বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা ও সরকারের কাছে প্রবাসীদের দাবি
ইথিওপিয়াপ্রবাসীদের পক্ষ থেকে প্রথম আলোর পাঠকদের ও সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রবাসীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকেন এবং তাঁদের অংশগ্রহণে দেশের সামাজিক কাঠামোও পরিবর্তিত হয়। প্রবাসীদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ তুলে ধরলাম।
১. প্রবাসী কর্মীদের রেমিট্যান্স
প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রবাসীরা তাঁদের পরিবারকে সুযোগ-সুবিধা প্রদান, শিক্ষার জন্য অর্থায়ন ও স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে সহায়তা করেন। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রবাসীরা জীবনযাত্রা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তা করেন। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ এবং এটি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
২. কর্মসংস্থান সৃষ্টি
প্রবাসীরা দেশে ফিরে এসে নতুন ব্যবসা শুরু করেন, যা স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এভাবে তাঁরা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেন।
৩. দক্ষতা ও প্রযুক্তির স্থানান্তরের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন
প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে বিভিন্ন দক্ষতা ও প্রযুক্তি শিখে ফিরে এসে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখেন। তাঁরা তাঁদের অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দেশের বিভিন্ন খাতে প্রয়োগ করতে পারেন। এই দক্ষতা স্থানীয় শ্রমবাজারের উন্নতিতে সাহায্য করে এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করে।
৩. সমাজের উন্নয়নে অবদান
প্রবাসীরা তাঁদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে সমর্থন দিতে গিয়ে সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। তাঁরা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে সহযোগিতা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করেন।
৪. বৈদেশিক বিনিয়োগে প্রভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ব্যবসা
প্রবাসীরা দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে। অনেকে প্রবাসে থেকে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় লগ্নির মাধ্যমে সহযোগিতা করেন। তাঁরা বিভিন্ন এনজিও ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে অবদান রাখতে পারেন। প্রবাসীদের মাধ্যমে দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। তাঁরা বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করেন। বিদেশে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাঁরা দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেন।
৫. সামাজিক পরিবর্তন
প্রবাসীরা বিদেশে থাকার মাধ্যমে বিদেশি সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ও দর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা দেশে ফিরে এসে সামাজিক পরিবর্তনে অবদান রাখতে সহায়তা করে। তাঁরা তাঁদের পরিবারের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করে একটি ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন।
৬. ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতার উন্নয়ন
আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ফলে প্রবাসীরা ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করেন, যা দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
৭. সাংস্কৃতিক বিনিময়
প্রবাসীরা বিদেশে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন, যা দেশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বৃদ্ধি করে। তাঁরা বিদেশে বাংলাদেশি কমিউনিটির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে দেশের গর্ব ও ঐক্যের অনুভূতি সৃষ্টি করেন।
সর্বোপরি, প্রবাসীরা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বিন্যাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রবাসীদের ভূমিকা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবিস্মরণীয়। তাঁদের আত্মত্যাগ, পরিশ্রম ও স্মার্ট বুদ্ধিমত্তা দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে, যা ভবিষ্যতে দেশের সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সহযোগিতা ও সংহতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়ন আরও মসৃণ ও সমৃদ্ধ হবে।
স্বাধীন বাংলা প্রবাসী ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবিগুলো
স্বাধীন বাংলা প্রবাসী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে আমি প্রবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি তুলে ধরতে চাই। প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের দেশের অর্থনীতির একটি বড় স্তরের অংশ এবং তাঁদের সম্মান ও সুবিধা প্রদানের দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। এখানে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো—
১. প্রবাসী কর্মীদের মর্যাদা: সব প্রবাসী কর্মীকে বিমানবন্দরে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। তাঁদের জন্য আলাদা লাউঞ্জের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দুই ঘণ্টার বেশি সময় লাউঞ্জে অবস্থান করলে তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. রেমিট্যান্স প্রণোদনা: প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর ন্যূনতম ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে হবে এবং রেমিট্যান্স পাঠাতে সহযোগিতা করতে হবে।
৩. সম্মানের সঙ্গে সেবা: বিমানবন্দরে প্রবাসীদের সম্মান দেওয়া, সব ধরনের হয়রানি বন্ধ করা এবং লাগেজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. মৃত্যুর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা: বৈধ অথবা অবৈধ প্রবাসী যদি মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের লাশ দ্রুত সরকারি খরচে বাংলাদেশে আনা নিশ্চিত করতে হবে। লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার পাশাপাশি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নির্ধারিত অর্থও প্রদান করতে হবে।
৫. বেতন ও ভাতা কার্ড: সব প্রবাসীকে সরকারিভাবে প্রবাসী মাসিক বেতন ও ভাতা কার্ড প্রদান করতে হবে এবং নাগরিক সুবিধা দিতে হবে। এ সুবিধার জন্য তাঁদের ন্যূনতম পাঁচ বছর প্রবাসকাল ও সব প্রয়োজনীয় বৈধ কাগজপত্র থাকতে হবে।
৬. অবৈধদের বৈধতা প্রদানে সহায়তা: বিভিন্ন দেশে অবৈধ বাংলাদেশি প্রবাসীদের বৈধতা করানোর জন্য বাংলাদেশি দূতাবাসকে উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অবৈধদের কাজ দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়।
৭. দূতাবাসের সেবা: সব দূতাবাসকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং ঘুষ বা স্বজনপ্রীতি ছাড়া কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
৮. পূর্বসতর্কতা: বিদেশগামী কর্মীদের আগে থেকেই চাকরির শর্ত ও বেতন সম্পর্কে নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তাঁরা অজানা পরিস্থিতির সম্মুখীন না হন।
৯. প্রশিক্ষণ: প্রবাসীদের আয় ও দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদেশে পাঠানোর আগে প্রত্যেক কর্মীকে তিন থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে পাঠানো উচিত।
১০. ভোটদানের সুযোগ: প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে তাঁরা বৈধভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
১১. দূতাবাসের কার্যক্রম: দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সেবা প্রদানের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১২. পরিষ্কার যোগাযোগ:
প্রবাসীর সঙ্গে সুসম্পর্ক: দূতাবাসে আসা প্রবাসীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতামূলক আচরণ করা উচিত।
১৩. ডকুমেন্ট ফি কমানো:
ফি পুনর্মূল্যায়ন: ফি কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন করে দেখে নিতে হবে কোন ডকুমেন্টগুলোর ফি কমানো সম্ভব।
ফ্রি সার্ভিস: কিছু সাধারণ পরিষেবা, যেমন জন্মসনদ, মৃত্যুর সনদ ইত্যাদির জন্য ফ্রি সার্ভিস প্রদান করা যেতে পারে।
১৪. ওয়েবসাইট আপডেট: দূতাবাসের ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট ও প্রয়োজনীয় তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করতে হবে।
১৫. উন্মুক্ত কাজের সুযোগ:
প্রবাসী মেলার আয়োজন: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা মেলার মধ্য দিয়ে প্রবাসীদের সঙ্গে দূতাবাসের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা যেতে পারে।
সেমিনার ও কর্মশালা: বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে সুবিধা প্রদান করা।
এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করি, কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ দেবে এবং প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।