আমার ভ্যালেন্টাইন-১ম পর্ব
আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। আমি সিঙ্গেল মানুষ। তাই কোথাও ঘুরতে না গিয়ে বাসায় গভীর ঘুম দিচ্ছি। এ দিবসে সিঙ্গেল ছেলেমেয়েদের জন্য এটাই সবচেয়ে শান্তির কাজ।
ঘড়িতে এখন সময় দুপুর বারোটা। এ সময় বাবা-মা আমার রুমে এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলাম। উনাদের দেখে বুঝলাম উনারা বাইরে যাচ্ছেন। দুজনই সেজেগুজে রেডি। মা সুন্দর একটা হলুদ শাড়ি পরেছেন। আর বাবা পরেছেন হলুদ রঙের পাঞ্জাবি।
মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। তবে বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অদ্ভুত। সারাক্ষণ আমরা একে অপরের সঙ্গে লেগেই থাকি। যারা আমাদের অপরিচিত, তারা আমাদের দুজনের কথোপকথন শুনলে ভাববে যে আমরা দুজন বাবা-ছেলে না। আমরা দুজন দুজনের শত্রু। যাদের কাজই হলো একে অপরকে সারাক্ষণ পচানো। তবে বিষয়টি মাঝেমধ্যে একটু অতিরিক্ত হয়ে গেলেও আমরা দুজন বেশ উপভোগ করি। মা-ও বেশ মজা পায় আমাদের এই খুনসুটিতে।
বাবা অহংকারের ভঙ্গিতে আমাকে বললেন,
-ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে তোর মাকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি। দেখ তো আমাদের কেমন লাগছে?
-মাকে পরির মতো লাগছে।
মাকে পরি বলায় মায়ের মুখটায় লজ্জা লজ্জা একটা ভাব ফুটে উঠল। বাবা ভ্রু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কত বড় বেয়াদব দেখেছ! তোমাকে বলল পরির মতো লাগছে। অথচ আমার ব্যাপারে কিছুই বলল না।
-সরি বাবা, বলতে ভুলে গেছি। তোমাকে আসলে জিনের মতো লাগছে।
বাবা মায়ের দিকে আবার তাকিয়ে বললেন,
-সে এটা কী বলল? এমন ছেলে তুমি আমাকে উপহার দিলে?
-বাবা রাগ করছ কেন? তোমাকে তো ভূতের মতো লাগছে বলিনি, বলেছি জিনের মতো লাগছে। অবশ্য তোমাকে জিন বলাটাও সঠিক হয়নি। কারণ শুনেছি জিনেরা নাকি লম্বা হয়। হা হা হা….
আমার কথা শুনে মাকে দেখলাম মুখ টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। তবে বাবা রেগে গিয়ে আমাকে বললেন,
-নিজের বাবাকে খাটো বলে খোঁটা দিতে তোর লজ্জা করে না? আমি লম্বা না হলেও আমার জেলা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েকে ভালোবেসে আমার সংসারে নিয়ে আসতে পেরেছি। আর তুই লম্বা হয়ে কী উদ্ধার করেছিস? আজ ভ্যালেন্টাইন ডে। দুনিয়ার সবাই ঘরের বাইরে তাদের ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তুই কী করছিস? ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছিস। গাধা কোথাকার।
-বাবা শোনো, মা যে তোমার সংসারে, এটা কিন্তু তোমার ক্রেডিট না। বলতে পারো এটা মায়ের বোকামি। মা বোকামি করে তোমার প্রেমে পড়ে তোমাকে বিয়ে করেছে। না হলে মায়ের অনেক সুন্দর ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতো। হা হা হা…
-আহাম্মকের মতো হাসবি না। আর শোন, ঘরের মধ্যে শুয়ে না থেকে একটু বাইরে যা। আজ দেশের সব মেয়েরা সেজেগুজে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পারলে একজনকে জয় করে নিয়ে আয়।
-বুঝলাম না তুমি কেমন বাবা। মানুষের বাবারা সন্তানকে প্রেমট্রেম না করার জন্য উপদেশ দেয়। আর তুমি? তুমি বলছ মেয়ে উঠায়ে নিয়ে আসতে। ছি বাবা, ছি।
-এই গাধাটা বলে কী! আমি কি উঠায়ে আনতে বলেছি? আমি বলেছি জয় করে নিয়ে আসতে।
