কী করে বইপোকা হলাম?

পড়ছিলাম মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’। মুস্কান জুবেরীর রহস্য পড়তে পড়তে মনে হলো, আসলেই তো, কী করে বইপোকা হলাম? কবেই-বা? ভাবলাম, চলো ঈশিতা, অতীত থেকে খানিক ঘুরে আসা যাক।

বছরটি ১৯৯২। সবেমাত্র দুধদাঁত পড়া ছয় বছরের ফোকলা বুড়ি তখন আমি। ফেব্রুয়ারির কোনো একসময়ে, সেদিন ছিল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। তবে কোনো এক শারীরিক কারণেই খেলাধুলা, ছোটাছুটি ইত্যাদি আর দশজন বাচ্চার যত স্বাভাবিক কাজ, আমার জন্য সবকিছুই দুঃস্বপ্ন ছিল, যা আজও আছে। যাক সে কথা।

আমার আম্মু সব সময় চান, কোনো প্রতিবন্ধকতা যেন তাঁর মেয়েকে দমিয়ে না রাখে। তাঁর আগ্রহে নাম দেওয়া হয়েছিল আমার, দৌড় প্রতিযোগিতায়। প্রায় প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ে গিয়ে সীমানা মাপক দড়িতে পা হড়কে মুখ থুবড়ে ছিটকে পড়লাম অনেকটা দূরে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পড়ল হাসির রোল।

সেদিন দর্শকসারিতে আম্মুর সঙ্গে আব্বুও ছিলেন। ওই আচমকা আঘাত যোগ হাসিতে আমার তখন চোখের জল নাকের পানি এক হয়ে যে অবস্থা হলো, আব্বু সোজা সামনে এসে বললেন, চলো ইসু।

আরে চলি ইসু-তো কোথায় চলি? আব্বু-আম্মু তো দুইদিক থেকে টেনে ধরে আমাকে বেবিট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে ছুটেছেন ততক্ষণে, আমি হাঁদারাম দেখতে পাচ্ছি না কিছু, আব্বু আমার চোখ চেপে ধরে ছিলেন।

সেই হলুদ বেবিট্যাক্সি থামল এক বিশাল পরিচিত হলুদ স্থাপত্যের সামনে, জাতীয় জাদুঘর। যার আঙিনায় তখন কচিকাঁচার মেলা, চলছে চিত্রাঙ্কণ প্রতিযোগিতা। এবার আব্বুর হাতের আড়াল সরল চোখ থেকে, আমার সামনে তখন সুন্দর এক সাদা কাগজ আর রংপেনসিলের বাক্স।

সেদিন আব্বুর বলা কথাটি না বুঝলেও, আজ প্রাপ্তবয়সে বুঝি, ‘হয়তো আল্লাহ চান না খেলার মাঠে তোমার জায়গা হোক, তুমি এটাকে নিজের জায়গা বানাও।’

সেদিন মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচা হাতে এঁকেছিলাম ছোট্ট এক ঝিল। সেই ঝিলে ভেসে বেড়ানো বাবা হাঁস, মা হাঁস এবং দূরে পাহাড়ের ওপারে সূর্যাস্ত। এ মা-বাবার ছয়টি বাচ্চা আঁকতেও ভুলিনি, ছয় ভাইবোনের ছোট্টটি ছিলাম যে!

সেদিন পুরস্কার বিতরণীতে আমার হাতে কোনো ক্রেস্ট, মেডেল ছিল না। প্রথম তিনজনের মধ্যে জায়গা পাইনি ঠিক, তবে সেরা দশের একজন হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিলাম ঠাকুরমার ঝুলি, শ্রেষ্ঠ আরব্য রজনী, ছোটদের মহানবী এবং সেবা কিশোর ক্ল্যাসিক সিন্ডারেলা। সনদও ছিল সঙ্গে।

সেই সিন্ডারেলাই ছিল বানান করে পড়া প্রথম বই। এক পাতা পড়তে লাগত এক ঘণ্টা তখন আমার। তারপর আস্তে আস্তে বাকিগুলো। সেদিন যদি খেলার মাঠে আঘাত না পেতাম, আজ হয়তো নিজের বই পড়া এবং নিজেই বই লেখার যে আনন্দ, এর কোনোটি-ই পেতাম না।