স্মৃতি এবং কল্পনা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ জাতি, তবে আমাদের আচরণ বড়ই অদ্ভুত। আমরা বোকা নাকি চতুর, সেটাও বোঝা কঠিন। যেমন ধরুন, প্রচুর সম্পদ অর্জনে অনেক সময় দেখা গেল, বর্জন করি শরীর-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সবকিছু, আবার হঠাৎ অসুস্থ হলে সেই স্বাস্থ্য ফিরে পেতে সম্পদের অপচয় করি। আমরা বর্তমানকে দুইভাবে কাজে লাগাই, যেমন বর্তমানে অতীতের স্মৃতিচারণা করি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি। ফলে বর্তমানকে বর্তমানের জন্য কিছু করার সুযোগ দিই না।

মূলত আমাদের যাত্রাটা স্মৃতি থেকে কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে সেটা হলো, ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও’, যা আমি প্রায়ই বলে থাকি। বাংলা অর্থে বলা যেতে পারে, এখন এবং এখানে বা এই মুহূর্ত। এখন মুহূর্ত হচ্ছে চলমান। চলমান একটি সময়কে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ, ফলে আমরা বেছে নিই স্মৃতি ও কল্পনাকে।

আমরা আসলে সময়ের কাজ অসময়ে করি বা যখন যেটা করা বা ভাবা প্রয়োজন, সেটা করি না। কারণ, অতীত ও ভবিষ্যৎ আমাদের বর্তমানকে ব্যস্ত রাখে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে করতে বর্তমানকে ভুলে যাই, ফলে শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে যে সময় দেওয়া দরকার, তা দিতে পারি না। পরে অসুস্থ হয়ে পড়ি। বিপদে যখন পড়ি, তখন সেই জমানো সম্পদ খরচ করে সুস্থ হতে চেষ্টা করি। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? আমরা বর্তমানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ। ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও’ কনসেপ্টের ব্যবহার করতে না পারলে আমরা সঠিক পথে চলতে পারব বলে মনে হয় না। এখন আসুন, ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও’ কনসেপ্টের ব্যবহার কীভাবে করা সম্ভব, তার ওপর আলোকপাত করি। বোঝার সুবিধার্থে আমি একটি সহজ-সরল উদাহরণ তুলে ধরব।

আমি আমার শিশুকাল না হয় পার করলাম মা-বাবা, শিক্ষক বা পারিপার্শ্বিক সাহায্যের মধ্য দিয়ে। পরে কৈশোরে তো আমার নিজের মধ্যে নানাভাবে পরিবর্তনের ইঙ্গিত আসতে শুরু করল। সেটার বেশির ভাগই হরমোনঘটিত, যেমন যৌনতা তার মধ্যে একটি। শরীরে যৌনতার ভাব এসেছে ভাবা যাবে, কিন্তু কিছু করা যাবে না। যৌনতাকে চেপে মারা হলো, জীবন গড়তে ভবিষ্যতের চিন্তা করে বর্তমানের চাহিদার জলাঞ্জলি দেওয়া হলো। পরে ভবিষ্যতে গিয়ে অতীতে যেসব চাহিদার আবির্ভাব এসেছিল, সেগুলো করার নতুন উদ্যোগ নেওয়া হলো, যেমন বিয়ে করা। যৌবনের ঢেউয়ের যে অভিজ্ঞতা, সেটা পরবর্তী সময়ে কেমন হতে পারে, তা বুঝতে হলে অভিজ্ঞতা থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা না থাকার মানে, সময়ের কাজ অসময়ে করলে যা হয়, তা-ই হলো। যেমন ধরুন, যে দই এবং ঘোল পৃথক পৃথকভাবে খেয়েছে, তাকে যদি ঘোল দিয়ে বলা হয় এটা দই, কী হবে? সে বলবে, না, এটা দই না। না না, দইয়ের সাধ ঘোল দিয়ে মেটানো যাবে না। কিন্তু যে জীবনে দই ও ঘোল এর কোনোটাই খাইনি, তার কাছে সে কী খেল আর কী পেল, কিছু যায়-আসে না। মানে কী দাঁড়াল, যখন যেটা, সেটা না করলে বা করতে না পারলে পরে যতই করি না কেন, মনে হবে ‘সাধ না মিটিল আশা না পুরিল, শুধু সময় ফুরিয়ে গেল’! আমরা মূলত যখন যেটা, সেটা না করে বা বর্তমানকে ভুলে গিয়ে অতীতের পেছনে দৌড়াই। আমরা যা নেই, তার জন্য ব্যস্ত থাকার কারণে যা আছে, তা উপভোগ করতেও ভুলে যাই।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমরা স্মৃতি ঘাঁটতে পছন্দ করি এবং আমরা কল্পনা করতে ভালোবাসি। আমরা পুরোনো প্রেমের কথা নিয়ে বাঁচতে চাই, আমরা ব্যর্থ প্রেমে ব্যথিত হতে পছন্দ করি। আমরা জীবনে দীপ জ্বালাতে না পারলেও সমাধির পরে দীপ জ্বালাতে চেষ্টা করি।

আমার ভাবনা থেকে কিছু কথা, এ কথাগুলো হয়তো এভাবে বলা হতো না, যদি আমি বাংলাদেশে আমার জীবনটা কাটাতাম। কারণ, আমি তখন দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতাম। যেহেতু আমি ৪০ বছরের মতো পাশ্চাত্যের আলো-বাতাসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি, সেহেতু আমার এই পরিবর্তন। জানি না আমার চিন্তাচেতনা সবার কাছে ভালো লাগবে কি না! তবু এতটুকু বলব, পাশ্চাত্যের সমাজ চেষ্টা করে জীবনকে উপভোগ করতে ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও’ কনসেপ্টের ওপর। তারা যখনকার কাজ তখনই করে, যেমন যৌবনের বিলাসিতা বার্ধক্যে করে না বা সঞ্চয়ে শুধু ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। তারা ছুটিতে দেশ-বিদেশ ঘোরে, ভালো-মন্দের সঙ্গে নিজেদের যুগোপযোগী করে খাপ খাইয়ে নেয়। ফলে দেখা যায়, তাদের মনে দুশ্চিন্তা ততটা বাসা বাঁধে না, যতটা বাঁধে আমাদের সমাজে। দুর্নীতি বা অনীতি তাদের ততটা গ্রাস করতে পারে না।

সর্বোপরি, মরতে তো একদিন হবেই। এটা মনে করে বাকি জীবনটা ধ্বংস করে না। কারণ, এরা পুরো জীবনটাকে পজেটিভভাবে দেখে। তাদের মতে, মৃত্যুটা মাত্র এক দিনের বা এক মুহূর্তের জন্য, কিন্তু জীবনটা পুরো সময়টা নিয়ে। আমি নিজেও এখন চেষ্টা করি স্মৃতি এবং কল্পনার মাঝের সময়টুকুর সঠিক ব্যবহার করতে।
জীবন কখনোই একই রকম যায় না, জীবন বদলায়, আমিও..!