-বাবা প্লিজ, যেখানে যাচ্ছিলে যাও। আর শোনো, আমার মায়ের দিকে খেয়াল রাখবে। রাস্তাঘাটে মায়ের যেন কোনো অসুবিধা না হয়।
এ কথা বলতেই মা আমার কপালে চুমু দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
-ওরে আমার বাবারে।
বাবা-মা চলে যাওয়ার পর ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। ঠিক করলাম বইমেলায় যাব। দেখি দু-একটা রম্য গল্পের বই কেনা যায় কি না। ঠিক করেছি মেট্রোরেলে যাব। শেওড়াপাড়া স্টেশনে ঢুকে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। পুরো প্ল্যাটফর্মে মানুষ আর মানুষ। তিল ধারণের জায়গা নেই। মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহরের মানুষ রাস্তায় চলে এসেছেন। যে ট্রেনগুলো আসছে তার সবই মানুষে ঠাসা। চেষ্টা করেও উঠতে পারলাম না। পরপর তিনটি ট্রেনে চলে গেল। তা-ও উঠতে পারলাম না। না, এভাবে সম্ভব না। ঠিক করলাম বাসায় ফিরে যাব। যেই ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম, তখনই মনে হলো বাবা টিটকারি মার্কা হাসি দিয়ে আমাকে বলছে, ‘অপদার্থ একটা। কোনো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস নেই।’
বাবার টিটকারি মার্কা কথা শুনে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। ঠিক করলাম যেভাবেই হোক পরের ট্রেনে উঠে পড়ব।
পরের ট্রেন আসতেই গায়ের জোরে শেষ মানুষ হিসেবে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ ভেতরে যাওয়া কোনোভাবে সম্ভব নয়। এ সময় একটা মেয়ে আমাকে ঠেলে ভেতরে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-প্লিজ, আমাকে একটু টেনে ভেতরে ঢোকান।
আমি দুই সেকেন্ড কী করব দ্বিধায় থাকলেও পরক্ষণেই মেয়েটিকে হাত ধরে ট্রেনের ভেতর টেনে ঢোকালাম। আমার পিঠ দিয়ে পেছনের লোকগুলোকে পেছনের দিকে ঠেলে মেয়েটিকে কোনোরকমে ঢোকাতে পারলাম। ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে রইল। মেয়েটি দরজায় পিঠ ঠেস দিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ানো। মেয়েটির মাথা আমার মুখের সঙ্গে লেগে আছে। আমি আমার মাথাটা বাঁ দিকে সরিয়ে ফেললাম।
আমরা ফুচকা নিয়ে খেতে বসলাম। একটি পুরো ফুচকা মুখে দিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে খেতে খেতে মেয়েটি বলল,
-ও মাইগড, কী ঝাল। দীপান্বিতা।
-কী বললেন?
-বললাম আমার নাম দীপান্বিতা। আপনার নাম কী?
-কিসমত।
মেয়েটির মাথাটি এখন আমার ডান কাঁধের সঙ্গে লেগে আছে। ভেতরে এতটা মানুষের ভিড় যে আমি অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটির শরীর থেকে নিজের শরীরকে সরিয়ে রাখতে পারলাম না। আমাদের দুজনের মাঝখানের এক সুতাও দূরত্ব নেই। খুবই অস্বস্তিকর অবস্থা। আমি এভাবে শরীরের সঙ্গে শরীর লেগে থাকায় লজ্জায় পড়ে গেলাম। কিন্তু তারপরও মেয়েটিকে বুকের মাঝে দুহাত দিয়ে আগলে রাখলাম। ঝিনুক যেভাবে খোলসের ভেতর মুক্তাকে লুকিয়ে রাখে, ঠিক সেভাবে। যাতে অন্য মানুষের অবাঞ্ছিত ছোঁয়ায় মেয়েটি অস্বস্তিতে না পড়ে। মেয়েটি মিষ্টি করে বলল,
-আপনি না হলে মনে হয় আজ ট্রেনে উঠতেই পারতাম না। অনেকগুলো ট্রেন মিস করেছি। মেয়েদের কম্পার্টমেন্টেও ওঠার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওখানের অবস্থা আরও ভয়াবহ। আপনাকে ধন্যবাদ।
-ইটস ওকে। আপনার সমস্যা হচ্ছে না তো?
