরি করে। সেটা হলো, দিলারা যদি কাল হারটা গলায় পরে আসে, তাহলে প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে যাবে, বুঝে নিতে হবে। কবে যে রাতের অবসান হবে।

দিলু মিয়া চিন্তা করল, এখন আর সে ঘুমাবে না। সে চলে গেল দিলারার বাড়িতে। শুধু এইটুকু জানাতে, কাল যেন হারটা পরে আসে। দিলারার বাড়িতে প্রবেশ করতে দুটি কুকুর দিলুকে তাড়া করে। দিলু কুকুরের কাছ থেকে বাঁচতে দৌড় দেয়। কিন্তু কুকুরের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি সে। দুটি কুকুর মিলে দিলুকে কামড়ায়।

হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল। দিলু চেষ্টা করছে দৌড় দিতে, কিন্তু সে পারছে না। কুকুর দুটি দিলুকে আঁকড়ে ধরেছে। ক্রমেই দিলু নিস্তেজ হয়ে যায়। কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। কুকুর কামড়িয়ে চলেছে। মানুষের মাংস এত মজা কুকুরে কাছে।
কুকুর দিলু মিয়াকে এমনভাবে কামড়ায়, বাঁচা দায়। পায়ে, কোমরে, পেটে এমনকি মুখেও কামড়ে রক্তাক্ত করেছে। অবশ্যই নাড়িভুঁড়িও বের করে ফেলত। এরই মধ্যে এলাকার লোকজন এসে কুকুর হাত থেকে দিলু মিয়াকে রক্ষা করে।

দিলু এখন হাসপাতালে ভর্তি। দুটি কুকুর মিলে ১৩টি কামড় দিয়েছে। এই তথ্য চিকিৎসক জানিয়েছেন। চিকিৎসকের কথা মতে, ‘এই ধরনের পেশেন্টকে বাঁচানো অনেক কঠিন। জলাতঙ্কের আশঙ্কা খুব বেশি। যদি রোগটি হয়ে যায়, তাহলে রোগীকে বাঁচানো দায়। কারণ, এই রোগের চিকিৎসা নেই বললেই চলে।’
ছোট বোন রেহেনা দৌড়াদৌড়ি করছে। নিলু মিয়া বিদেশ থেকে বলছে,
‘যত টাকা লাগবে, আমি দেব। আমার ভাই যেন বাঁচে।’

চারপাশের কী ধরনের আওয়াজ হচ্ছে। এখনো সবকিছু পরিষ্কার নয়। একবার মনে হচ্ছে, ছোট বোন রেহেনা কাঁদছে। আরেকবার মনে হচ্ছে, মা বকাঝকা করছে। কানের মধ্যে ঝিম... ধরনের একটা শব্দ বাজতেছে। আচ্ছা আমার পাশে কি কেউ আছে? হয়তো আছে। হয়তো নেই। আমাকে কোন কুকুরে কামড় দিছে। কালো কুকুর, নাকি লাল। আচ্ছা কুকুর এ তো নিষ্ঠুর হয় নাকি। আমার কী অপরাধ ছিল। আমার মতো সুস্থ একজন মানুষকে দুটি কুকুর কামড়ে মেরে ফেলতে চাইল। আমাকে কেন কামড়াল কুকুর?
সাগরের পানির শব্দের মতো একটা শব্দ দিলুকে ধাক্কা দিচ্ছে।

পুরো শরীর ব্যথায় জর্জরিত। কোনো কিছুই সঠিকভাবে মাথায় আসছে না। তবে কি আমি মারা যাচ্ছি। দিলুর মস্তিষ্ক এমনটা ভাবছে।
তিন দিন পরও চিকিৎসক ভালো কিছু বলতে পারছে না। শুধু অপেক্ষা করার কথা বলছে।

দিলারার মা চুলে ধরে গালে থাপ্পড় দিয়ে বলে, ‘ওই নডি ছেরি, ওই ছেড়ার লগে তোর কী সম্পর্ক?’
দিলারার চুলের টানে ব্যাথা পাচ্ছে। মায়ের কথার জবাব না দিয়ে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে। মা চোখের জল দেখে আরও বেশি দিলারাকে মারে। আর বকাঝকা করে।
দিলারার বান্ধবী নিশি এসে বলে,
‘খবর শুনেছিস।’
দিলারা বলে, ‘কী খবর?’
‘দিলু ভাই নাকি মারা যাবে। ডাক্তার বলছে, তাকে বাঁচানো অসম্ভব।’

‘এত খারাপ অবস্থা!’
‘আচ্ছা দিলারা, দিলু ভাই নাকি তোর সঙ্গে রাতে দেখা করতে আসছিল?’
‘আমি জানি না। তবে আমাদের পাশের বাড়ির কুকুরে দিলু ভাইকে আক্রমণ করছে।’
‘দিলারা চল, একবার দিলু ভাইকে দেখে আসি।’

‘মাথা খারাপ। আমি যদি মেডিকেল যাই, তাহলে আমার মা দা দিয়ে আমাকে কেটে টুকরা টুকরা করবে।’
‘আরে যা, ভালোবাসার মানুষকে দেখতে গিয়ে না হয় টুকরা টুকরা হবি।’
‘কে কাকে ভালোবাসে, নিশি?’
‘হয়ছে, আর ভাব ধরতে হবে না। তুই যদি দিলু ভাইয়ের সামনে যাস। আর তোকে যদি একবার সে দেখতে পায়। তাহলে আমি নিশ্চিত, দিলু ভাই মরবে না। কারণ, এই পৃথিবীতে ভালোবাসার চেয়ে বড় ঔষধ আর কিছু নেই।’

