ইস্তাম্বুলের দিনলিপি

ছবি: লেখক

নিবু নিবু কমলা রঙের রাতের সঙ্গে আমার অদম্যকাল ধরে পরিচয়। রাত হলেই হাঁটতে বের হতাম। সেকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী থেকে ইস্কাটনে যেতাম আর একালে ফাতিহ থেকে ইশতিকলাল স্ট্রিট। ইদানীং ইস্তাম্বুলের ল্যাম্পপোস্ট আমার পথের সাথি।

আজকের রাতটা ভীষণ অদ্ভুত। কেমন যেন মখমলে আকাশ। মনে হচ্ছে, আকাশের চোখে পানি জমে আছে, আকাশে পুষে আছে বহু দিনের পুরোনো দুঃখ। যেকোনো মুহূর্তে সহ্যের বাঁধ ভেঙে কেঁদে ফেলবে ইস্তাম্বুলের আকাশ।

ছবি: লেখক

ইস্তাম্বুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আমার মাঝেমধ্যে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়! ইচ্ছা হয় জড়িয়ে ধরি সমগ্র ইস্তাম্বুলকে; আজও তা-ই ইচ্ছা হচ্ছে।

দিনভর এ শহর মাতিয়ে বেড়ান গ্লোবাল পর্যটক। ট্রেন, বাস আর ট্রাম। সারাটা দিনভর বাজতে থাকে হুইসেল আর নয়া পর্যটকের গান।

দিনভর পাখির মতো কিচিরমিচির করে মানুষ। এশিয়া থেকে ইউরোপে চরকির মতো ঘুরতে থাকে ইস্তাম্বুল। কতশত মানুষ এই শহরে আসে, আবার চলেও যায়। আমি বোধ হয় একেবারে থেকে গেলাম এ শহরে, ইস্তাম্বুলের অদ্ভুত জালে আটকে পড়া মানব আমি।

এখন হাঁটছি ইস্তাম্বুল ফাতিহ মহল্লার বাঁয়ে রোড ধরে। উদ্দেশ্য, প্রাচীন দার্জিলিং শহরের ঠিক উল্টো দিকে।

তবু অত দূর থেকেও আমার কানে ভেসে আসছে সমুদ্রের চিৎকার। সমস্ত ইস্তাম্বুলকে জড়িয়ে ধরেই হাঁটছি আজ। মনোরথ এখন সমুদ্রের দিকে। যতই কাছাকাছি আসছি, ততই সমুদ্রের টানা কান্নার শব্দ আসছে আমার দিকে। কৃষ্ণসাগর আর মারমারা আমায় ডাকছে খুব করে।

ছবি: লেখক

অন্যদিকে বসফরাসের ডুকরে ওঠা কান্না আর গুমরে ওঠা জলের শব্দ আমার হৃদয়ে ধীরে ধীরে ক্ষত আঁকছে। শিশিরভেজা ফুলের মতো ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা প্রাচীন সব সুলতানের মুখচ্ছবি পরক্ষণেই ভেসে উঠছে চোখে। স্পষ্ট দেখা মিলেছে প্রাচীন বাইজেইন্টাইন। আমার দেহ জড়িয়ে আছে সুলতান ফাতিহের ‘ইসলামবুল’ আর আমি দাঁড়িয়ে আছি মোস্তফা কামালের প্রবীণ ‘ইস্তাম্বুল’।

প্রাচীন এই শহরের মানুষদের এত কিসের দুঃখ, আমার কখনোই বুঝে আসে না! এরা রাত হলেই বসফরাসের তীরে বসে পড়ে। রাত্রিময় দুঃখ যাপন করে। আজ আমি তাদের দুঃখযাপনের সাথি বনেছি।

রাত পোহালেই ছুটি শেষ। ডর্মের রেস্ট্রিকশনের আজই শেষ রাত। আজকের রাতটা সমুদ্রের পাড়ে বসেই কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা। মনে হচ্ছে, সম্ভব হবে না! দুঃখদের তাড়া আছে, যেতে হবে! কত কিছুই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও করছি নিতান্তই।

এ যেমন ডরমের তুর্কি খাবার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিলছি প্রতিদিন। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে, শুদ্ধতার কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনটি, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই নাই আর...’। আমার কেন যেন মনে হয়, জীবনানন্দ রূপ বলতে এখানে সামগ্রিক রূপ-স্বাদ বোঝাতে চেয়েছেন। যেমন বাঙালি খাবার ভাত-মাছ।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

যাকগে, ইস্তাম্বুলের আকাশের সহ্যক্ষমতা ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে। শুরু হয়েছে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা বসফরাসের ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রিনিঝিনি খেলছে প্রাচীন এই জলের সঙ্গে। আমি একনজরে তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। আকাশ যেন উবু হয়ে সমুদ্রকে চুমু খাচ্ছে।

সমস্ত দেহ শান্ত। বৃষ্টির চুম্বনে তরঙ্গ সঞ্চার করে আমার শান্ত দেহ ফুলে ফেঁপে উঠছে। মুহূর্তেই বসফরাসের অন্তরাত্মা আমায় নিয়ে মেতে উঠতে চাচ্ছে। আকাশের সমস্ত বৃষ্টির ফোঁটা কেন্দ্রীভূত করে সুবিস্তীর্ণ হচ্ছে আমার জীর্ণজুড়ে।

আনন্দে দেহের ইন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে দুঃখ। আমার বাঁ চোখ থেকে কফোঁটা উষ্ণ জল বসফরাস হয়ে মারামারার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি তবু চক্ষু মেলে দেখিনি কিছুই। ততক্ষণে ধীরে ধীরে বৃষ্টির ছাইপাঁশ কমে আসে। আমার শরীরে বাসা বেঁধে থাকা প্রাচীনতম পুরোনো দুঃখগুলো শুষে নিয়েছে প্রবীণ ‘ইস্তাম্বুল’।

*লেখক: সুনান খান, শিক্ষার্থী, ইস্তাম্বুল ইবনে হালদুন ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]