-না। আপনার হচ্ছে?
-হু হচ্ছে। আসলে জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি। তাই কিছুটা লজ্জা লাগছে।
-বলেন কী! কখনো কি গার্লফ্রেন্ডের গা ঘেঁষেও দাঁড়াননি। বা হাগ করেননি?
-ওগুলো করার জন্য তো একজন গার্লফ্রেন্ড থাকতে হবে, তা–ই না? সেটা এ পর্যন্ত কপালে জোটেনি।
-মিথ্যা কথা বলে সাধু সাজতে চাচ্ছেন, তা–ই না? হি হি হি...আপনারা ছেলেরা পারেনও হি হি হি...
ইচ্ছা করেই এ বিষয়ে আর তর্ক করলাম না। তবে আড়চোখে মেয়েটির মুখের দিকে একমুহূর্ত তাকালাম। দেখলাম মেয়েটির মুখে ঝুলে আছে দুষ্টামির হাসি। এলোমেলো চুলের ফাঁক দিয়ে যতটুকু চেহারা দেখা গেল, মনে হলো এ মেয়েটি এ গ্রহের না। অন্য কোনো গ্রহের। নিখুঁত সুন্দর।
ট্রেন একের পর এক স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে। লোক নামছে কম উঠছে বেশি। আমি আগ বাড়িয়ে আর কথা বলিনি। তবে মেয়েটিকে এখনো আমার পুরো শরীরকে ঢাল বানিয়ে আগলে রেখেছি। একটু পর মেয়েটি বলল,
-আমি টিএসসি স্টেশনে নামব। আপনিও কি ওখানে নামবেন?
-হু।
-আপনি কি বইমেলায় যাবেন?
-হু।
-একা যাচ্ছেন?
-হু।
-ওখানে কেউ কি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে?
-না।
-জানেন, আমিও একা যাচ্ছি বইমেলায়।
-ও।
-অবশ্য আমার একা যাওয়ার কথা ছিল না। আমার সঙ্গে আমার এক বান্ধবীর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সকাল থেকে ওর আবার শরীর খারাপ করেছে। ওর বাসা শেওড়াপাড়া। ওকে দেখার জন্যই শেওড়াপাড়ায় একটু নেমেছিলাম। আর নেমেই তো দেখলেন কী বিপদে পড়লাম।
-হু।
-আমার বাসা উত্তরা। জানেন, আমরা উত্তরার মানুষেরা কিন্তু অনেক ভাগ্যবান।
-হু।
-আমরা উত্তরার মানুষেরা মতিঝিল যাওয়ার সময়, সব সময় ট্রেনে সিট পাই। হি হি হি...
-ও।
-কারণ কি জানেন? কারণ ট্রেন তো ওখান থেকেই যাত্রা শুরু করে। হি হি হি...
-ও।
-আমি কি একটু বেশি বকবক করছি?
-হু।
-জানেন, আমার মা বলে আমি নাকি বেশি কথা বলি। আচ্ছা বলেন তো, আল্লাহ আমাদের কথা বলার জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাহলে আমরা সারাক্ষণ কেন কথা বলব না?
-হু।
-পশুপাখিদের যদি কথা বলার শক্তি থাকত, তো ওরা কি চুপ থাকত বলেন? থাকত না। কথা বলতে পারে না, তাতেই সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে।
-হু।
-হি হি হি...আপনাকে সাধু সাজছেন বলেছি বলে মাইন্ড করেছেন, তা–ই না? সে জন্য তখন থেকে হু, হা, ও, এভাবে কথা বলছেন। হি হি হি...