হাসপাতালে সব সময় মানুষ থাকে। দিলু মিয়া চোখ খোলে, দেখে সবকিছু ঝাপসা। কোনো কিছু পরিপূর্ণভাবে দেখতে পারছে না। ডাক্তার এসে কথা বলল, দিলু মিয়া সব কথা ঠিকঠাকভাবে বুঝতে পারল না। ‘পৃথিবী কী সত্যি সত্যি দিলুকে বিদায় জানাবে,’ সেটাই দিলু ভাবছে।

মেডিকেলে কত দিন হলো দিলু জানে না। আরও কত দিন থাকতে হবে সেটাও জানে না। বিছানা থেকে নড়াচড়া করার শক্তিটুকু শরীরে নেই। মনে হয় নিশ্বাসটা আর বহন করা গেল না। তার আগে যদি একটিবার দিলারাকে দেখতে পেতাম! দিলারার কথা মনে আসতেই নিজের মধ্যে কিছুটা শক্তি অনুভব করছে। আচ্ছা, আমি যে মৃত্যু পথযাত্রী, সেটা কি দিলারা জানে? না জানার তো কথা নয়। দিলু মিয়ার ভাবনাতে কেবল দিলারা।
ডাক্তার এল দিলু মিয়াকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিতে।
ডাক্তার বলল, ‘আপনি কি এখন কিছুটা সুস্থতা বোধ করছেন।’
‘জি, ডা. সাহেব।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘ওকে এক ঘণ্টা পর নার্স এসে দিয়ে যাবে। না করবেন না কিন্তু।’
রেহেনা পাশেই ছিল। দিলু মিয়াকে বলল,
‘ভাইয়া, কে আসবে তোমার কাছে?’
‘বোন, আমার জন্য তুই অনেক কষ্ট করছিস। তোকে কী দিয়ে খুশি করবে।’
‘কী যে বল ভাইয়া। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ, তাহলে আমি খুশি।’

শেষ বিকেল। দিলু মিয়া ঘুমাচ্ছে। ঠিক দিলুর পাশেই রেহেনা বসে আছে। এমন সময় দিলারা ও নিশি মেডিকেল আসে। রেহেনা দিলারাকে দেখে অবাক হয়। দিলারার হাতে একগুচ্ছ গোলাপ। আজ দিলারা মন খুলে কথা বলবে দিলুর সঙ্গে। রেহেনা বলে,
‘তোমরা এসেছ, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। দিলুর ভাইয়ার ভালোবাসা যে কতটা সত্যি, আজ এখন আমি বুঝতে পেরেছি। হে মাবুদ, তুমি মানুষের ভেতর এত ভালোবাসা কীভাবে দিতে পার।’

রেহেনার চোখে পানি চলে এসেছে। দিলারা বলল, ‘কী হয়েছে রেহেনা?’
‘কী হয় নাই সেটা বলো। দিলু ভাই যে তোমাকে কতটা ভালোবাসে, আজ নিজের চোখে দেখেছি। এবং তোমরা আসার পর পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হয়েছি।’
নিশি বলল, ‘রেহেনা, কী হয়েছে খুলে বল?’
‘একটু আগে ডাক্তার এসেছিল দিলু ভাইকে ঘুমের ইনজেকশন দিতে। দিলু ভাই কি বলেছে জান?’
‘কী বলেছে?’
‘সে বলেছে, দয়া করে এখন আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দেবেন না। ডাক্তার কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসবে। বিশ্বাস করো, এই কথা শুনে আমি ভাবলাম দিলু ভাই বোধ হয় মানসিক সমস্যায় ভুগছে।’
দিলারা অতি আগ্রহ নিয়ে বলে,
‘তারপর ডাক্তার কী করল।’

‘ডাক্তার অনেক রিকোয়েস্ট করছিল। কিন্তু দিলু ভাই হাতজোড় করে না করাতে ডাক্তার চলে গেল। এখন তোমরা আসাতে বুঝতে পারলাম দিলু ভাই তোমার কথা ভেবে ডাক্তারকে এসব বলেছে।’

‘রেহেনা, কি বলছ তুমি!’
‘হ্যাঁ, আমি সত্যি বলছি। তোমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার এত বেশি শক্তি যে সে আগে থেকে জানতে পেরেছে তুমি আসবে। আমি অবাক!’
নিশি বলে,
'আশ্চর্যের বিষয়। তার মানে দিলু ভাই জীবনে–মরণে শুধু তোকেই ভাবে দিলারা। আমি দিলু ভাইকে ডাক দিই। তোকে সে দেখুক। দেখে একবারের জন্য হলেও তাঁর মনকে শান্ত করুক।’

নিশি দিলুকে ডাক দিতে গেলে দিলারা বারণ করে। এবং বলে,
‘ওর যখন ঘুম ভাঙবে, তখন সে আমাকে দেখবে।’
দিলারার কথা শুনে রেহেনা ও নিশি দুজনে খুশি।

দিলারা অবাক নয়নে দিলু মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কেন এত বেশি ভালোবাসে আমাকে। আমার মতো হতদরিদ্র এতিম একটা মেয়ের মধ্যে সে কী দেখেছে। আমি প্রতিবারই তাকে এড়িয়ে চলেছি। আজ আমি বড় বেশি অপরাধী হয়ে গেলাম। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। হে মহান সৃষ্টিকর্তা, তুমি দিলুকে সুস্থ করে দাও। আমি একবার ওর চোখে চোখ রেখে বলতে চাই, আমাকে তুমি ক্ষমা করো দাও। চলবে...