থাইদের খাদ্য প্রেম
থাইরা খাদ্যপ্রিয় জাতি। এরা যতক্ষণ জেগে থাকে, ততক্ষণ খায়। আমাদের দেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলীদের মতো এখানকার কিশোর–কিশোরীদের বড় অংশের স্বপ্ন থাকে ভালো শেফ হবে। প্রথম প্রথম আমি যখন পে (আমার পার্টনার) আর ওর পরিবারের সঙ্গে মিশি, তখন বাড়াবাড়ি মনে হতো কিছু বিষয়। যেমন ধরেন এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে ঘুরতে যাচ্ছে আইসক্রিম খেতে বা কফি খেতে! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক বা ইনস্টাগ্রামে দেখা কোনো স্ন্যাকস খেতে কয়েক শ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া! আমার মনে প্রশ্ন জাগত, এই স্ন্যাকস খেতে যে পরিমাণ শারীরিক শ্রম, গাড়ির জ্বালানি বা সময় খরচ করা হলো, সেটা কতটুকু প্রয়োজন! পরে বুঝতে পারলাম, থাইদের কাছে স্বাদের কাছে অন্য সব অঙ্ক পরাজিত হয়।
থাইদের একটা ছুটির দিনের রুটিন যদি অনুসরণ করি! সকালে উঠে ভাত বা নুডলস খেল! এখানে সকালের নাশতা বলে কোনো ভিন্ন খাবার নেই। এরা তিন বেলাতেই পরিপূর্ণ খাবার খায়।
এরপর ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ধরেন কোনো ক্যাফেতে। এর কিছুক্ষণ পরেই তো দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল। সেই খাবার খাবেন অনেক সময় নিয়ে। তারপর আবার কিছু স্ন্যাকস। সেটা খেতে খেতেই সন্ধ্যা ছয়টা বাজলেই রাতের খাবারের সময় হয়ে যায়!
এখানে থাই পরিবার মানেই খাবার নিয়ে ব্যস্ততা। যেকোনো অফিসে কোনো কাজে যদি যান, দেখা যাবে ওই কর্মকর্তার টেবিলে কফি বা স্ন্যাকস বা কোনো খাবার থাকবেই। ঢাকায় যেমন বলে জীবনের অর্ধেক যায় যানজটে, থাইদের জীবনের অর্ধেক সময় কাটে খাবারের পেছনে। এখানে অর্ধেক মানুষ রেস্তোরাঁ চালায় আর অর্ধেক মানুষ খায়। বাসায় রান্নার সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্ত।
ব্যাংকক, পাতায়া বা ফুকেটের পর্যটন এলাকাগুলো ঘুরে যে থাইল্যান্ড দেখা যায়, বাস্তবের থাইল্যান্ড অনেকটাই তার চেয়ে ভিন্ন। যেমন পর্যটন এলাকাগুলোতে ২৪ ঘণ্টা খাবারের দোকান খোলা থাকলেও আবাসিক বা সাধারণ এলাকাগুলোতে রাত আটটার পর ফ্রেশ খাবার খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া রেস্টুরেন্টগুলো চলে আধা বেলা। যেমন সকাল ছয়টা থেকে দুপুর ১২টা। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা অথবা বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা। অনেক ব্যস্ত রেস্টুরেন্টও ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি খোলা থাকে না। তাহলে বাকি সময়টায় রাঁধুনী বা মালিক কী করেন?
বাকি সময়টায় নিজেরা অন্য কোন রেস্টুরেন্টে খেয়ে সময় কাটান।
শহরে যে নতুন কনডোমোনিয়ামগুলো গড়ে উঠেছে, সেখানে রান্নাঘর পর্যন্ত নেই। মানুষ খাবারের সময় হলে রেস্টুরেন্টে চলে যান অথবা অর্ডার করে খান। এটা শুধু ব্যাংককে নয়। ব্যাংককের বাইরেও একই অবস্থা। এমনকি প্রান্তিক পর্যায়েও। কারণ রান্না করার চেয়ে অন্য পেশায় আয় করে খাবার কিনে খাওয়ার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাকে বেশি ভাবে এখানকার পরিবারগুলো।
থাইল্যান্ডের মানুষ খুবই ঝাল খায়। এখানকার সবচেয়ে প্রচলিত আর জনপ্রিয় খাবার ‘পাড কা প্রাও’, মুরগীর মাংসকে কুচি করে পাকা মরিচ, তুলসী পাতা, রসুন দিয়ে তেলে স্টির ফ্রাইড করা হয়। এর সঙ্গে একটা ডিমের সানি সাইড আপ। এ ছাড়াও ‘টম ইয়াম’ স্যুপ তো বিশ্বজোড়া খ্যাত। তবে এখানে বিদেশি হিসেবে সব সময় অর্ডারের আগে বলে দিতে হবে, যেন ঝাল কম দেয়!