আমি এ কথার কোনো উত্তর দিলাম না। মেয়েটি আর কিছু বলল না। একসময় ট্রেন এসে টিএসসি স্টেশনে থামল। অবাক হয়ে দেখলাম গুটিকয় মানুষ ছাড়া বাকি সবাই ট্রেন থেকে নেমে গেল। বুঝলাম, বইমেলা ও ভ্যালেন্টাইনের কারণে পুরো ঢাকা শহরের গন্তব্য এখন টিএসসিতে।
আমি ট্রেন থেকে নেমে ইচ্ছা করেই মেয়েটির কাছ থেকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে নামতে যাব। হঠাৎ করে মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়াল। বলল,
-আপনি তো আজব মানুষ। সারা রাস্তা সবার কাছ থেকে আমাকে আগলে রেখে এখানে ভিড়ের মধ্যে একা ছেড়ে দিলেন? এটলিস্ট রাস্তা পর্যন্ত তো এগিয়ে দেবেন।
-সরি। ভুল হয়ে গেছে।
-আমার হাতটা ধরুন। না হলে নামার সময় মানুষের ধাক্কায় পড়ে যাব।
আমাকে হাত ধরতে ইতস্তত করতে দেখে মেয়েটি নিজেই আমার হাত শক্ত করে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে জানি না কেন জানি আমার পুরো শরীরটি কাঁটা দিয়ে উঠল। খুবই লজ্জা লজ্জা লাগতে লাগল। তখনই মনে হলো বাবা টিটকারি মার্কা হাসি দিয়ে আমাকে বলছেন, ‘অপদার্থ বুড়ো দামড়া একটা। মেয়েটি হাত ধরায় উনি লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছেন। হা হা হা...’
আমি মনে মনে বাবাকে বললাম, ‘বাবা, প্লিজ এভাবে অপমানকর কথা বলে হো হো করে হাসবে না। গায়ে লাগে।’
আমরা ভিড়ের মধ্যে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম।
রাস্তায় আসার পর মেয়েটি বলল,
-আপনিও একা এসেছেন আমিও একা এসেছি। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা কি একসঙ্গে বইমেলায় ঘুরতে পারি?
-আমার সঙ্গে ঘুরবেন? আমি কিন্তু সাধু না। সাধু সাজার ভান করছি।
-হি হি হি...বাব্বা, এত রাগ করেছেন? আরে, আমি তো ওটা মজা করে বলেছি। আপনি সিরিয়াসলি কেন নিচ্ছেন? শোনেন, আমাকে যারা চেনে তারা কখনো আমাকে সিরিয়াসলি নেয় না। সত্যি আমি ফান করে ওটা বলেছি। ওকে, তারপরও যদি মাইন্ড করে থাকেন, তবে সরি। প্লিজ, এবার একটু সহজ হোন।
-ঠিক আছে, যান আপনাকে ক্ষমা করলাম।
-ক্ষমা করলেন মানে! আমি কখন ক্ষমা চাইলাম?
-আপনি না এইমাত্র সরি বললেন?
-সরি বলেছি, ক্ষমা তো চাইনি। হি হি হি...
আমিও মেয়েটির হাসির সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলাম।
-মাইগড, আপনি হাসতেও পারেন?
আমি কিছু বললাম না। মেয়েটি বলল,
-আমার না খুব খিদে পেয়েছে। চলেন, আগে কিছু খেয়ে নিই। না হলে হাঁটতে পারব না।
-চলেন। তা কী খাবেন?
-আগুন খাব।
-আগুন খাবেন মানে!
-হি হি হি...আগুন খাব মানে, বেশি ঝাল দিয়ে ফুচকা খাব। যাতে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়।
আমরা ফুচকা নিয়ে খেতে বসলাম। একটি পুরো ফুচকা মুখে দিয়ে চোখমুখ বন্ধ করে খেতে খেতে মেয়েটি বলল,
-ও মাইগড, কী ঝাল। দীপান্বিতা।
-কী বললেন?
