বাবার চলে যাওয়া

অলংকরণ: আরাফাত করিম

অবশেষে চলে গেলেন আমার বাবা। দুটি অক্ষরের একটি শব্দ, বাবা। অথচ এর বিশালতা যে কত, তা বলে শেষ করা যাবে না। সন্তানের বিপদে বাবাই সবার আগে পাশে এসে দাঁড়ান সবচেয়ে বড় ছায়া হয়ে। আজ তাঁর চলে যাওয়ায় মনে হলো, আমার মাথার ওপর থেকে বিরাট একটি ছায়া সরে গেল। নিজেকে অনেকটা অসহায় মনে হচ্ছিল। আর কোনো দিন আমার বাবাকে ছুঁয়ে দেখা হবে না। কোনো দিন তাঁর পাশে বসে গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসে থাকা হবে না। জুতা পায়ে তাঁর হেঁটে আসার শব্দও আর শোনা হবে না। আর কেউ বলবে না, তুমি আবার কবে আসবা? তিনি অসুস্থ ছিলেন, তবু তো ছিলেন। নিয়তি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের কিছুই করার নেই।

আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ও পরিপাটি একজন মানুষ। পোশাক-আশাক ছিল অত্যন্ত রুচিশীল।

তিনি সব সময় মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন হাসিমুখে। তাই হয়তো তাঁকে শেষ দেখা দেখতে সাত গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। আমরা সন্তানেরাও দেখেছি তাঁকে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতে। আমাদের সঙ্গেও কখনোই তিনি রেগে কথা বলেননি। কত কিছু আবদার করেছি, কখনোই না করেননি। হয়তো একটু দেরি হয়েছে, তবু সবকিছুই দিয়েছেন। ঈদের সময় নতুন জামা-কাপড়ের জন্য কত আবদার করেছি। এখন বারবার শুধু মনে হয়, কেন এত আবদার করেছি? এত আবদার না করলে কি হতো না? নিজের জন্য কখনো কিছু কেনেননি, সবকিছুই দিয়েছেন সন্তানদের, উজাড় করে।

ছাত্র অবস্থায় অনেকবারই টিউশনি করতে চেয়েছি, কিন্তু আমার কষ্ট হবে বলে কখনোই করতে দেননি। সেদিন হয়তো বুঝিনি, বাবা হয়ে সন্তানের জন্য কী অনুভূতি। আজ আমি বাবা হয়েছি, এখন বুঝি, সন্তান বাবার কাছে কী? আমি যখন প্রবাসে চলে আসি, তখন বুঝিনি বাবা হিসেবে সন্তানকে বিদায় দেওয়ার কষ্ট কতটা বেদনাদায়ক। অথচ আজ আমার সন্তানেরা যখন দুই দিনের জন্যও বাইরে যায়, আমার কেমন লাগে, সেটা বলে বোঝানো যায় না। হয়তো সব বাবাই চান তাঁর সন্তানেরা সব সময় আশপাশেই থাকুক। তাই হয়তো আমার বাবা একদিন আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে বদলি হয়ে চলে আসতে।

তখন বুঝিনি তাঁর সেই কথার অর্থ। মুখ ফুটে কিছু বলেননি, কিন্তু আজ আমি বুঝি তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর কাছেই থাকি। আসলে কোনো বাবাই তাঁর কষ্ট প্রকাশ করেন না, নিজেই কষ্ট পেতে থাকেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সব কষ্ট একাই সহ্য করে যান। এসব কষ্ট আমি নিজেও আগে বুঝতাম না। এখন বুঝি, কারণ এখন আমিও একজন বাবা। আর সন্তানদের সফলতাগুলো সব বাবাকেই অনেকটা আনন্দে উদ্বেলিত করে। আসলে কোনো বাবাই তাঁর নিজের জন্য কোনো কিছু চান না। সবকিছু সন্তানদের জন্য বিলিয়ে দিতেই তাঁদের আনন্দ। প্রবাসজীবনের একটি কষ্ট হলো, চলে যাওয়ার খবরগুলো শুধু টেলিফোনেই শোনা হয়, শেষ দেখাটাও হয় না। কখনোই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায় না। শুধু বুকভরা কষ্টগুলোকে নীরবে অনুভব করা হয়। এক সপ্তাহের বেশি টেলিফোনে কথা না বললে তিনি আমাকে বলতেন, এত দিন পর ফোন করলে! কথাটি বলার আর কেউ রইল না। আর কেউ বলবে না, চলে আসো, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকব।

আমার বাবার শেষ দিকের দিনগুলো অনেকটাই শারীরিক কষ্টে কেটেছে, যে সময়টা আমাকে তাঁর খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। অথচ আমি সেই সময় তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। তাঁর হাতটা ধরে বলতে পারিনি, ভালো হয়ে যাবেন। তাঁর মাথায় একটু হাত বুলিয়েও দিতে পারিনি। ভিডিও কলে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি, কতবার তিনি ফোনের স্ক্রিনে হাত দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন। মনে হয়, ফোনে ছুঁয়ে দেখলেই তিনি সন্তানের ছোঁয়া পেয়ে যাবেন। আসলে বাবা হিসেবে সন্তানের জন্য কী অনুভূতি, এটাই ছিল একধরনের বহিঃপ্রকাশ।

আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম, তখন অনেকের লাশই কাঁধে নিয়েছি। অথচ নিজের বাবার লাশ কাঁধে নেওয়া হলো না। আমার মতো বেশির ভাগ প্রবাসীকেই এ ধরনের কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

আমাদের সময়টা হয়তো আজকের মতো এতটা আধুনিক ছিল না। তাই হয়তো অনেক না-বলা কথা কোনো দিনই বাবাকে বলা হয়নি। কোনো দিনই বলতে পারিনি, ‘আব্বা, আপনি অনেক ভালো, অনেক ভালোবাসি।’ আসলে বাবারা এ-জাতীয় শব্দের সঙ্গে কখনোই অতটা অভ্যস্ত ছিলেন না।

আজ সবকিছু হারিয়ে আমি শুধু খুঁজে ফিরি, কোথায় গেলে তাঁর একটু ছোঁয়া পাব। আগে কখনো বুঝিনি এতটুকু ছোঁয়ার কত বিশালতা। পুরো পৃথিবী অনেকটাই শূন্য মনে হয়। এই শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। আজ মনে হয়, কেন প্রবাসে এলাম? হয়তো একটু কষ্টই হতো, তবু তো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারতাম। সময়ে-অসময়ে বাবার হাতটা ধরতে পারতাম। মাঝেমধ্যে আমি বুঝতাম, আমাকে কাছে পেলে আমার বাবার বুকটা কত ভরে যেত। চোখ বন্ধ করলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া সেসব দিনের সব স্মৃতি। আজ সবই মরীচিকা। চোখের জল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।