কাগজের অর্ধেক টুকরা
শেষ মালপত্রগুলোও চলে গেছে।
যুবকটি, যিনি ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন, টুপিতে শোকের পুষ্পস্তবক দিয়ে আরও একবার ফ্ল্যাটটি ঘুরে বেড়ালেন, মেঝে দেখলেন, কোনো কিছু ভুলে গেছেন কি না।
না, একেবারে কিছুই না; এবং তিনি হলের ভেতর গেলেন, আরেক দফা দেখে ভাবলেন। না, আর ভাবতে হবে না। কিন্তু পাশের দরজায় খিলানের কাছে ফোনের পাশে কাগজের অর্ধেক টুকরা আটকে ছিল। টুকরাটি ছিল সম্পূর্ণরূপে বিভিন্ন শৈলীতে লেখা, ঝরঝরে কালিতে অন্যান্য পেনসিল বা লাল কলম দিয়ে লেখা একটি টেলিফোন লিস্ট। কোনো কোনো নম্বর লাল কালিতে, কোনোটা–বা নীল বা কালো কালিতে গল্পের মতো সুন্দর বিন্যাসে হাতে লেখা।
বিগত দুই বছরের দুঃখময় সময় তিনি ভুলে যেতে চেয়েছিলেন।
কাগজে লেখা ছিল মানুষের জীবনের একটি অংশ। তিনি কাগজের অর্ধেক টুকরার ওপর চোখ বোলালেন, ইতিহাসের চাদরে মোড়া দীর্ঘ দুটি বছরের গল্পকথা। তিনি হলুদ কাগজটির ওপর ঝুঁকে পড়েন। ঘরে যেহেতু কোনো আববাব ছিল না তাই তিনি ছোট তাকের ওপর কাগজটি রেখে দেখেন প্রথম নামটি ছিল অ্যালিসের। সবচেয়ে সুন্দর নাম অ্যালিস তাঁর বাগদত্তা। অ্যালিসের ফোন নম্বরটি গির্জার স্তবকের সংখ্যার মতো লাগছিল।
গির্জার পাশেই ব্যাংক।
যেখানে তিনি কাজ করতেন, পবিত্র কাজ, যা তাঁকে দিয়েছে রুটি, ঘর এবং অস্তিত্বের ভিত্তি। কিন্তু ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অচিরেই তিনি অন্য আরেকটি ব্যাংকে চাকরি পেয়ে নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়েছিলেন। তা না হলে যে কী হতো!
❦
এরপর এসেছিল সুখের সময়।
কাগজের টুকরায় ছিল ফুলের দোকান এবং যে ব্যক্তির কাছ থেকে ঘোড়া ও গাড়ি ভাড়া করেছিলেন তাঁর নম্বর। বাগদানের সময় তাঁর টাকার কোনো অভাব ছিল না। তাই তিনি সব ব্যয় বহন করতে পারতেন।
তারপর কাগজের টুকরায় একটি শব্দ ছিল আসবাবপত্র বিক্রেতা, যেখান থেকে তিনি তাঁর ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কিনেছিলেন। অ্যালিসসহ দুজন মিলে বাড়ি সাজিয়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন।
এর নিচেই ছিল এক্সপ্রেস এজেন্সির কথা। তাঁরা নতুন ফ্ল্যাটে থাকবেন। তিনি মনে রাখবেন কীভাবে তাঁরা একসঙ্গে ফ্ল্যাটটি সজ্জিত করেছিলেন।
আরও ছিল অপেরা হাউসের কথা। নবদম্পতিরা রোববার অপেরা দর্শনে যান, সেরা মুহূর্তে নিজেরা চুপচাপ বসে থাকেন পর্দার দিকে তাকিয়ে।
এরপর এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি একজন বন্ধু এবং সমাজের নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তা ধরে রাখতে পারেননি, যা তাঁর ভাগ্য বহন করতে পারে। কিন্তু অসহায়ভাবে তিনি অনেক দূরে ছিটকে পড়েছিলেন।
তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর জীবনে নতুন কিছু প্রবেশ করেছিল। অ্যালিস সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন। পেনসিলে নার্সের হাতের লেখা। চিকিৎসকের নাম ডাক্তার এল, তিনি এসেছিলেন নিঃশব্দে এবং বিরক্ত না করার জন্য বলেছিলেন এবং তিনি হলের ভেতর দিয়ে না গিয়ে করিডর দিয়ে বেড চেম্বারের পথ ধরেছিলেন। অ্যালিস ছিল খুব অসুস্থ। এ জন্য ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। অ্যালিস টিউবারকিউলিসে ভুগছিলেন।
প্রথমবারের মতো কাগজের টুকরায় একজনের নাম এসেছে।
আপেক্ষিকভাবে লেখা আছে ‘মা’। তিনি শাশুড়ি।
নবদম্পতি যাতে বিরক্ত না হন সে জন্য বিচক্ষণতার সঙ্গে দূরে থাকতেন। কিন্তু এখন প্রয়োজনের সময় ডাকা হয়েছে। সন্তান জন্মের পর অ্যালিস খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই শাশুড়ি এলেন কিছুটা সামাল দিতে। তারপর লেখা ছিল কর্মসংস্থানের নামটি, লেখা ছিল বড় অক্ষরে। কাজের মেয়েটি চলে যাওয়ার পর নতুন একজনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা আছে।
ফার্মেসি: মূল্যবান সব ওষুধ।
দুধ: অ্যালিস নবজাতককে দুধ খাওয়াতে পারতেন না। যদি তাঁর দুধ নবজাতককে অসুস্থ করে সেই ভয়ে দুধ কিনে আনতে হতো।
মুদির দোকান: ঘরের বাজার সদাই টেলিফোন করে নিয়ে আসা হতো। অসুস্থতার জন্য অ্যালিস বাজারে যেতে পারতেন না। তাঁকে সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হতো। এরপর তিনি আর পড়তে পারেননি, চোখ পানিতে ভরে এসেছিল।
এরপর ছিল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংস্থার নাম। যে বিষয়টি সব বলে দেয়, সব খোলাসা করে দেয়। একটি বড় এবং একটি ছোট কফিন। একটি অ্যালিস ও অন্যটি শিশুর জন্য। এরপর হাইফেন দিয়ে লেখা, মাটি। এরপর আর কিছু লেখা নেই।
**অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের লেখা থেকে অনুবাদ
*লেখক পরিচিতি: জোহান অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ (২২ জানুয়ারি ১৮৪৯–১৪ মে ১৯১২) সুইডিশ লেখক, নাট্যকার এবং চিত্রশিল্পী। স্ট্রিন্ডবার্গ সুইডিশ আধুনিক থিয়েটারের জনক হিসেবে পরিচিত।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]