-বললাম আমার নাম দীপান্বিতা। আপনার নাম কী?
-কিসমত।
-কী!
-আমার নাম কিসমত। মানে কিসমত মিয়া।
-হি হি হি...
-শোনেন, হাসতে হলে আমার বাবার সামনে গিয়ে হাসবেন। এ নাম আমি রাখিনি। আমার বাবা রেখেছেন।
-না না নামটা তো খারাপ না। কিউট আছে। আমি হাসছি, কারণ এখন সাধারণত এমন নাম খুব একটা দেখা যায় না।
-আসলে কি জানেন, আমার বাবা যখন ছোট, তখন আমার দাদা মারা যান। আমার দাদার নাম কিসমত মিয়া।
নিজের বাবাকে ততটা কাছে পায়নি তো। তাই বাবার অভাবটা সন্তানকে দিয়ে পূর্ণ করতে চেয়েছেন। সে জন্য সন্তানের নাম বাবার নামে রেখেছেন।
-সো কিউট। তাহলে তো আপনার বাবা আপনাকে অনেক ভালোবাসেন।
-ভুল। সম্পূর্ণ ভুল। উনি সারাক্ষণ উপায় খোঁজেন কীভাবে আমাকে পচানো যায়। আমাকে ছোট করা যায়।
-সেটা কেমন?
-ওটা বলে বোঝানো যাবে না। একমাত্র আমাদের দুজনের কথোপকথন শুনলে তখন বুঝতে পারবেন। জানেন, আমিও একই কাজ করি। সারাক্ষণ তাকে পচাই। জানেন, আমি কী ঠিক করেছি?
-কী?
-আমার বাবার নাম হাসমত মিয়া। আমি ঠিক করেছি আমার ছেলের নামও রাখব হাসমত মিয়া। যাতে সবাই উনাকে হাসমতের দাদা হাসমত বলে ডাকে।
-এটা কিন্তু ঠিক না। আপনাদের বাবা-ছেলের দ্বন্দ্বে কেন অনাগত মাসুম বাচ্চাকে টানবেন? হাসমত–কিসমত নাম খারাপ বলছি না। কিন্তু এ সময় তো এসব নাম কেউ রাখে না। জানেন, আমার ছেলের নাম রাখব দীপ। দীপান্বিতার ছেলের নাম দীপ। সুন্দর না?
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম,
-হু অনেক সুন্দর। দীপান্বিতার ছেলের নাম দীপ। আর ওদিকে কিসমতের ছেলের নাম হাসমত।
ফুচকা প্রায় শেষের দিকে, ঠিক তখনই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। দেখলাম বাবা-মা সামনে দাঁড়িয়ে। বুঝলাম না এত হাজার হাজার মানুষের মধ্যেও তাদের সঙ্গেই কেন আমাদের দেখা হতে হবে? কী লজ্জা। আমি মেয়ে নিয়ে বসে আছি? আমি লজ্জায় থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাবা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-আমি জানতাম তুমি একটা বলদ, অপদার্থ, অচল জিনিস। কিন্তু তুমি মিথ্যুক, সেটা জানতাম না। তুমি প্রেম করে বেড়াচ্ছ অথচ তুমি আমাদের বলছ, তুমি সিঙ্গেল।
আমি কী বলব, তা বুঝে উঠতে পারছি না। মা এতক্ষণ দীপান্বিতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাবার কথা শেষ হতেই তিনি বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-মেয়েটি কি কিউট দেখেছ?
-অবশ্যই কিউট মেয়ে। কিন্তু মাথায় কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। না হলে এই বলদের মতো এমন অথর্ব পুরুষকে কেউ বয়ফ্রেন্ড বানায়? রুচির কি দুর্ভিক্ষ!
দীপান্বিতা এতক্ষণ অবাক হয়ে বাবার কথা শুনছিল। এবার সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
-ইনি কে? আপনার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে কেন?
আমিও দীপান্বিতার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললাম,
-ইনি হাসমত মিয়ার দাদা হাসমত মিয়া। চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: আমার ভ্যালেন্টাইন–২য় পর্ব
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]