থাইরা আরেকটা বিষয়ে যেন ব্যাঙের সর্দির মতন! যেমন এদের ঠান্ডা কফ কাশিতেও বরফ খাওয়া এড়ায় না। এখানে রেস্টুরেন্টগুলোতে পানি চাইলে এক গ্লাস বরফ এনে দেয়া হবে তার সঙ্গে পানি। কফি, চা, দুধ কোনো কিছুই বরফ ছাড়া চলে না এখানে।
থাইল্যান্ডে মেলা মানেই খাবারের মেলা। মফস্সল শহরগুলোতে যেসব মেলার আয়োজন করা হয়, যেখানে খেলনা থেকে শুরু করে সব তৈজসপত্র পাওয়া যায়, সেখানেও মেলার অর্ধেকজুড়ের থাকে খাবারের স্টল। আর জাতীয় পর্যায়ে যে মেলাগুলো হয়, যেমন বইমেলা, পর্যটন মেলা এমনকি বাণিজ্য মেলাতে গেলেও খাবারের দোকানের ফাঁকে ফাঁকে সম্পর্কিত মেলার দোকান খুঁজে পেতে হবে।
মানুষের এই খাদ্য প্রেমকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ধারনার রেস্টুরেন্ট। যেমন, অর্গানিক শষ্যের জমির ওপরই গড়ে উঠছে রেস্টুরেন্ট, নদীর উপরে সি ফুডের দোকান ইত্যাদি।
থাইরা কী খায়? আমার এক লাওসের বন্ধু একবার বলেছিলেন, দুই পায়ের মানুষ আর চার পায়ের টেবিল ছাড়া সবকিছুই সে খেয়েছে জীবনে। গ্রামীণ অঞ্চলে বা পুরনো মানুষদের মধ্যে খাবারের এই বৈচিত্র থাকলেও নতুন প্রজন্ম সেই অভ্যাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বরং এখন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এখন নিরামিষভোজী ।
আবার অনেকে নিজের বাসাকেও বানিয়েছেন রেস্টুরেন্ট। যেমন সম্প্রতি পে তার বন্ধুর রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলে। রেস্টুরেন্টের নাম স্টিউ হাউজ। এখানে প্রি অর্ডার দিয়েছিল পে। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে টেবিল রিসার্ভ করে রেখেছে। তবে যাওয়ার পরে দেখলাম টেবিল রিজার্ভ করবে কি! রেস্টুরেন্টে টেবিল আছেই একটা। শেফ এবং কর্মচারীও একজনই। সুন্দর টেবিলে মেন্যুকার্ডে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে খাবার কোনটার পর কোনটা আসবে সেটা লেখা রয়েছে। পের বন্ধুর নাম নিউ। ও এসে অভ্যর্থনা জানাল। টেবিলটা হচ্ছে যেন একটা সুন্দর গুছানো বাসার ডাইনিং রুম। বললো এখানে রাখা পানীয় থেকে শুরু করে আর যা যা আছে খেতে পারি! টিভি দেখতে পারি। দেড় ঘণ্টার জন্য ওর সঙ্গে একটা জার্নি আমাদের। এরপর রান্না করতে ঢুকলেন নিউ। প্রথমে এপিটাইজার নিয়ে আসলেন। চিজ ক্রোকার আর আপেলের ভিন্ন রকম ব্যাবহার দিয়ে তৈরি হয়েছে স্নো হোয়াইট।
এরপর স্যুপ। মেইন কোর্স। সবশেষে ডেজার্ট। প্রত্যেকটা কোর্স পরিবেশনের পর কয়েক মিনিট ওর বক্তব্য শুনতে হয়। কি কি উপাদান দিয়ে এই মেন্যুটা বানানো হয়েছে, সেটার পুষ্টিগুণ কী! খাবার যেন বিজ্ঞান আর কলার মিশ্রণ।
যেমন ডেজার্টে যে বাটার কেকটা নিয়ে এল, সেটাকে বলে বাসকিউ। স্পেনে নাকি বেশ জনপ্রিয়। সেটার মধ্যে আবার তিন স্বাদের স্ট্রবেরি আছে। আরও যে কত কলাকৌশল শোনালেন তিনি। দিনে মাত্র দুবার এই রেস্টুরেন্টে অতিথি আসতে পারেন। দুপুরের খাবারে একটা গ্রুপ আর রাতের খাবারের একটা। তবে ৬ জনের বেশি কোন গ্রুপে হতে পারবে না!
নিউ পড়াশোনা করেছেন রন্ধনশিল্পে। পেশায় কিন্তু তিনি বাবুর্চি না। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের জন্য মডেল এবং মেন্যু ঠিক করে দেয়া হচ্ছে তার পেশা। আর এই রেস্টুরেন্টটা নিজের শখের অভ্যাসটা ধরে রাখার জন্য।
**দূর পরবাসে লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি, গল্প ও নানা আয়োজনের কথা পাঠান [email protected]এ